গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন

সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে প্রচার সংখ্যায় অতিরঞ্জন

এমরান এস হোসাইন
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২: ১৯
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২: ২৩
ফাইল ছবি

ঢাকা শহরে প্রতিদিন তিন লাখ ২০ হাজারের মতো দৈনিক পত্রিকা বিক্রি হয়। সারা দেশে এই সংখ্যা ১০ লাখের কম। অথচ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মিডিয়া লিস্টে থাকা পত্রিকাগুলোর ঘোষিত প্রচারসংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি।

ঢাকা শহরে ডিএফপির মিডিয়া লিস্টভুক্ত পত্রিকার সংখ্যা ২৮৪টি হলেও হকারদের মাধ্যমে ৬০টির কম পত্রিকা বিক্রি হয়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তি এবং কম শুল্কে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে বেশির ভাগ পত্রিকা তাদের প্রচার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখায়। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল পত্রিকাগুলো নানা তৎপরতায় প্রচারসংখ্যা অতিরঞ্জিত করে থাকে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কামাল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গত ২২ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

গণমাধ্যম কমিশনের তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে পত্রিকা বিলির দায়িত্বে থাকা দুটি হকার সমিতি- সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড ও ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের দুটি একক দিনের পত্রিকার চাহিদা, বিক্রীত কপি ও ফেরত কপির রসিদ তথ্য জমা দিয়েছে।

একটি সমিতির রসিদ গত বছর ৭ অক্টোরের, অপরটি ৯ নভেম্বরের। এতে ৫২টি দৈনিক পত্রিকার চাহিদা ও বিক্রির তথ্য কমিশনকে সরবরাহ করা হয়েছে। দুটি সমিতির মধ্যে একটিতে পত্রিকার সংখ্যা অন্যটির তুলনায় ৪-৫টি কম। তাদের তথ্য অনুযায়ী কম-বেশি ৫৬টি দৈনিক পত্রিকা তারা বিক্রি করে থাকে। সমিতির দৈনিক চাহিদা তিন লাখ ৪৫ হাজার ৪৬ কপি। এর মধ্যে বিক্রি হয় তিন লাখ ২০ হাজার ২০৪ কপি। তিন হাজার কপির মতো পত্রিকা প্রতিদিন ফেরত দেওয়া হয়। ২০টির মতো বিক্রি সংখ্যা দৈনিক হাজারেরও কম।

ঢাকা শহরে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে প্রথম আলো, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। প্রথম আলো দুটি হকার সমিতির কাছে মোট ৮৪ হাজার ৪৮০ কপি পত্রিকা সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ৮৩ হাজার ৩২০ কপি। বাংলাদেশ প্রতিদিন ৬৯ হাজার ৬৩০ কপির মধ্যে ৬৮ হাজার ৩৪৫ কপি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য পত্রিকার মধ্যে যুগান্তরের ১৭ হাজার ১২ কপি; কালবেলার ৯ হাজার ৮৩৩ কপি; ইত্তেফাকের ৯ হাজার ২৬৩ কপি; আমাদের সময়ের ১১ হাজার ৮৮ কপি; নয়া দিগন্তের সাত হাজার ৯৪৩ কপি; সমকালের আট হাজার ৮৮০ কপি; দেশ রূপান্তরের সাত হাজার ২৭৬ কপি; কালের কণ্ঠের ছয় হাজার ৮৬৩ কপি; সময়ের আলোর ছয় হাজার ৫৮৭ কপি; বণিক বার্তার ছয় হাজার ৩৭৫ কপি; প্রতিদিনের বাংলাদেশের চার হাজার ২৬৮ কপি; জনকণ্ঠের তিন হাজার ৩৫০ কপি; মানবকণ্ঠের এক হাজার ৭৮২ কপি; আজকের পত্রিকার চার হাজার ১৯৯ কপি; ইনকিলাবের দুই হাজার ৯৩৫ কপি; সংবাদের এক হাজার ৩ কপি; সংগ্রামের এক হাজার ২৮৪ কপি; মানবজমিনের পাঁচ হাজার ৬৩১ কপি; খবরের কাগজের সাত হাজার কপি; আজকালের খবরের ৩৪৫ কপি; যায়যায়দিনের ৭১৭ কপি; ভোরের কাগজের ৮৯৬ কপি; আলোকিত বাংলাদেশের ৩১৫ কপি; প্রতিদিনের সংবাদের ৬৯৯ কপি; খোলা কাগজের এক হাজার ৮৩০ কপি; ভোরের ডাকের এক হাজার ৫৭০ কপি ও দৈনিক বাংলার এক হাজার ৭৪ কপি বিক্রি হয়েছে।

ইংরেজি দৈনিকের মধ্যে ডেইলি স্টারের ১৮ হাজার ৮১১ কপি; দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ছয় হাজার ৪৪৮ কপি; ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের তিন হাজার ৬৬৯ কপি; নিউএইজ-এর এক হাজার ১৭০ কপি; ঢাকা ট্রিবিউনের এক হাজার ১৫৬ কপি; অবজাবভারের ৭২১ কপি; ডেইলি সানের ৭০২ কপি এবং এশিয়ান এজ-এর ২৮৫ কপি বিক্রি হয়েছে।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন যে সময়ের তথ্য হকার সমিতির থেকে সংগ্রহ করেছে ওই সময় আমার দেশ বন্ধ ছিল। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার অবৈধভাবে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় সাড়ে ১১ বছর পত্রিকাটি বন্ধ থাকার পর গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী নিবন্ধিত পত্রিকার সংখ্যা এক হাজার ৩৪০টি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ৫৪৬টি এবং ঢাকার বাইরে থেকে ৭৯৪টি। ঢাকায় সাপ্তাহিক পত্রিকা ৩৫৫টি। ঢাকার বাইরে ৮৬৩টি। সব মিলিয়ে পত্রিকার সংখ্যা তিন হাজার ২৭০টি। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে এক হাজার ৩৭১টি। ঢাকার বাইরে এক হাজার ৮৯৮টি। তবে এর মধ্যে কতটি নিয়মিত প্রকাশিত হয় তা নিয়ে গণমাধ্যম কমিশন সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

২০২৪ সালের আগস্টের তথ্য অনুযায়ী ডিএফপির মিডিয়া লিস্টভুক্ত দৈনিকের সংখ্যা ৫৮৪টি। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রিক ২৮৪টি। এ তালিকায় রয়েছে ৮৭টি সাপ্তাহিক, ১২টি পাক্ষিক, ২৪টি মাসিক ও একটি ত্রিমাসিক। ঢাকায় সব ধরনের পত্রিকা দুটি হকার সমিতির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। তাদের রসিদে ৫৬টির বেশির নাম পাওয়া যায় না বলে কমিশন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

গণমাধ্যম কমিশন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, অনেক দৈনিক পত্রিকা নিবন্ধিত হলেও তারা শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। লাভজনক পরিমাণে বিজ্ঞাপন পেলে সেদিন সীমিত সংখ্যায় পত্রিকা ছাপা হয়, অন্যান্য দিন হয় না। যখন যে প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয় সে প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারি কিছু দপ্তরে এসব পত্রিকার কপি পৌঁছে দেওয়া হয়।

এমন কিছু পত্রিকারও সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলো শুধু পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে হুবহু একই কাঠামোতে ছাপা হয়। এসব পত্রিকার বেশির ভাগের নাম পাঠক কখনো শোনেনি। এ ছাড়া কিছু পত্রিকা হাতেগোনা কয়েক কপি ছেপে সরকারি দপ্তর ও যাদের নিয়ে বিশেষ সংবাদ করা হয় তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই পত্রিকাগুলো দেয়াল পেস্টিং পত্রিকা ও আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা নামে পরিচিত। আবার ডিএফপির তালিকাভুক্তি নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

কমিশন বলেছে, সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা নিয়ে বিতর্কের মূলে রয়েছে এটিকে বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা, যা প্রায় একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর মূলত দুটি- বিজ্ঞাপনের জন্য বাড়তি দর আদায় এবং কম শুল্কে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল পত্রিকাগুলো যে কোনো উপায়ে প্রচারসংখ্যা অতিরঞ্জিত করতে তৎপর হয়। পাশাপাশি, বেশি প্রচারসংখ্যা দেখালে আমদানির ক্ষেত্রে কিছু শুল্কছাড় মেলে, যা বাড়তি নিউজপ্রিন্ট খোলাবাজারে বিক্রি করে আয়ের সুযোগ তৈরি করে।

কমিশন জানিয়েছে, ডিএফপির মিডিয়া লিস্টে থাকা পত্রিকাগুলোর ঘোষিত প্রচারসংখ্যার যোগফল দৈনিক প্রায় পৌনে দুই কোটি। ডিএফপির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ৫৭টি দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন ১ লাখ বা তার বেশি কপি ছাপা হয়। কিন্তু ঢাকার দুটি হকার সমিতি এবং সারা দেশে বিতরণকৃত পত্রিকা বিক্রির হিসাবে সংখ্যা দৈনিক ১০ লাখের বেশি নয়। বাকি ১ কোটি ৭০ লাখ পত্রিকা কোথায় যায় এ নিয়ে কমিশনের প্রশ্ন রয়েছে। পুরোনো কাগজ কেনাবেচার ব্যবসায়ও এত বিপুল পরিমাণে অবিক্রীত কাগজ বিক্রির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলে না বলেও কমিশন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

কমিশন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ট্রাইব্যুনাল’ এর মিডিয়া তালিকভুক্তি, বিজ্ঞাপনের হার, প্রকাশিত সংখ্যাসহ সার্বিক বিষয় যাচাই করে পত্রিকাটি প্রচার সংখ্যায় শীর্ষ অবস্থানে থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। হকার সমিতির বিলের সঙ্গে পত্রিকাগুলোর ডিএফপির তালিকার কোনো মিল নেই বলে কমিশন উল্লেখ করেছে।

সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন মোহাম্মদ নোমান আমার দেশকে বলেন, আমরা অক্টোবর মাসে যে তথ্য সরবরাহ করেছিলাম মোটামুটি বিক্রি ও ফেরতের সংখ্যা কমবেশি সেটাই আছে। এর মধ্যে আমার দেশ বের হয়েছে। তাদের একটি ভালো সংখ্যায় বিক্রি হচ্ছে। আর আপনারা ভালোই জানেন হাতেগোনা ৮-১০টি পত্রিকারই বেশি বিক্রি হয়। বাকিগুলোর সংখ্যা বলার মতো নয়।

বেশির ভাগ পত্রিকার ঘোষিত প্রচার সংখ্যা সঠিক নয় বলে মনে করেন সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। আমার দেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার কারণে অনিয়ম করে প্রচার সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে দেখাচ্ছে। ডিএফপির ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকা থেকে যে পত্রিকা প্রকাশ হয় বলে বলা হয়ে থাকে সেটা সত্য হলে দুধের শিশুকেও পত্রিকা কিনে পড়তে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত