কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলন। একদিকে সরকারের বল প্রয়োগ, অন্যদিকে ছাত্র জনতার অনড় অবস্থান। এর মধ্যেদিয়ে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের শাসন আমলের। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো আন্দোলন ঘিরে এতো প্রাণহানি ও রক্তপাতের ঘটনা দেখা যায়নি। কিন্তু এই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে ঠিক কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা, সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে গেজেট তৈরি করেছে, তাতে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৮৪৪ জন। গেজেটে যাদেরকে ‘শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে, এই আন্দোলন ঘিরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে নিহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে প্রায় ১৪০০ জন। সরকারের তালিকা ও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যায় এতটা পার্থক্য কেন সেটি নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। সরকারের হিসাব বলছে, আন্দোলনে নিহত যে ৮৪৪ জনের নামে গেজেট করেছে সেখানেও কারো কারো নাম একাধিকবার এসেছে। সে কারণে তালিকায় কাঁটাছেড়াও করতে হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেছেন, ‘গেজেট আকারে তালিকা প্রকাশের পর আমাদের কাছে অভিযোগও এসেছে। যেগুলো আমরা তদন্ত করছি। এমন কিছু নাম গেজেট থেকে বাতিল হচ্ছে।’ জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও সরকারের তালিকায় এই তফাৎ নিয়েও দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে।
জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে শুধু আন্দোলনকারী নয়, নিহত হয়েছিল পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও। কিন্তু সরকারি গেজেটে শুধু যুক্ত করা হয়েছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে নিহতদের নাম। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটিই শুধু একমাত্র কারণ নয়। একদিকে ভুয়া ব্যক্তিদের নামও যেমন সরকারি গেজেটে এসেছে, অন্যদিকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা অনেককে গেজেট তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
সরকারি গেজেটেও হচ্ছে কাঁটাছেড়া
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ গত বছরের ২১ ডিসেম্বর। সেই তালিকায় নিহতের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ৮৫৮ জন এবং আহতের সংখ্যা ছিল তালিকায় ১১ হাজার ৫৫১ জন। ডিসেম্বরেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার ও আহতদের কল্যাণ এবং যাবতীয় বিষয়াদির প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরে গত ১৬ই জানুয়ারি নিহতদের তালিকা নিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
প্রকাশিত প্রথম গেজেটে সারাদেশের নিহত ৮৩৪ জনকে ‘শহীদ’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের নাম পরিচয়ও তুলে ধরা হয় সরকারি গেজেটে। এর প্রায় ছয়মাস পরে চলতি বছরের ৩০ জুন আবারো তালিকা হালনাগাদ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। যেখানে নিহতের সংখ্যা ১০ জন বাড়িয়ে ৮৪৪ জনের নামের হালনাগাদ গেজেট প্রকাশ করা হয়। দুই দফায় গেজেট প্রকাশের পর সরকারের কাছে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে নিহতদের কারো কারো নাম দুইবার যুক্ত করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ অন্য হামলায় নিহত হলেও তাদের নাম এসেছে গেজেটে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেন, ‘এই সংখ্যাটা ৮৪৪ থেকে কমবে। কেননা, আমরা তদন্ত করে এখন পর্যন্ত নয় জনের তথ্য পেয়েছি যেগুলো শিগগিরই বাদ দেওয়া হবে। এছাড়াও আর কয়েকটি মিলিয়ে মোট ১৫ থেকে ১৬ জনের নাম বাদ যেতে পারে।’
গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছরের মধ্যেও কেন একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা গেলো না সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। গবেষক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নিহত ও আহতদের তালিকা নিয়ে শুরু থেকে খুব তোরজোড় থাকলেও এখন ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে। এখন সঠিক তালিকা তৈরি করতে যত দেরি হবে তত শঙ্কা দেখা দেবে।’

জাতিসংঘের রিপোর্টের সাথে পার্থক্য কেন?
বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় বা ওএইচসিএইচআর’র এই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে প্রায় ১৪০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে।
এতে উল্লেখ করা হয়, এই সময়ে আরো হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৭০০ জনকে তখন আটক করা হয়েছিল। যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু। জাতিসংঘের ওই রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রায় ৫ মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে।
জাতিসংঘের তালিকায় যেখানে নিহতের সংখ্যা ১৪০০ জন, সেখানে সরকারি তালিকায় নিহতের সংখ্যা ৮৪৪ কেন, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন সামনে আসছে। এর জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, সারা দেশের জেলা প্রশাসন, হাসপাতালগুলোর তথ্য নিয়ে তারা নিহতের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করেছে। এছাড়া সরকারি গেজেটে শুধু সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত আন্দোলনকারীদের নাম এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেন, ‘সেই সময়ে তো পুলিশও মারা গেছে। অন্য পক্ষেরও কেউ মারা গিয়ে থাকতে পারে। তাদের মিলিয়ে ধরেছে কী-না, কিংবা তারা কীভাবে কাউন্ট করেছে সেটা আমরা তো বলতে পারবো না। সেটা তাদের থেকেই জানতে হবে।’
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনে নিহত পুলিশদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যে তালিকায় ৪৪ জন নিহত পুলিশ সদস্যের নাম উঠে এসেছে।
৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক হামলায়ও মারা গেছেন। যাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের ও অঙ্গ সংগঠনের কর্মী। জাতিসংঘের হিসাবে তাদেরকে যুক্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু সেই সংখ্যাটা ঠিক কতো সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনো মেলেনি।
দুই তালিকায় পার্থক্যের কারণ কী?
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত বছরের জুলাই-আগস্টে নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে নানা তালিকা তৈরি হয়েছে গত এক বছরে। গত বছরের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে হতাহতদের বিষয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করে গত বছরের জুলাইয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি বা এইচআরএসএস নামের বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংস্থা।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান ঘিরে গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৭৫ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মারা যায় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। যদিও পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে হালনাগাদ তালিকায় শুধু ৮৪৪ জনের নামেই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাদের সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা গেজেটের কাজ করি। আমাদের এই গেজেটে শুধু অভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা রয়েছে।’
গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আন্দোলন ঘিরে নিহত পুলিশের সংখ্যা নিয়ে নানা তথ্য প্রচার করতে দেখা যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। এরপরই গত বছরের অক্টোবর পুলিশ হেডকোয়ার্টার আন্দোলনের সময় নিহত ৪৪ জন পুলিশ সদস্যের তালিকা প্রকাশ করে। সরকারের ৮৪৪ জন নিহতের তালিকায় সে সব পুলিশ কর্মকর্তার নাম নেই।
সরকারের তালিকায় শুধু ৫ই আগস্ট পর্যন্ত নিহতদের নাম এসেছে। আর জাতিসংঘের প্রতিবেদনে গত বছরের পহেলা জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে যারা মারা গেছে তাদের সংখ্যা বলা হয়েছে। এমনকি আন্দোলনের সময় ও শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরও আওয়ামী লীগ ও বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদেরও কেউ কেউ নিহত হয়েছে। সরকারের ধারণা তাদেরকেও হয়তো জাতিসংঘের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত বলেন, ‘আমরা ঠিক জানি না, সেই সময়ে পুলিশ বা বা অন্য পক্ষের কতজন মারা গিয়েছে। তাদের মিলিয়ে ধরেছে কি-না, কিংবা কীভাবে ওরা (জাতিসংঘ মিশন) কাউন্ট করেছে সেটা আমরা তো বলতে পারবো না।’
অন্যদিকে, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে, গত বছরে জুলাই ও আগস্টে ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ১১৪টি মরদেহ। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা অনেকেই আন্দোলনে নিহত বলেও সে সব খবরে বলা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, যে ৮৪৪ জনের নামের তালিকা তারা করেছে তাদের সবার নাম পরিচয় উল্লেখ আছে। কিন্তু বেওয়ারিশ বা অজ্ঞাতনামা কারো নাম তালিকায় যুক্ত হয়নি।
সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেন, ‘যাদেরকে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা হয়েছে, তারা আসলে কারা ছিল, সেটি শনাক্ত করার জন্য তদন্ত শুরু করেছি আমরা। সেই সংখ্যাটা ঠিক কতো সেটি এখনো জানা নেই। তবে তদন্তের পর আমরা বলতে পারবো’।
গবেষক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগের মধ্যে আসলে শৃঙ্খলা ছিল না। এটা এলাকাভিত্তিক উদ্যোগ নিলে তো সঠিক তালিকা সাত দিনের বেশি লাগার কথা না’।
তিনি বলছিলেন, ‘এখানে কিছু ক্ষতিপূরণ বা তাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রশ্ন এসেছে। আবার ওই সব পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সুতারং সেখানে অনেক ভুয়া লোকজন ঢুকতে পারে। তাই দ্রুত সঠিক ও নির্ভুল তালিকা তৈরি করা দরকার’।

