আড়াই দিনের বন্দিদশা নিয়ে শহিদুল আলম

আড়াই দিনের বন্দিদশা ও গাজা নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা জানালেন শহিদুল আলম

আফসানা খানম আশা
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ১১

প্রায় আড়াই দিন ইসরাইলি বাহিনীর কাছে বন্দি থাকার পর মুক্ত হয়ে আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) ভোরেদেশে ফিরেছেন দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে আজ বিকেলে রাজধানীর দৃক পাঠ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আটক হওয়া থেকে শুরু করে বন্দি থাকার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন তিনি।

আলোচিত এই অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, প্রায় ৫০ জনের মতো ইসরাইলি সৈন্য তাদের ফ্লোটিলায় নেমেছিল। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নারীও ছিল। তবে তাদের প্রত্যেকের কাছে আলাদা রকমের মেশিনগান ছিল, স্নাইপার বুলেট, লেজার বুলেটও ছিল।

বিজ্ঞাপন

ইসরাইল বাহিনী তাদের ওপর নানা রকম অত্যাচার করেছে, তার মধ্যে মানসিক অত্যাচার বেশি করা হয়েছে। তাদের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে প্রায় ২ ঘন্টার মতো হাঁটুমুড়ে বসানো হয়েছিল। আর যেখানে বসানো হয়েছিল, সেই স্থানে ইসরাইলি বাহিনী আগে থেকে মূত্রত্যাগ করেছিল। এরপর তারা (ইসরাইলি বাহিনী) তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ফেলে দেয়। তিনি যতবার সেটি তুলেছেন ততবার তার ওপর চড়াও হয়েছে। এটা ছিল তার জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক।

শহিদুল আলম আরো বলেন, সেসময় নিজেদের মধ্যে কথা বলায় অন্য দুজন সহযাত্রীকে মেশিনগানের ব্যারেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।

এছাড়াও জেলের ভেতরে আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি টি-শার্ট পরা ছিল বলে তাকে হামাসের সমর্থক দাবি করে তাকে গুলি করে মারারও হুমকি দেওয়া হয়েছে।

শহিদুল আলম জানান, মরুভূমির মধ্যে ইসরাইলের সবচেয়ে গোপন কারাগারে তাদের রাখা হয়। সেখানে অন্য জাহাজ থেকে আটক হওয়া আরেকজন সহযাত্রী তাকে জানান, ইসরাইলি বাহিনী ওই ব্যক্তিকে আটক করার পর বলেছিল, ‘তুমি হামাসের এজেন্ট, ভেতরে নিয়ে তোমাকে গুলি করা হবে।’

শহিদুল আলম আরও বলেন, কারাগারে তারা অনশন করেছিলেন। কোনো খাবার খাননি। তবে শারীরিক দুর্বলতার কারণে কয়েকজন খাবার খেয়েছেন। আড়াই দিনে তাদের মাত্র এক প্লেট খাবার দেওয়া হয়। ঘুমানোর জায়গা ছিল না, লোহার বিছানায় শুতে দেওয়া হতো। আর শৌচাগারগুলোর অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

তিনি আরও বলেন, গভীর রাতে হঠাৎ করে ইসরাইলি বাহিনী মেশিনগান নিয়ে সেলের মধ্যে ঢুকে যেত। তারা জোরে আওয়াজ করত, চিৎকার করে দাঁড়ানো বা অন্য আদেশ দিত এবং আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করত।

ছাড়া পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের চিফ অ্যাডভাইজর (প্রধান উপদেষ্টা) ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেভাবে সাড়া দিয়েছেন, শক্তিশালী ও জোরালো ভূমিকা রেখেছেন, তা ছিল অসাধারণ। কারণ সেখানে অনেক সহযাত্রীর বাঘা বাঘা দেশগুলোর নেতারা কিছু বলেননি।‘

আটক হওয়ার মুহূর্তের কথা শেয়ার করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই ছক একে একে সব প্ল্যান করছিলাম। আর আমরা ঠিক করেছিলাম যখন ইসরাইল আমাদের ফ্লোটিলা দখল করবে ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা আমাদের ল্যাপটপ, ফোন সব পানিতে ফেলে দিব। যাতে করে কোনো রকম ইনফরমেশন আমাদের কাছ থেকে না পায়। এবং আমরা তাই করেছি। তাই আড়াই দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু ইসরাইলে আমাদের পক্ষ থেকে উকিল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, প্রত্যেকের ছবি, ঠিকানা তাদের দেয়া ছিল। তারাও একটা বিশাল ভূমিকা রেখেছে।‘

এ সময় একজন সাংবাদিক পরবর্তী পরিকল্পনা জানতে চাইলে শহিদুল আলম বলেন, ‘অসাধারণ কিছু ব্যক্তি একসঙ্গে হওয়ার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমরা এখন আন্তর্জাতিকভাবে একটা নেটওয়ার্ক দাঁড় করাব। যেহেতু গ্লোবাল লিডাররা করবে না, আমরা অ্যাকটিভিস্টরা কীভাবে করতে পারি সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। একটা খসড়া আমরা করে রেখেছি এবং আমরা ফেরার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আবার আমরা যাব এবং হাজারটা জাহাজ যাবে।’

দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমাদের দেশে যেটা করেছি জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাস্তায় নেমেছি, আন্দোলন করে এ রকম একজন স্বৈরাচারকেও আমরা হঠাতে পেরেছি। এখানেও সেই জিনিস, আন্তর্জাতিকভাবে সেরকম একটা জিনিস করা দরকার।’

গাজাগামী যাত্রা প্রসঙ্গে মিডিয়া ও সকলের উদ্দেশ্যে ড. শহিদুল আলম বলেন, ‘আমি গিয়েছি কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমি আপনাদেরকে সাথে নিয়ে গিয়েছি। যেভাবে আপনারা সমর্থন করেছেন, যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, সেটা অসাধারণ। বাংলাদেশ যেভাবে সাড়া দিয়েছে এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে বাংলাদেশ দেখিয়েছি যে আমরা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারি।’

সবশেষে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উদ্দেশে ড. শহিদুল আলম বলেন, ‘এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জন্য। আপনারা নিশ্চয়ই দেখছেন। প্রথমত, আমার বলা উচিত ‘শেইম অন ইউ’। ‘শেইম অন ইউ’ কারণ আপনারা (পশ্চিমা গণমাধ্যম) গণহত্যার সাথে জড়িত। ‘শেইম অন ইউ’ কারণ আপনারা (পশ্চিমা গণমাধ্যম) গণহত্যায় সহায়তা করছেন এবং মদদ দিচ্ছেন। এবং ‘শেইম অন ইউ’ গাজাগামী এই ফ্লোটিলায় যোগ না দেয়ার জন্য, অথচ এটি একটি প্রমাণ করার সুযোগ ছিল যে আপনারা ভিন্ন। তবে ভবিষ্যতের ফ্লোটিলাগুলিতে যোগদান করা, আপনাদের এই আচরণের পরিবর্তন, নিজেদের অবস্থানের পুনর্নির্মাণ করা এবং ইতিহাসে সঠিক পক্ষে থাকার সুযোগ এখনও আছে।’

প্রসঙ্গত, এই দুঃসাহসিক যাত্রায় যোগ দিতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ঢাকা ছেড়েছিলেন ড. শহিদুল আলম। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ এ ইতালি থেকে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনে'র (এফএফসি) উদ্যোগে ‘কনশেন্স’ জাহাজে চড়ে প্রায় ১০০ জনসহ গাজার অভিমুখে রওনা হন। গত বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫, ভূমধ্যসাগরে গাজাগামী ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের জাহাজগুলো আটক করে ইসরাইলি বাহিনী। সেখান থেকে শুরুতেই অপহৃতদের ইসরাইলের আশদদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে দেশটির কেৎজিয়েত কারাগারে বন্দী রাখে ইসরাইলি বাহিনী। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় তুরস্ক হয়ে আজ শনিবার ভোরে ঢাকায় পৌঁছান তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত