স্বপ্নপথে এগিয়ে চলা

ফরিদ উদ্দিন রনি
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ০৮

সাব্বির আহমেদ। তরুণ গবেষক। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক। স্কলারশিপ পেয়ে পাড়ি জমান সুইডেনের ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউটে। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে মারি-কুরি ফেলোশিপ পেয়ে পিএইচডি করতে যান নেদারল্যান্ডস। বর্তমানে পোস্টডক্টরাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন নেদারল্যান্ডসের উট্রেখট ইনস্টিটিউট অব ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সে ও উট্রেখট ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারে প্যাথলজি রিসার্চ ল্যাবে। নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক ড. রোজ মাজেরেউ। তাদের লক্ষ্য কিডনি রোগের ওপর বিস্তর গবেষণা ও রিপারপাজ ওষুধের মাধ্যমে রোগ ভালো করার কার্যকর উপায় বের করা। কর্মক্ষেত্রের বাইরে সচেতনতা তৈরি এবং গবেষণায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে কাজ করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেন খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্যচিত্র। এরই মধ্যে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন সাব্বির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরিদ উদ্দিন রনি

গবেষণায় আগ্রহী হলেন যেভাবে

আমি সুইডেনে আসি ২০১৬ সালে। রুমমেট ছিলেন শফিক ভাই (যিনি বর্তমানে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষক হিসেবে কর্মরত)। শফিক ভাই পরামর্শ দিলেন বাইরে কাজকর্ম করে টাকাপয়সা রোজগারের লোভ না করে কোনো ল্যাবে কাজ শেখার সুযোগ খুঁজতে। ওনার পরামর্শ অনুযায়ী স্টকহোমের বিভিন্ন ল্যাবে ই-মেইল করতে শুরু করলাম। এক দিন আমাদের ইনস্টিটিউটেরই এক অধ্যাপকের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলাম। তিনি আমার আগ্রহের জায়গাটা বুঝতে পারেন এবং একটি প্রজেক্টে ওনার সঙ্গে কাজ করার অনুমতি দেন। এর মধ্যেই অধ্যাপক সাহেব আমাকে আরেকটি ই-মেইল করেন, আমার এই কাজের জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। সেখান থেকেই গবেষণায় পথচলা। স্নাতকোত্তর শেষে সাতপাঁচ না ভেবে সেই ল্যাবেই গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করা এবং পরে পিএইচডি করার জন্য নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমানো। প্রতিটি গবেষণা প্রজেক্ট নতুন নতুন কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেছে।

কাজের ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জানতে চাই

এখানে আমি যে গবেষণা দলের সঙ্গে কাজ করেছি, সে দলের কাজ প্রধানত কিডনির বিভিন্ন ধরনের রোগের ওপর গবেষণা করা। আমার গবেষণা কাজ হলো বায়ো মার্কারের ওপর। বর্তমানে কিডনি রোগ যাচাই করার জন্য রক্তের যেসব পরীক্ষা করা হয়, সেগুলো সব ক্ষেত্রে কার্যকর না, অনেক সময় দেখা যায় কিডনি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রচলিত রক্ত পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় না। ফলে চিকিৎসা শুরু করতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। তাই প্রাথমিক ধাপেই কিডনির রোগ ধরার উপায় বের করার চেষ্টা করেছি আমরা। এর সঙ্গে কিডনি রোগ ভালো করার লক্ষ্যে জিন এডিটিং, রিপারপাজ মেডিসিন এবং আর্টিফিশিয়াল কিডনি তৈরির উপায় নিয়েও চলছে আমাদের আরো কিছু প্রজেক্ট। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের ল্যাবে থিসিস করতে আসেন। গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের গবেষণা শেখানোর কাজও করতে হয়।

তথ্যচিত্রে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। কী উদ্দেশ্য থেকে এই কাজ শুরু করলেন?

প্রথম ভিডিওচিত্র আপলোড করি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। তবে স্নাতকোত্তরে থাকতেই এমন চিন্তা আসে। যখন নেদারল্যান্ডসে আসি, আমার সুপারভিশনে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা শিখে, তখন আমার মনে হয় আমি আমার দেশের শিক্ষার্থীদেরও গবেষণা সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে পারি। ভাবলাম, আমার ফেসবুকে রিসার্চ আর্টিকেল মজার গল্পের মতো করে বাংলায় লিখে পোস্ট করব। কিন্তু আমার ছোটভাই বলল, ‘ফেসবুকে রিসার্চ পেপার পড়ার মতো মানুষ পাওয়া কষ্টকর হবে, তুমি বরং ভিডিও বানানো শুরু করো।’ সেখান থেকেই ভিডিওচিত্র শুরু। সব সময় চেষ্টা করি এমন বিষয় খুঁজে বের করতে, যাতে করে সাধারণ মানুষ উপকৃত হন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষক হওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়।

ক্ষতিকর প্রভাবের পাশাপাশি সমাধান এবং উপকারের দিকগুলোও আলোচনা করা প্রয়োজনীয় নয় কি?

আমি বিভিন্ন ক্ষতিকর জিনিসের প্রভাব সম্পর্কে ভিডিও তৈরি করতে বেশি পছন্দ করি সেটা ঠিক। আমার মাস্টার্সের অধিকাংশ পড়াশোনা ছিল টক্সিকোলজির ওপর। তবে আমি অনেক জিনিসের উপকার দিকগুলো নিয়েও ভিডিও তৈরি করেছি, ভবিষ্যতে আরো করার পরিকল্পনা আছে। সমস্যাগুলোর সমাধানের ব্যাপারে আমি আলোচনা করি না এ রকম মনে হতে পারে, কিন্তু লক্ষ করলে দেখবেন, প্রায় সব ভিডিওর শেষে আমি সমাধানের কিছু পথ উল্লেখ করি। শুরুর দিকের ভিডিওগুলোয় তেমন গুরুত্ব দিতাম না বলে হয়তো সেগুলোয় সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা কম হতো। কিন্তু ইদানীং সব ভিডিওতেই সমস্যার সঙ্গে সমাধানের পথ নিয়েও আলোচনা করি। আমার ভিডিওচিত্র দেশের দায়িত্বশীল সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসতে শুরু করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গবেষণামুখী করতে সহায়ক?

আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব উপাদান এবং কার্যক্রম দরকার, তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ইদানীং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এই দিকটায় নজর দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা গবেষণার প্রাথমিক ধারণা পাচ্ছেন ব্যাচেলরের শেষ বর্ষে গিয়ে, যখন থিসিস করতে হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় থিসিসটাও কোনো রকমে শেষ করা হয়। সম্পূর্ণ থিসিস শেষ করে জমা দেওয়া পর্যন্ত কখনো কোনো জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার আর্টিকেল পড়তে হয়নি এ রকম শিক্ষার্থীও পাবেন। এর অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে।

কারণগুলো কী কী?

প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থা গবেষণানির্ভর করার প্রয়োজনীয়তা অতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। প্রায় সব ক্ষেত্রে আমাদের পড়াশোনার প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে পরে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করা। দু-একটা ছাড়া, দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের জন্য গবেষণা জানা বা গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি না। অথবা দেশে গবেষকদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে এ রকম প্রতিষ্ঠান খুবই কম। এই জায়গাগুলো যদি না থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষক তৈরি করার প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা বোধ না করাও অস্বাভাবিক নয়। আমি মনে করি, দেশে গবেষকদের কর্মসংস্থানের অভাব বা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অভাব এ ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। দ্বিতীয়ত, দেশে যথেষ্ট কর্মসংস্থান না থাকলেও বিদেশে তো আছে। ইচ্ছা থাকলে সেই উপায় বের করে নেওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এই ইচ্ছাটা জাগবে কী করে? যদি কারিকুলামে গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে কার্যক্রমের অভাব থাকে।

আর শিক্ষার্থীদের ভেতর আগ্রহ তৈরি হলে কর্মসংস্থান একসময় কোনোভাবে তৈরি হয়ে যাবে। তার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গবেষণামুখী করা খুব জরুরি। এই পরিবর্তনটা আস্তে আস্তেও করা সম্ভব, যদি দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছা থাকে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি, স্নাতকে প্রতি সেমিস্টারে একটা করে গবেষণার কোর্স যুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে যেখানে শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে গবেষণা কেন এবং কীভাবে করা হয়। যে ফিল্ডের গবেষণা ভালো লাগবে, সেই ফিল্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানবে পরের সেমিস্টারে। এই ফিল্ডে বর্তমানে গবেষকরা যেসব আর্টিকেল প্রকাশ করছেন, কেন করছেন এবং কীভাবে করছেন, সেগুলো সম্পর্কে জানবে। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে যেসব স্কিল দরকারি, সেগুলো সম্পর্কেও জানবে। প্রতি কোর্সে অবশ্যই ব্যবহারিক থাকতে হবে, যেখানে হাতে-কলমে কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার প্র্যাকটিস করবে।

গবেষণার প্রতি আগ্রহী তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ?

যে ফিল্ডের গবেষণা ভালো লাগবে, সেই ফিল্ডে নিত্যনতুন যেসব গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশিত হয়, সেগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে। কীভাবে সেই প্রশ্ন আসতে পারে, গুগলের মতোই পাবমেড (pubmed) নামে আরেকটি সার্চ ইঞ্জিন আছে, সেখানে পছন্দের বিষয় লিখে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে অনেক আর্টিকেল। কিছু আর্টিকেল সাবসক্রিপশন ছাড়া পড়া যায় না, সে ক্ষেত্রে আর্টিকেল টাইলেট কপি করে আরেকটা সাইটে (Sci-hub) নিয়ে পেস্ট করলে পড়া যাবে আরো অনেক আর্টিকেল। পড়াশোনা ভালোমতো করার পাশাপাশি সৃজনশীল কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে হবে, যা পরে দেশে অথবা বিদেশে রিসার্চভিত্তিক মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হতে সাহায্য করবে। সম্ভব হলে দেশে যারা গবেষণা করেন, তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা যায়। আর বিদেশে পড়তে আগ্রহী হলে স্নাতক শেষ বর্ষে উঠেই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত