আব্দুল আলীম: মাটির সুরের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয়

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৩০

বাবা গ্রামোফোন আনেন ঘরে। অবাক হয়ে সেই যন্ত্র দেখেন বালক আব্দুল আলীম। মুগ্ধ হয়ে গান শোনেন। এক-দুটি গান মুখস্থও হয়ে যায়। কারো সামনে গাইতে লজ্জা পান। চলে যান খোলা মাঠে। গলা ছেড়ে গান ধরেন। কলের গানে শেখা গান ফুটে ওঠে বালকের গলায়। এ কান-ও কান করে বালকের গানের প্রতিভার কথা ছড়িয়ে যায় গ্রামে। আচার-অনুষ্ঠানে তাকে গাইতে হয় গ্রামবাসীর অনুরোধ আর বড় ভাইয়ের সাহসে। দিগ্বিদিক্‌ ছড়িয়ে পড়ে আব্দুল আলীমের দরাজ গলার প্রশংসা। ততদিনে স্থানীয় ওস্তাদের কাছে গান শেখা শুরু। প্রচলিত গানগুলো গলায় তুলতেন তখন।

মুসলিম লীগের বর্ষীয়ান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কলকাতায় জনসভা। জনসভা শুরুর আগে স্থানীয় শিল্পীরা গান গাইছেন। বড় ভাই গোপনে গিয়ে আব্দুল আলীমের নাম লিখে দিয়ে আসেন। মঞ্চে বসে আছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সামনে হাজার হাজার মানুষ। নাম ঘোষণা হলো। বড় ভাই সাহস দিয়ে মঞ্চে নিয়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে আব্দুল আলীম গাইলেনÑ‘সদা মন চাহে মদিনা যাব’। গান শেষে আব্দুল আলীম ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখেন মুসলিম লীগ নেতার চোখে পানি। সাহস পেলেন কিশোর আব্দুল আলীম।

বিজ্ঞাপন

একদিন বড় ভাই নিয়ে গেলেন আব্বাস উদ্দিনের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানির অফিসে। কোম্পানির মালিক ততদিনে জেনে গেছেন আব্দুল আলীমের প্রতিভা। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন কাজী দার সঙ্গে। বললেন, ‘কাজী দা, ছেলেটা দারুণ গায়। একটা গান শুনবেন?’ কাজী দা রাজি হলেন। আব্দুল আলীম গাইলেন কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সেই গানটিইÑ‘সদা মন চায় মদিনা যাব’। তন্ময় হয়ে গান শুনলেন কাজী দা। গান শেষে ডাকলেন গ্রামোফোন কোম্পানির মালিককে। বললেন, ওর দুটি গান রেকর্ড করুন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ এবং ‘আফতাব আলী বসলো পথে’ গান দুটি রেকর্ড হলো। এই প্রথম যান্ত্রিক উপায়ে আব্দুল আলীমের গলা ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলায়।

দেশ ভাগের পর বড় ভাই বললেন, চল ঢাকায় যাই। বড় ভাই ঢাকায় চাকরি করতেন। চলে এলেন ভাইয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশ বেতারে চুক্তিভিত্তিক গান করতেন। প্রতিদিন পেতেন ১০ টাকা। থাকতেন মেসে। রেডিওতে গাইতেন পছন্দের সব গান। ততদিনে পরিচিত হয়ে গেছেন বাংলার তৎকালীন সব শিল্পীর সঙ্গে। একদিন রেডিওতে গান বাজছিল। আব্দুল আলীম থমকে গেলেন। গানের সুর আর বাঁশির টান তার হৃদয় ছেয়ে গেল যেন। আব্দুল আলীম বললেন, আমি এই গান গাইতে চাই। তারপর শুরু হলো পল্লিগীতির সঙ্গে প্রেমÑযা আব্দুল আলীমকে যতটা না সমৃদ্ধ করেছে, তারচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছে বাংলা গানকে। বাংলা গানের ভাণ্ডারে একের পর এক যোগ করেছে ‘আর কতকাল ভাসবো আমি’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, ‘কে যাও ভাটির দেশের নাইয়া’, ‘শোনো গো রূপসী কন্যা গো’, ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’র মতো গান।

টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। প্রায় অর্ধশত সিনেমায় প্লেব্যাক করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এ গান গেয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও ‘সুতরাং’, ‘রূপবান’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘লালন ফকির’, ‘সুজন সখী’র মতো সিনেমায় গান গেয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এই নন্দিত শিল্পী।

আব্দুল আলীমের গাওয়া অসংখ্য কালজয়ী গানের মধ্যে রয়েছে ‘মেঘনার কূলে ঘর বান্ধিলাম’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, ‘কে যাও রে ভাটির দেশের নাইয়া’, ‘শোনো গো রূপসী কন্য গো’, ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’, ‘দোল দোল দোলনি’, ‘এই যে দুনিয়া কীসেরও লাগিয়া’, ‘পরের জায়গা পরের জমি’, ‘থাকতে পার ঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া’প্রভৃতি। এছাড়া ‘আল্লাহু আল্লাহু, তুমি জাল্লে জালালুহু’, ‘নবী মোর পরশমণি’, ‘মনে বড় আশা ছিল যাবো মদিনায়’সহ বহু ইসলামিক গানও উপহার দিয়েছেন তিনি।

স্বাধীন দেশে বেশিদিন বাঁচার সুযোগ হয়নি আব্দুল আলীমের। তাই তার সব পুরস্কার মরণোত্তর দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৭ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাকে। এছাড়া ১৯৭৫ সালের ‘সুজন সখী’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ গায়কের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। আব্দুল আলীম তার আধ্যাত্মিক ও মরমী-মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। কবি ও বাংলার লোকসংগীতের গবেষক কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, ‘সমাজটাকে যারা জাগিয়েছেন, আব্দুল আলীম তাদের একজন।’ পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সংগীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক।

‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই’, ‘পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই’-এর মতো মাটির সুর মেশানো কালোত্তীর্ণ গানগুলোর গায়ক আব্দুল আলীমের পাঁচ শতাধিক গানের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সংরক্ষণে নেই। তবে তার আড়াইশ থেকে তিনশর মতো গান লিপিবদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। আব্দুল আলীমের বড় ছেলে জহির আলীম ও মেয়ে নূরজাহান আলীমের আফসোস, তাদের বাবার সংগীত-সম্ভারের বহু গান এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের মহাফেজখানায় তার বহু গান অযত্নে পড়ে আছে। কূটনৈতিক জটিলতায় স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশকেও আব্দুল আলীমের সেসব গান ফেরানো যায়নি। প্রায় এক বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে চিঠি চালাচালির পর গত বছর আব্দুল আলীমের ১২টি গান হাতে পেয়েছে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশন। কিন্তু আব্দুল আলীমের গানের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা মেলে না বলেও আক্ষেপ রয়েছে তার সন্তানদের।

মরমী এই শিল্পী বহু গান যেমন উপহার দিয়েছেন, তেমনি অর্জন করেছেন অনেক সম্মাননা ও স্বীকৃতি। সে তালিকায় আছে স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। তবে এ দুটি পদকসহ গুরুত্বপূর্ণ সাতটি পুরস্কার ও স্মারক চুরি হয়ে গেছে। চলতি বছরের ৮ মে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় এই চুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু এখনো এসব মূল্যবান পদক উদ্ধার হয়নি। আব্দুল আলীমের কন্যা নুরজাহান আলীম জানান, চুরি যাওয়া জিনিসগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালের একুশে পদক, ১৯৯৭ সালের স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দেওয়া তমঘা-ই-হুসন এবং লাহোরে নিখিল পাকিস্তান সংগীত সম্মেলনে প্রাপ্ত দুটি সম্মাননা স্মারক।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন আবদুল আলীম। দেশ স্বাধীনের তিন বছর পরই মারা যান আব্দুল আলীম। তার মৃত্যুর প্রায় পাঁচ দশক হতে চলল। এই লম্বা সময়ে তিনি হয়তো প্রজন্মের কাছে অনেকটা বিস্মৃত হয়ে গেছেন। তবে তার গান এখনো দোলা দেয় সবার মনে। নতুন প্রজন্মের কাছেও সেসব গানের গ্রহণযোগ্যতা বেশ। বাংলার চিরায়ত রূপবৈচিত্র্য, সংস্কৃতি কিংবা মাটির সুরের জন্য তিনি যেন শ্রেষ্ঠতম আশ্রয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত