পিলখানা গণহত্যার পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ জানিয়েছিলেন, সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারত এবং সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে যেত। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না এবং ভারতের কাছে নিরাপত্তা সহায়তা চেয়েছিলেন।
ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা ঢাকায় অবতরণ করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো নিরাপদ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। মইন উ আহমেদ জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনে প্রদত্ত সাক্ষ্যে গবেষক অভিনাশ পালিওয়ালের প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে এসব কথা বলেন এবং উক্তিগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব (বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা) তৌহিদ হোসেন নিশ্চিত করেছেন, জেনারেল মইনকে বলপ্রয়োগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পিলখানায় সংঘটিত বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
জেনারেল মইন বলেন, তিনি ‘উড়া উড়া’ খবর পাচ্ছিলেন, সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। যদি ভারতীয় বাহিনী আসত, তাহলে তাদের আর ফেরত যাওয়া সম্ভব হতো না। এবারের ঘটনা ঘটলে ‘থিংস উড হ্যাভ বিন ডিফারেন্ট’ হতো এবং তা আমাদের জন্য ‘উড হ্যাভ বিন ভেরি ভেরি ব্যাড’ হতো। তিনি জানান, গবেষক অভিনাশ পালিওয়াল এ বিষয় নিয়ে দুটি আর্টিকেল লিখেছেন।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের (এসওএএস) শিক্ষক অভিনাশ পালিওয়াল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়াজ নিয়ার ইস্ট : এ নিউ হিস্ট্রি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হাসিনা নিজেকে হুমকির মুখে মনে করছিলেন এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না। সান্ধুর স্মৃতিতে আছে, তিনি ভারতের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। আর সে কারণে আমরা ঢাকায় অবতরণের পর যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থেকে নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলাম।
পিলখানা তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ হাসিনা দিল্লিতে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র কংগ্রেস নেতা ও সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে ফোন করেন। পরিস্থিতি শুনে মুখার্জি সাড়া দেওয়ার আশ্বাস দেন। ঢাকার পক্ষ থেকে পাঠানো এই ‘এসওএস’ বার্তাই প্যারাট্রুপার মোতায়েন শুরু করে এবং পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেননকে দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও চীনের দূতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাসিনার পক্ষে সমর্থন আদায়ে তৎপর হতে উদ্বুদ্ধ করে।
কালাইকুণ্ডা ছাড়াও যোরহাট ও আগরতলায় প্যারাট্রুপারদের মোতায়েন করা হয়েছিল। আদেশ পাওয়া গেলে তিন দিক থেকেই ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশে প্রবেশ করত। লক্ষ্য ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) এবং তেজগাঁও বিমানবন্দর নিরাপদ করা। এরপর প্যারাট্রুপাররা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নিত এবং হাসিনাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিত। অভিযানের তত্ত্বাবধানে থাকা ব্রিগেড কমান্ডার সক্রিয় যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ‘ফার্স্ট লাইন’ গোলাবারুদ বিতরণ শুরু করেন।
অভিনাশ পালিওয়াল বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি দিয়েছেনÑযিনি বলেছিলেন, আমরা কিছু বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছিলাম এবং হাসিনাকে জানিয়েছিলাম, তার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
পালিওয়াল একই গ্রন্থে তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যিনি বলেছেন, ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে আমি জেনেছি জেনারেল মইনকে বলা হয়েছিল বলপ্রয়োগ না করতে; নইলে এক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকায় ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা নামবে।
জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের লিখিত প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, পালিওয়ালের বইয়ে যে বাক্যটি উদ্ধৃত হয়েছে, তা সঠিক। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় আমি কলম্বোতে সার্ক বৈঠকে অংশ নিচ্ছিলাম। কয়েক মাস পর যখন আমাকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল; তখন ক্ষমতার কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ একজনকে আমি অনায়াসে জিজ্ঞেস করিÑসেনাপ্রধান কেন তার কর্মকর্তাদের বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি আমাকে ঠিক সেটাই বলেন, যা আমি পালিওয়ালকে বলেছিলাম।

