কর্মবীর তরুণ সাগর

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৩৫

বাংলাদেশের তরুণসমাজে কিছু মানুষ আছেন, যারা আলোচনার কেন্দ্রে না থেকেও সমাজ পরিবর্তনের ভিত নির্মাণে নীরবেই রেখে যাচ্ছেন অসামান্য অবদান। তাদের হাত ধরেই সমাজে গড়ে উঠছে পাঠাগার, চরিত্রবান প্রজন্ম ও সচেতন নাগরিক। তেমনি একজন আত্মপ্রত্যয়ী তরুণ মাহমুদুল হাসান সাগর—একাধারে সংগঠক, লেখক, বিতার্কিক ও সমাজকর্মী। তাকে নিয়ে লিখেছেন ইমাম হাসান

শিকড়ের দিকে যাত্রা

বিজ্ঞাপন

১৯৯৮ সালে জন্ম কেরানীগঞ্জের কালিন্দী গ্রামে, ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী জনপদে। ছোটবেলায়ই ধর্মীয় জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। নিজ গ্রামের মাদরাসায় নুরানি ও হিফজ পড়াশোনা শেষে ভর্তি হন ঢাকার বড় কাটরা মাদরাসায়। এরপর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস বা তাকমিল সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি আলিম পড়েন ঢাকা আলিয়াতে। পরবর্তী সময়ে ইসলামি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন জামিয়াতুত তারবিয়াহ আল ইসলামিয়ায়। বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে অনার্সে অধ্যয়নরত।

মেধা ও যুক্তির সমাহার

শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন বিতর্কের মঞ্চে অনন্য এক নাম। ছানাবী আউয়ালের বছরেই পেয়েছেন ‘সেরা তার্কিক’-এর খেতাব। আঞ্চলিক পর্যায়ে বহুবার মঞ্চ মাতিয়েছেন যুক্তির দীপ্তিতে; হয়েছেন ‘সেরাদের সেরা’। যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে মানুষের মন জয় করার এই দক্ষতাই তাকে অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা করেছে। শুধু নিজে বিতর্কে সেরা হয়ে থেমে থাকেননি, বরং আজও সময় দেন তরুণ তার্কিকদের গড়ে তুলতে। তৈরি করে চলেছেন যুক্তিশীল নতুন প্রজন্ম, যারা চিন্তা করবে নিজের মতো করে, গড়ে তুলবে সাহসী কণ্ঠস্বর।

এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়

বইয়ের সঙ্গে সাগরের বন্ধুত্ব শৈশব থেকেই। সে বন্ধন এতটাই দৃঢ় যে, কারাবাসেও তা ছিন্ন হয়নি। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ৬০ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি। সেই অন্ধকার সময়েও পড়ে ফেলেন ৫০টিরও বেশি বই, যা তার মানসিক দৃঢ়তা ও অধ্যয়নের স্পৃহার নিদর্শন। কারাবাস থেকে ফিরে এসে আরো সক্রিয় হয়ে ওঠেন সমাজ গঠনে।

লেখালেখির শুরু ও বিকাশ

লেখালেখির শুরু মাদরাসার দেয়ালিকায়। বড় কাটরার দেয়ালিকা, তারপর রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলার দেয়ালিকা, সেখান থেকে সাহিত্য সাময়িকী ‘হরফ’-এর সম্পাদনায় এবং ত্রৈমাসিক ‘উদয়ন’-এর সহ-সম্পাদনায় যুক্ত হন।

তার লেখা শ্রুতলিখন থেকে রূপ পেয়েছে বিশিষ্ট আলেম মাওলানা মামুনুল হক হাফিযাহুল্লাহর দুটি আলোচনা—‘ভাঙো জড়তা’ ও ‘আত্মশুদ্ধি ও জিহাদ’। উভয়ই প্রকাশিত হয়েছে বই আকারে। নিজস্ব গবেষণা ও মননের ফসল হিসেবে প্রকাশ করেছেন একটি মৌলিক গ্রন্থ ‘ইলহাম থেকে হাফেজ্জী হুজুরের রাজনীতি: চিন্তা, দর্শন, অবদান’—যেখানে তুলে ধরা হয়েছে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ভাবধারা ও রাজনৈতিক দর্শনের বিশ্লেষণ।

পাঠাগার আন্দোলন ও সমাজ গঠন

২০১৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলোর দিশারী ইসলামী পাঠাগার’। এটি কেবল বই পড়ার জায়গা নয়, বরং চিন্তাচর্চা, নেতৃত্ববিকাশ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গঠনের একটি কেন্দ্র। এর মাধ্যমে স্থানীয় তরুণদের মাঝে গড়ে ওঠে জ্ঞান ও আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব। পরবর্তী সময়ে তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আরো চারটি পাঠাগার—হেরার আলো (কুশিয়ারবাগ), আলোর ফোয়ারা (মান্দাইল), খলিফাপাড়া ইসলামী পাঠাগার প্রভৃতি। সব পাঠাগার একীভূত করে তিনি গড়ে তুলেছেন সমন্বিত পাঠাগার মুভমেন্ট। এসব পাঠাগার কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইনসহ নানা সামাজিক উদ্যোগ।

শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের প্ল্যাটফর্ম

২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উম্মাহ একাডেমি, যেখানে শিশু-কিশোরদের কোরআন শিক্ষা, মৌলিক দ্বীন, নৈতিকতা ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই একাডেমি শুধু দাওয়াহ কাজ নয়, বরং একাডেমিক ও কালচারাল কার্যক্রমেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। স্কুলশিক্ষার্থীদের কোরআন ও মৌলিক দ্বীন শিক্ষায় উম্মাহ একাডেমি চমৎকার আয়োজন করেছে। স্কুলে স্কুলে গিয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজন করে কচিকাঁচা ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ নাগরিক হওয়ার সবক দিচ্ছে। স্কুলশিক্ষার্থীদের আগামীর বাংলাদেশ গড়তে বহুমুখী যোগ্যতা ও প্রতিভায় আলোকিত করছে।

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার ও করোনা-যুদ্ধ

উপস্থিত পাঠক সমাজকে গতিশীল করতে তিনি চালু করেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। ‘বইয়ের ঝুলি, পাঠক খুঁজি’—এই স্লোগান নিয়ে ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দেন। কোভিড মহামারির কঠিন সময়েও থেমে থাকেননি। ‘বইয়ের সঙ্গে এক বিকেল’ প্রোগ্রাম আয়োজন করে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। পাশাপাশি তিনি ও তার দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দিতেন, আবার খাবারও পৌঁছে দিয়েছেন অসহায়দের হাতে। চলমান সময়ে স্কুলভিত্তিক ও মসজিদভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার কার্যক্রম শুরু করেছেন। মানুষের হাতে হাতে মাহমুদুল হাসান সাগর ও তার টিম বই পৌঁছে দিচ্ছে। বইয়ের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে পাড়া, গ্রাম ও মহল্লায়।

মানবসেবায় বারাকাহ ফাউন্ডেশন

তিনি গঠন করেছেন বারাকাহ ফাউন্ডেশন, যার মাধ্যমে দেশের নানা দুর্যোগে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, রমজানে ইফতার, ঈদে উপহার, গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তা, এমনকি গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তাও পৌঁছে দিয়েছেন।

আদর্শ, অভিভাবকতা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

আত্মশুদ্ধির পথে তিনি আস্থাশীল। আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন মাওলানা মামুনুল হক হাফিযাহুল্লাহর সঙ্গে। ছায়া ও দিকনির্দেশনা পেয়েছেন মাওলানা মাহফুজুল হক হাফিযাহুল্লাহর কাছ থেকে। তার চিন্তাধারায় উম্মাহভিত্তিক ঐক্য, তাওহিদ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ অগ্রাধিকার পায়। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরেই তিনি ভালো ফলাফল করেছেন, বেফাকের সিরিয়ালসহ মেধা তালিকায় নাম ছিল নিয়মিত। মেধা ও আদর্শের অপূর্ব সমন্বয়ে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন ভবিষ্যতের জন্য।

শেষ কথা

মাহমুদুল হাসান সাগর নিছক একজন তরুণ সংগঠক নন, তিনি একজন চিন্তাশীল পথিকৃৎ, যার মধ্যে রয়েছে আদর্শিক উচ্চতা, চিন্তার গভীরতা ও কর্মপ্রয়াসের দৃঢ়তা। পাঠাগার আন্দোলন, শিক্ষাক্ষেত্র, মানবসেবা ও দাওয়াহ—সবকিছু মিলিয়ে তিনি গড়ে তুলছেন এক নতুন বাস্তবতা নিঃশব্দে, অথচ অদম্য গতিতে।

বিষয়:

তরুণ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত