কেমন ঈদ কাটল শহীদ সৈকতের পরিবারে

রায়হান আহমেদ তামীম
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫, ১৩: ৫৩
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ১৫: ১৬

স্বৈরাচারী হাসিনার পলায়নের পর বহু দিন কেটে গেছে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে ঈদুল ফিতরের পর পেরিয়ে গেল ঈদুল আজহাও। মুক্ত বাংলাদেশে যখন ঈদ সবার ঘরে আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে, তখনো ঈদ আসেনি শহীদ পরিবারে।

ছেলে হারানোর বেদনায় দিনগুলো যেন কাটছেই না শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের মা আফরোজা রহমানের। প্রতি সকালে ঘুম ভাঙতেই অভ্যাসবশত ঘর ঝাড়ু দেন, গোছান ও রান্নাবান্না করেন। কিন্তু যখনই খেতে বসেন, চোখের সামনে ভেসে ওঠে আদরের ছেলের মুখখানা। গলা দিয়ে আর খাবার নামে না। প্রতিটি লোকমা যেন গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে। কোনোমতে দু-এক লোকমা মুখে গুঁজে খাবার পর্ব শেষ করেন তিনি। বড় মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকে, মেজো মেয়ে সেবন্তী সারা দিন অফিসেই ব্যস্ত। আর সৈকতের বাবা? মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাসার কাছেই তার দইয়ের দোকান; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানেই কেটে যায় তার সময়।

বিজ্ঞাপন

বিশাল এই বাড়িতে আফরোজা রহমান শুধুই একা। সৈকতের চলে যাওয়ার পর তার শূন্যতার সঙ্গী বলতে এখন শুধু মেজো মেয়ে সেবন্তী আর সৈকতের প্রিয় দুটো বিড়াল। যখনই অবসাদ গ্রাস করে, বিড়াল দুটিকে কোলে টেনে নেন। ওদের উষ্ণ নরম লোমে হাত বোলাতে বোলাতে আফরোজা বেগমের চোখে ভাসে সেই দৃশ্যÑসৈকত থাকাকালে কীভাবে বিড়াল দুটি ওর গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়ত। ওদের মাঝেই তিনি খুঁজে ফেরেন আদরের সন্তানের স্মৃতি। ‘ওরা যেন সৈকতের ছোঁয়া,’ বলতে বলতে তার চোখ ভিজে ওঠে।

‘দুটো ঈদ চলে গেল, ছেলেটাকে দেখি না! আল্লাহ ভালো জানেন আরো কত ঈদ ছেলেটাকে ছাড়া করতে হবে,’ বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ওঠেন আফরোজা রহমান। ‘জান্নাতে গেলে তো অবশ্যই ছেলের দেখা পাব।’ তিনি থামেন না। ‘আমার ছেলেটা খুব সাহসী ছিল। ছোট থেকেই কোরবানির ঈদের জন্য ওর কী যে উত্তেজনা ছিল! আশপাশের সবার গরু দেখতে যেত, এমনকি জবাইয়ের দৃশ্য দেখেও ভয় পেত না। আমাদের গরু আসত ঈদের আগের দিন রাতে, কখনো কখনো ঈদের দিন সকালেও।’ সৈকত বলত, ‘তোমরা মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গরু আনো, না পারি আদর করতে, না পারি একটু কিছু খাওয়াতে। এক দিন আগে আনলে কী সমস্যা!’

ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠত সৈকত। গোসল করে কখনো ফুপার সঙ্গে, কখনো বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেত। ‘খুবই চঞ্চল ছিল ও,’ আফরোজা রহমান স্মৃতির অতলে ডুব দেন, ‘সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আর সালামি নেওয়ার জন্য সে কি আবদার! মিষ্টি হেসে এসে বলত, ‘আম্মা, সালামিটা কই? ঈদের দিনে বুঝি তোমার ছেলে খালি হাতে ফিরবে?’ সবার কাছে গিয়ে গিয়ে সালাম করে সালামি আদায় করে আনত। দুটো ঈদ চলে গেল, ছেলেটা আর সালামি নিতে আসে না, বলতে বলতে আবার অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েন মা।

‘এবার ঈদে কারোরই ইচ্ছা ছিল না কোরবানি দেওয়ার। মন ভালো নেই, ছেলেকে বারবার মনে পড়বে এ জন্যই ভাবছিলাম কোরবানি দেব না,’ তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ‘কিন্তু পরে মনে হলো, আল্লাহ যদি নারাজ হোন, সামর্থ্য থাকার পর কোরবানি না করলে তো জবাবদিহি আছে, তাই ছেলের শোককে মাটিচাপা দিয়ে কোরবানি এবারও দিয়েছি।’

নেহারির পাত্র থেকে আরো দুটো পায়া তুলে মেয়ের পাতে রাখলেন আফরোজা রহমান। বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ‘সৈকত আর সেবন্তীর কী যে পছন্দ ছিল নেহারি রুটি! ওরা দুই ভাইবোন যেন পাল্লা দিয়ে খেত, কে কার চেয়ে বেশি খাবে! বাবার সঙ্গে তর্কে লেগে যেত। সৈকত বলত, ‘আম্মুর রান্না অনেক মজা, এত মজা করে কেউ রান্না করতে পারে না।’ আর ওর বাবা হেসে বলত, ‘তোমার আম্মু, প্রশংসা তো তুমি করবাই। যাই বলো, আমার মায়ের রান্নার স্বাদ আমার মুখে লেগে আছে এখনো। আমার মায়ের রান্নার কাছে তোমার মা ফেল!’

মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের এই বাড়িতে প্রায় সাতাশ বছর ধরে বসবাস করছে পরিবারটি। বড় বোনের বিয়ের পর দুই ভাইবোন-সৈকত আর সেবন্তীÑ গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দীপে তেমন একটা যেতেন না, কারণ সেখানে আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ বেঁচে নেই। সৈকত চলে যাওয়ার পর বাড়িজুড়ে যেন নেমে এসেছে কবরের নিস্তব্ধতা! সৈকতের রুমে ঢুকতেই চোখে পড়ে পড়ার টেবিলে পাঠ্যবইয়ের স্তূপ। টেবিলের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ফুটবল। একপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো সৈকতের শখের সাইকেল। টেবিলের ওপর সারি সারি সাজানো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অর্জন করা সম্মাননা পুরস্কার। বাড়িজুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সৈকতের স্মৃতি। নেই শুধু সৈকতই!

স্বৈরাচার পতনের পর প্রায় ১১ মাস কেটে গেছে, কিন্তু এখনো গণহত্যার বিচারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ নিয়ে আক্ষেপ সৈকতের মা এবং বোনের। তারা চান, সৈকতসহ সব শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত বাংলাদেশে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। তাদের স্বপ্ন, এই নতুন বাংলাদেশ যেন সব শ্রেণি-পেশা, মত ও ধর্মের মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত