ভূমিকম্প বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে। আবহাওয়াবিদরা বলেন, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া খুব জটিল বিষয়। কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্পকে সরাসরি নির্ণয় করা যায় না। তবে ভূমিকম্পবিষয়ক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি ও সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকা অত্যন্ত জরুরি। আবার ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকম্পের সময় কিছু করণীয় আছে।
ভূমিকম্পের আগে প্রস্তুতি
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পূর্ব প্রস্তুতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ঘরবাড়ি, অফিস, স্কুল বা যেকোনো ভবনে এমন কিছু ব্যবস্থা থাকা উচিত, যা কম্পন শুরু হলে আঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
পরিবারের সব সদস্যকে জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা জরুরি। শিশু, বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যদের আলাদা করে প্রস্তুত করতে হবে। ঘরের ভেতর ভারী আলমারি, শোকেস, বুকশেলফ, ফ্রিজ বা টিভিÑসব দেয়ালে পেরেক বা ব্র্যাকেট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা থাকা উচিত। কারণ ভূমিকম্পে এসব ভারী জিনিস উল্টে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
রান্নাঘরের ওপরের তাকগুলোতে কাচের বাসন বা বোতল রাখলে কম্পনে সেগুলো পড়ে ভেঙে যেতে পারে, তাই নিচের স্তরে ভঙ্গুর জিনিস রাখা উত্তম। জরুরি বহির্গমন পথ খোলা ও অবরুদ্ধহীন থাকা চাই। ঘরে একটি জরুরি ব্যাগ রাখা যেতে পারে, যেখানে টর্চলাইট, ব্যাটারি, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, পানি এবং কিছু শুকনো খাবার থাকবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ভূমিকম্পের সময় করণীয় নিয়ে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এটি দেওয়া আছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তুলে ধরা হলো।
* ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
* ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবের নিচে আশ্রয় নিন।
* রান্নাঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে আসুন।
* বিম, কলাম ও পিলার ঘেঁষে আশ্রয় নিন।
* শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুলব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।
* ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলা স্থানে আশ্রয় নিন।
* গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন।
* ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, যাতে ধুলাবালু শ্বাসনালিতে না ঢোকে।
* একবার কম্পন হওয়ার পর আবার কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন।
* উপরতলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে বিরত থাকুন।
* কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিন।
* গাড়িতে থাকলে পদচারীÑসেতু, উড়ালসড়ক, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে থাকুন।
* ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখুন।
* বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।
ভূমিকম্পের সময় বর্জনীয়
ভূমিকম্পে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে আতঙ্ক, ভুল ধারণা ও দৌড়াদৌড়ির কারণে। তাই কিছু বিষয় কখনোই করা যাবে না।
* কখনোই লিফট ব্যবহার করা যাবে না।
* জানালা, কাচ ও ভঙ্গুর বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে।
*দৌড়ে ভবনের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা বিপজ্জনক কারণ বাইরে যাওয়ার পথে বা সিঁড়িতে ধসের ঝুঁকি বেশি।
* মোমবাতি বা আগুন জ্বালাবেন না, গ্যাস লিকেজের আশঙ্কা থাকলে আগুন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
* ভারী আসবাবের নিচে লুকিয়ে ভুল করবেন না, এসব সহজেই ভেঙে পড়তে পারে।
ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর করণীয়
কম্পন থেমে যাওয়ার পরও বিপদের পুরোপুরি সমাপ্তি হয় না। আফটারশক যেকোনো সময় হতে পারে, যা মূল ভূমিকম্পের মতোই বিপজ্জনক। তাই পরবর্তী করণীয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমে ভবনের ক্ষয়ক্ষতি পরীক্ষা করতে হবে। দেয়ালে বড় ফাটল, খসে পড়া অংশ বা বিম-কলামে সমস্যা দেখা গেলে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। ঘরের গ্যাসসংযোগ, পানির লাইন ও বিদ্যুতের সুইচ পরীক্ষা করে দেখুন। গ্যাস লিকের গন্ধ পেলে দ্রুত জানালা খুলে দিন এবং ম্যাচ/চুলা জ্বালাবেন না।
আশপাশে কেউ আহত থাকলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিন এবং গুরুতর হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠান। জরুরি নম্বরগুলো হাতের কাছে রাখুন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে সবাই জড়ো হতে হবে।
সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন বা মোবাইলে পাওয়া আপডেট অনুসারে নিরাপদে চলাচল করতে হবে। ভূমিকম্পের পর গুজব ছড়ানো বা যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

