বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস আজ

বছরে তামাকের বলি দেড় লাখ মানুষ

এমরানা আহমেদ
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৫, ০৬: ১৫

মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তামাক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটির ব্যবহার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি বছর তামাকের বলি হয়ে মারা যাচ্ছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরো কয়েক লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় চার কোটির মতো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবনের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।

সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর তামাক ব্যবহারকারী দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার করে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বে এ সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। এই বয়সিদের মধ্যে ধূমপানের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ।

বিজ্ঞাপন

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) জানায়, সিগারেটের ধোঁয়ায় সাত হাজারেরও বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক রয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি ক্যানসার সৃষ্টি করে। ১৫ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে চার লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে ৬১ হাজারের অধিক শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। পরোক্ষ ধূমপানে দেশে প্রায় ২৬ হাজার অধূমপায়ী মারা যায়। এদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। এমন পরিস্থিতিতে তামাকের পরোক্ষ ক্ষতি থেকে অধূমপায়ী বিশেষ করে শিশু ও নারীদের রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি।

এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যু ও ব্যাধির উৎসমূল হওয়া সত্ত্বেও নানা কূটকৌশলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। এ ধরনের কোম্পানির সব কূটকৌশলের স্বরূপ উন্মোচনের উদ্দেশ্যে এবারের ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২৫’-এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর যেসব দেশে সস্তায় সিগারেট পাওয়া যায়, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কম দামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কম দামি সিগারেটের দ্বিগুণেরও বেশি।

তামাক নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, বর্তমানে দেশে তামাকপণ্যের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে, যার হার ৩৫ শতাংশের বেশি। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তারা বলছে, তরুণ প্রজন্মই তামাক কোম্পানির প্রধান টার্গেট। এক প্রজন্মের তামাকসেবী যখন মৃত্যুবরণ করে কিংবা ঘাতক ব্যাধির প্রকোপে তামাক সেবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তামাক কোম্পানির জন্য তখন নতুন প্রজন্মের তামাকসেবী তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তখনই কোম্পানিগুলো সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো এবং সুপারশপসহ বিভিন্ন দোকানিকে অর্থ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সিগারেটের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেয়। তরুণরাই তামাক কোম্পানির আগ্রাসী বিজ্ঞাপনের প্রধান টার্গেট। তাদের মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা তামাকপণ্য সেবনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে তারাই পরিণত হয় তামাক কোম্পানির আমৃত্যু ভোক্তায়।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগের তামাক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় কেন্দ্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, বাংলাদেশে এই ব্যাপক মৃত্যুর দায়ভার তামাক কোম্পানি কখনোই স্বীকার করে না। তামাকজনিত মৃত্যু আড়াল করতে এবং ব্যবসা বাড়াতে নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে তারা। তরুণ প্রজন্মের সুরক্ষায় তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করার দাবি জানান তিনি। একই সঙ্গে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের নিম্ন এবং মধ্যম স্তরকে একত্র করে মূল্যস্তরের সংখ্যা চারটি থেকে তিনটিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেন তিনি।

তামাকবিরোধী গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশে তামাকপণ্য অত্যন্ত সস্তা এবং নিত্যপণ্যের তুলনায় এগুলো আরো সস্তা হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী ও কার্যকর করা, মূল্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়ন জরুরি।

অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স আত্মার পক্ষ থেকে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের নিম্ন এবং মধ্যম স্তরকে একত্র করে প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ৯০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। সংগঠনটি বলছে, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে স্বল্পআয়ের ধূমপায়ীরা ধূমপান ছাড়তে বিশেষভাবে উৎসাহিত হবে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম ধূমপান শুরু করতেও নিরুৎসাহিত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতা শুধু এসডিজির তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রেই বাধা নয়; বরং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনেও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।

তিনি বলেন, তামাক চাষে বছরে ব্যবহৃত হয় এক লাখ একরের বেশি জমি, যা দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির (লক্ষ্যমাত্রা-২) জন্য ক্রমশ হুমকি তৈরি করছে।

ড. রুমানা হক আরো বলেন, প্রতি বছর জাতীয় বাজেটকে প্রভাবিত করতে সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনকে ব্যবহার করে থাকে। মালিকদের অর্থায়নে বিড়ি শ্রমিকরা মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে বিড়ির মূল্য না বাড়ানোর আন্দোলন করেন। এ ছাড়া সুবিধাভোগীদের দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কলাম ও নিবন্ধ প্রকাশ, ডিও লেটার দেওয়া ইত্যাদি কূটকৌশল অবলম্বন করে কোম্পানিগুলো।

বিষয়:

তামাক
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত