দুবারই সবার সেরা

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ১২

প্রসেনজিৎ কুমার সাহা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন।

পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন প্রসেনজিৎ কুমার সাহা। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যে উচ্ছ্বাস, আনন্দ থাকে ছাত্রছাত্রীদের, সেটি তার হয়নি। একে তো পুরান ঢাকায় যানজট লেগে থাকে, তার ওপর বাড্ডায় এক মেসে থাকতেন। সেখান থেকে আসা-যাওয়ার কষ্ট খুব। আর বেড়ে উঠেছেন তিনি পাবনায়, একেবারেই শান্ত ও নিরিবিলি একটি শহর। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং হতো, ভয় সেখানেও ছিল। এ জন্য প্রথম ছয় মাস ক্যাম্পাসের বাসে আসা-যাওয়া করেননি। তারপর এক বড় ভাই পরিচিত হলেন, তার সঙ্গে চলাফেরা করতেন বাসে। র‌্যাগিংয়ের ভয় কেটে গেল। পাবনা, মা-বাবার জন্য মন কেমন করত। জ্যামের, ঘিঞ্জি শহরের মায়া ত্যাগ করে বাড়িতে চলে যেতেন। সেখানে বসে বসে ভাস্কর্য বানাতেন। তাতে ক্লাস মিস হতো। অধ্যাপকরা ডেকে জিজ্ঞেসও করতেন, কী প্রসেনজিৎ তোমার ক্লাস মিস হয় কেন? উত্তর দিতেন— স্যার, ঢাকা শহর আমার ভালো লাগে না। তারপর তারা তাকে পড়ালেখা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার গুরুত্ব বোঝাতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে শ্রেণিকার্যক্রম সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হলো।

প্রসেনজিৎ চারুকলা অনুষদের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র। তাদের শুরুর বছরে কোনো বিভাগ ছিল না চারুকলায়। অনুষদও হয়নি। তিনি ভাস্কর্য বানাতে ভালোবাসেন। কিন্তু সেই সুযোগ তো এখানে নেই। স্বাভাবিকভাবে মন টানত না। ফলে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে তারা বিভাগ তৈরি করতে আন্দোলন শুরু করলেন। শ্রেণিকক্ষে তালা লাগালেন, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। ফলে তিনটি বিভাগে ভাগ হলেন তারা। তৃতীয় বর্ষে উঠে আলাদা বিভাগ হলো চারুকলার, অনুষদ হয়ে গেল বিভাগটি। ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিংস, প্রিন্ট মেকিং ও স্কাল্পচার বিভাগ হলো। তিনি চলে এলেন প্রিয় স্কাল্পচারে। দ্বিতীয় বর্ষেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন। দ্বিতীয় বর্ষে থাকার সময় থেকে আর বাড়িতে যেতেন না। প্রথম বর্ষে শ্রেণি উপস্থিতি কম বলে নম্বরও কম পেয়েছেন। প্রথম হওয়ার তার এই জীবনে দুর্বলতা আরো আছে। সেটি হলো প্রসেনজিতের হাতের লেখা। শিল্পীদের হাতের লেখা ভালো হয়, কিন্তু তার হাতের লেখা খারাপ। এই কারণে প্র্যাকটিক্যালে সর্বোচ্চ নম্বর পেলেও থিওরেটিক্যালে নম্বর কম পেতেন। এসব নিয়ে কোনোভাবেই ভাবতেন না। কেননা, তার ফলাফল কোনোকালেই সর্বোচ্চ ছিল না। লেখাপড়া ও শিল্পীর জীবনের প্রতি আগ্রহটি গড়ে দিয়েছেন তাদের অনুষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন সুমন। তিনি ছেলের মমতায় ছাত্রটিকে ভালোবেসেছেন ও তার সব সমস্যা দূর করতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি তার পড়ালেখা ফেলে বাড়িতে চলে যাওয়াও ঠেকিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষাগুরুর কাছে নানা কারণে ঋণী ছাত্র। তার ভালোবাসা ও নিজের চেষ্টায় সবার সেরা হয়েছেন। ফাইনাল ইয়ারে তিন বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিজিপিএ লাভ করেছেন প্রসেনজিৎ।

ক্যাম্পাস লাইফে আড্ডাবাজিতে খুব কম সময় দিয়েছেন। স্যারদের কাছে সব সময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকতেন। তাদের কাজে সাহায্য করতেন। সিনিয়রদের কাজে সাহায্য করতেন মিস্ত্রির মতো। তাদের এই সাহায্য করার কারণে নিজেরও শেখা হতো। এ বিষয়ে জানালেন, আমার যেহেতু স্কিল আছে, মূর্তি বানিয়ে অভ্যাস, ফলে কোনো সমস্যা হতো না। এর মাধ্যমে শিখে নিতাম। কেননা, কাজ করলেই সবচেয়ে ভালো শেখা হয়। এ জন্যই সবার কাজ বেশি বেশি করে দিতাম। আমার ক্লাসের যে সেকেন্ড বয়, আশিকÑ আমার ক্লোজ বন্ধু; তাকেও কাজে হেল্প করতাম। আবার নিজের কাজও করতাম। আমি সবাইকেই হেল্প করতাম। এটি আমার একটি টেকনিক ছিল, মানুষকে যত বেশি হেল্প করব, তত বেশি নিজে ডেভেলপ করব প্র্যাকটিক্যালে।

ইমাম হোসেন সুমন তার মধ্যে বইয়ের প্রতি আগ্রহও গড়ে দিয়েছেন। প্রথম বর্ষে যখন যেতেন স্যারের কাছে, মনে আছে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতো করে বইয়ের নাম লিখে দিতেন। এরপর যখন স্যারকে পছন্দ হয়ে গেল, তার দেওয়া লিস্টের বই কিনলেন ও পড়তে শুরু করলেন। এরপর পড়ার জন্য তার আর কারো সাহায্য নিতে হয়নি। নিজের রুচি ও পছন্দ গড়ে উঠেছে এবং একের পর এক বই পড়তে শুরু করলেন। ধীরে, ধীরে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠল। এমনও সময়কাল গিয়েছেÑ সারা দিন কাজ করে বাসায় ফিরে দুই ঘণ্টা অন্তত বই পড়েছেন। না পড়লে এখনো তার ভালো লাগে না।

খুব ভালো ড্রয়িং করতে পারেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তাদের কাজ দেখে, দেখে খুব অনুশীলন করেছেন। নিজের একটি স্বকীয়তাও তৈরি হয়েছে এভাবে। বিরাট, বিরাট শিটে ড্রয়িং করেছেন। কাজগুলো সুমন স্যারকে দেখাতেন। তিনি আবার অন্যদের দেখাতেন ও নানা পরামর্শ দিতেন। তাদের কাছ থেকে শিখেছেন প্রচুর। প্রথম বর্ষ থেকেই ওপরের সেমিস্টারগুলোর ছাত্রছাত্রীদের মডেল দেখে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এ কারণেও বিভাগের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রসেনজিৎ কুমার সাহা এভাবেই অনার্সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অনার্সে সবার সেরা হয়েছেন। তার গড় সিজিপিএ হলোÑ ৩.৫৪। মাস্টার্সেও সবার সেরা হয়েছেন, ৩.৮৫ সিজিপিএ নিয়ে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত