বিজেপির প্রোপাগান্ডা সিনেমা ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’

আবার বলিউডের লক্ষ্যবস্তু বাংলা

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ২২

এর আগে যতবার বলিউডে বাংলা ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে, ততবারই ইতিহাস বিকৃতি ও ভারতীয় আগ্রাসী বয়ান প্রকাশ পেয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ উসকে দিলে হিন্দুত্ববাদী ব্যালটে ভোট বেশি পড়ে। এর আগে দেখা গেছে, বিজেপি সরকারের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীর ফাইলস কিংবা কেরালা স্টোরিজের মতো প্রোপাগান্ডা সিনেমা বানিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার আসছে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’। দেশভাগের আগের বছর কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গায় হাজারো হিন্দু ও মুসলমানের প্রাণনাশের ঘটনা ঘটে। তবে দাঙ্গা কলকাতাতেই কেবল আটকে থাকেনি, ওই ঘটনার ঝড় আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশের নোয়াখালীতে, সেখানেও রক্ত ঝরে। নোয়াখালী-কলকাতার দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে বানানো হয়েছে‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’। বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত এই সিনেমা মুক্তি পাবে আগামী মাসে। তবে ট্রেইলার প্রকাশের আগে থেকেই ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’ পক্ষ-বিপক্ষের জন্ম দিয়েছে। এমনকি কলকাতায় ট্রেইলার প্রকাশের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়েছে পুলিশি বাধায়।

ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এসেছে, ‘ইতিহাস’ তুলে ধরার নামে ওই সিনেমার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার’ চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে কিছু মহল থেকে। এই সিনেমা ঘিরে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। সিনেমা প্রদর্শনীতে নিষেধাজ্ঞা এসেছে পশ্চিমবঙ্গের খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। অভিনয়শিল্পীরা ‘ইতিহাস বিকৃতির অংশ হয়েছেন’ অভিযোগে সমালোচিত হচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারীরাও সিনেমাটি নিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়েছেন। নির্মাতাদের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ বলছেন ‘সত্য সামনে আসুক’। কেউ বলছেন, ‘অসত্য ও বিকৃত তথ্যনির্ভর সিনেমা বানিয়ে বিবেক অগ্নিহোত্রী আগেও আলোচনায় এসেছিলেন, এবারও হয়তো সেটিই ঘটতে চলেছে।’

বিজ্ঞাপন

তবে ‘তাসখন্দ ফাইলস’ ও ‘দ্যা কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমার তৃতীয় কিস্তি ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’ সমর্থন পাচ্ছে শাসক দল বিজেপির কাছে। এই দলটি জানতে চেয়েছে, সত্য ঘটনা প্রকাশ হলে তৃণমূলের সমস্যা কোথায়? পরিচালক অগ্নিহোত্রী মাসখানেক ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় সিনেমার প্রচার চালাচ্ছেন। ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে একের পর এক পোস্ট করছেন তিনি। একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন : ‘১৯৪৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপূজার দিন গোলাম সারওয়ার ও তার ভাই ছোটমিয়া নোয়াখালীতে হত্যা ধর্ষণ এবং মানুষকে ধর্মান্তরিত করার কাজের নেতৃত্ব দেন।’ গোলাম সারওয়ার হুসেইনি ছিলেন নোয়াখালীর শ্যামপুর দায়রা শরিফের গদিনসীন পীর এবং নোয়াখালী কৃষক সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম নেতা। বিবেক অগ্নিহোত্রী আরেকটি পোস্টে লিখেছেন, ‘নোয়াখালীতে কংগ্রেস নেতার বাড়িতে হামলা করে তার ছেলেকে খুন, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো দলের অফিস।’ অগ্নিহোত্রী এই সিনেমার প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়াকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইছেন বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। এতে অভিনয় করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপম খের, পল্লবী জোশী, শাশ্বত চ্যাটার্জি, প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি, দর্শন কুমারের মতো তারকারা। আর কলকাতায় ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে যে চরিত্রটি দাঙ্গার সময় হাজার হাজার হিন্দুর ‘প্রাণ রক্ষা করেছিলেন’ বলে দাবি করা হয়, সেই ভূমিকায় আছেন অভিনেতা সৌরভ দাস।

পরিচালক বিবেক অগ্নিগোত্রীর ‘ফাইলস’ ট্রিলজির তৃতীয় সিনেমা ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’ মুক্তি পাচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর। বিবিসি বাংলা লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি, শিকাগো, সান হোসে, সানফ্রান্সিসকোসহ বিভিন্ন শহরে ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমার প্রিমিয়ার হয়েছে ইতোমধ্যে। শিকাগোতে প্রিমিয়ারে ভারতের কনসাল জেনারেল সোমনাথ ঘোষও উপস্থিত ছিলেন। ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলসে’র দিকে ‘সাহায্যের হাত’ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অগ্নিহোত্রী তাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদও জানিয়েছেন। ভারতে সিনেমার আনুষ্ঠানিক ট্রেইলার প্রকাশ হয়েছে ১৬ আগস্ট। ৭৯ বছর আগে যে দিনটিতে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় মুসলিম লীগ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনে’র ডাক দিয়েছিল, হিন্দু-মুসলমানের লাশ পড়েছিল ওই সময় নোয়াখালীতেও। ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমার ট্রেইলার প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল একটি প্রেক্ষাগৃহে। তবে আয়োজকরা ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক চাপে’ ওই অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়। এই সিনেমাটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছেন অভিষেক আগরওয়াল এবং পল্লবী যোশী।

তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বেঙ্গল ফাইলস দেখানো যাবে না। এর কারণ প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বানিয়ে রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যা রাজ্য সরকার কিছুতেই মেনে নেবে না।’ তিনি অগ্নিহোত্রীকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, তিনি যেন ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলস’ বানানোর আগে উত্তর প্রদেশের নির্যাতিতাদের নিয়ে ‘ইউপি ফাইলস’ বানান। পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘বাংলা ভাগের অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু সেই কারণগুলো নিয়ে যদি কাজ করতে হয়, তবে গবেষণা করতে হয়। এবং দাঙ্গা বা দেশভাগ কেন হয়েছিল, তা ভাবতে হয় ।’

এই সিনেমার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গোপাল পাঁঠা। এই ব্যক্তিকে দাঙ্গার সময় কলকাতায় হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে বলে আভাস মিলেছে ট্রেইলারে। অভিযোগ এসেছে গোপাল পাঁঠা ওরফে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের পরিবার থেকেও। তার বর্তমান প্রজন্মের উত্তরাধিকারীরা অভিযোগ করেছেন, সিনেমায় তাকে একজন মুসলিম-বিদ্বেষী কসাই হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা মানা যায় না। গোপাল পাঁঠার পৌত্র শান্তনু মুখার্জি দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘তার পিতামহ দাঙ্গার সময় বহু মুসলিমেরও প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং বহু মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল।’ জবাবে অগ্নিহোত্রী শান্তনু মুখার্জিকে তৃণমূলের একজন নিজস্ব মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত