আঠারোর আগেই গর্ভধারণ করেন ৬৫ ভাগ নারী পোশাককর্মী

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬: ২৩

দেশে পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই ১৮ বছরের আগে গর্ভধারণ করছেন, যা উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) করা গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার প্রতিষ্ঠানটির সাসাকাওয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণার এ ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সেমিনারে আলোচক ছিলেন পপুলেশন কাউন্সিল বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক ড. উবাইদুর রব, বিকেএমইএর যুগ্ম সম্পাদক ফারজানা শারমিন এবং মেরী স্টোপস বাংলাদেশের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন এইচ আহমেদ।

আইসিডিডিআর,বির ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ড. রুচিরা তাবাসসুম নভেদের নেতৃত্বে ও গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহায়তায় ২০২২ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর কড়াইল, মিরপুর বস্তি ও গাজীপুরের টঙ্গী বস্তিতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আইসিডিডিআর,বি।

গবেষণায় পোশাক কারখানায় কর্মরত ১৫ থেকে ২৭ বছর বয়সি মোট ৭৭৮ শ্রমিকের সঙ্গে প্রতি ছয় মাস অন্তর জরিপের মাধ্যমে এই গবেষণাটি করা হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, নারী পোশাককর্মীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। তাদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই ১৮ বছর হওয়ার আগেই প্রথম গর্ভধারণ করেছেন। এছাড়াও প্রায় প্রতি তিনজনের একজন জীবনে অন্তত একবার অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছেন এবং প্রতি চারজনের একজনের গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

গবেষকরা জানান, গবেষণার শুরুতে ৪৯ শতাংশ নারী তৈরি পোশাকশিল্প শ্রমিকের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা ছিল, যা দুবছর শেষে ফলোআপ করার সময় দেখা যায় ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, জরুরি গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট সম্পর্কে জ্ঞানও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

নারী পোশাককর্মীরা ঘর ও কর্মস্থল দুই জায়গায়ই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গবেষণার শুরুতে প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, যা দুবছর পর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে।

গবেষণায় জানানো হয়, উদ্বেগজনক বিষয় হলোÑসহিংসতার শিকার নারীরা প্রায় কেউই আনুষ্ঠানিক সাহায্য চাইতে যান না। শুরুতে ৩৫ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক (পরিবার বা বন্ধুদের কাছে) সাহায্য চেয়েছিলেন; কিন্তু এই হার ক্রমশ কমে দুবছর শেষে দাঁড়ায় মাত্র ২১ শতাংশে। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনায়ও মাত্র প্রতি পাঁচজনের একজন নারী শুরুতে কর্তৃপক্ষকে সহিংসতার কথা জানিয়েছিলেন এবং দুবছর পর এসেও এই চিত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পোশাক কারখানাগুলোতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু পরামর্শমূলক সেবা থাকলেও দরকারি সরবরাহ সীমিত। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা যেসব কারখানায় কাজ করেন, তার মধ্যে শুধু ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়। এছাড়া মাত্র ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহের তথ্য মিলেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নারী পোশাককর্মীদের মধ্যে যারা অন্তত ৯ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তুলনামূলক বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন, তাদের কিশোরী বয়সে (১৫ থেকে ১৯ বছর) গর্ভধারণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। যারা সন্তান ধারণের আগেই গর্ভনিরোধক বড়ি/ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন, তাদের কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ কম পাওয়া গেছে।

সেমিনারে প্রধান গবেষক ড. রুচিরা তাবাসসুম নভেদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অবস্থা অন্য নারীদের চেয়েও খারাপ। পরিস্থিতি উন্নয়নের নিয়ামকগুলো নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা দরকার।’

ফারজানা শারমিন বলেন, ‘যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক, তাই নারীদের জন্য ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স ধরে রাখা বেশ কঠিন। গর্ভধারণের মতো বিষয়েও তাদের মতামতের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।’

ইয়াসমিন এইচ আহমেদ বলেন, ‘নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা এখনো দোকানে গিয়ে স্বল্পমেয়াদি জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী ক্রয় করতে পারেন না। তাই গার্মেন্টগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি সাধারণ জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে।’

ড. উবাইদুর রব বলেন, ‘নারীদের কর্মক্ষেত্র এখন কেবল পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ নেই। তবে যেখানেই কাজ করুক না কেন, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমাতে হবে। এজন্য কর্মীদের জ্ঞান বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত