বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড বাণিজ্যিক মোবাইল অপারেটরদের জন্য নিলামে যাচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অকশন ২০২৬–এর আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। ঘোষিত নির্দেশনা অনুসারে আগামী বছর ১৪ জানুয়ারিতে ঢাকায় নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। নির্দেশিকাটি ২৭ নভেম্বর জারি করা হয় এবং এতে নিলামের কাঠামো থেকে শুরু করে যোগ্যতা, বিডিং পদ্ধতি, ফি ও পেমেন্ট শর্তাবলি পর্যন্ত সব বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফাইয়েজ আহমেদ তাইয়েব সামাজিক মাধ্যমে এক বার্তায় জানান, বাংলাদেশের কৌশলগত এই স্পেকট্রাম সম্পদ দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিশ্চয়তা ও পরিকল্পিত জটিলতার মুখে আটকে ছিল। তিনি লিখেছেন, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ন্যূনতম মূল্য ধরে রাষ্ট্রের অন্তত এগারো হাজার কোটি টাকার সম্পদ অকারণে অব্যবহৃত ছিল। এসব বাধা কাটিয়ে বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে অকশন আয়োজনের সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। তিনি এটিকে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অগ্রগতি বলে উল্লেখ করেন।
বিটিআরসির কাছ থেকে বিনামূল্যে ২০০৭ সালে যে স্পেকট্রাম (তরঙ্গ) নিয়েছিল অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক সেই তরঙ্গ ছেড়ে দিতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিটিআরসি ওই আইএসপিকে বিকল্প পাঁচ গিগাহার্জ ব্যান্ড প্রয়োজনীয় স্পেকট্রাম নেওয়ার প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু তারা তা নেয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বিটিআরসি ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর আইএসপিটির ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ওই স্পেকট্রাম বরাদ্দ বাতিলও করে দেয়। কিন্তু অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক স্পেকট্রাম বরাদ্দ বাতিলের বিরুদ্ধে রিট করে দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি করে রেখেছিল এই স্পেকট্রাম।
যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড
বিশ্বব্যাপী ৭০০ মেগাহার্টজ ‘স্বর্ণব্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত, কারণ কম শক্তিতে এটি বিস্তৃত কাভারেজ দিতে পারে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ব্যান্ড ব্যবহৃত হলে মোবাইল সেবার মান, বিশেষ করে ফোরজি ও ফাইভজি কাভারেজ, উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে। একই সঙ্গে শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সমান নেটওয়ার্ক সুবিধা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দীর্ঘদিন এই ব্যান্ড বরাদ্দ না থাকায় অপারেটরদের নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা ও নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি স্থাপনে সীমাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছিল, যা এবার দূর হওয়ার পথ খুলল।
নিলামের গঠন ও অংশগ্রহণের নিয়ম
বিটিআরসি প্রকাশিত নির্দেশিকা অনুযায়ী, নিলামে মোট ২৫ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম তোলা হবে এবং তা পাঁচটি সমান ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে অতিরিক্ত ২০ মেগাহার্টজ পরবর্তীতে অফার করা সম্ভব হবে। নিলামে অংশ নিতে পারবে কেবল বিদ্যমান মোবাইল অপারেটররা। তাদের নির্ধারিত আবেদন ফি জমা দিতে হবে, প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে এবং পরবর্তীতে বিড আর্নেস্ট মানি জমা দেওয়ার পর চূড়ান্তভাবে বিডিং–এ অংশ নেওয়ার অনুমতি পাবে। নির্দেশনায় উল্লেখ রয়েছে যে নিলাম উন্মুক্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে—অর্থাৎ নির্ধারিত হলে লাইভ বিডিং রুমে রাউন্ডভিত্তিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
পেমেন্ট কাঠামো ও সময়সীমা
নিলামে জিতলে প্রথমে মোট স্পেকট্রাম ফি–এর ১০ শতাংশ ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৯০ শতাংশ নয় বছরের মধ্যে সমান কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ থাকছে, যদিও এককালীন ১০০ শতাংশ পরিশোধেরও ব্যবস্থা রয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, নিলাম শেষে যদি কোনো ব্লক অবিক্রীত থাকে, তবে বিটিআরসি এক বছরের মধ্যে প্রশাসনিক পদ্ধতিতে তা বরাদ্দ দিতে পারবে। পুরো প্রক্রিয়ার রোডম্যাপে আবেদন জমা, বাছাই, প্রি-বিড সভা, অর্থ জমা এবং নিলামের দিন সব সময়সীমাই পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফাইয়েজ আহমেদ তাইয়েব আমার দেশকে বলেন “জিএসএমএ সহ অন্যান্য আন্তর্জা্তিক টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে বাংলাদেশের তরঙ্গ এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দামি। এই রোল আউট অবলিগেশনের ২০ শতাংশ এবং বেস প্রাইস থেকে ১০ শতাং মোট ৩০ শতাংশ স্পেট্রাম ফি রেশনের মাধ্যমে আমরা এই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পাচ্ছি বলে আমার বিশ্বাস। “
এই নিলাম বাংলাদেশের মোবাইল খাতে নতুন বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড চালু হলে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা উন্নত হবে, নেটওয়ার্কে কভারেজের উন্নত হবে এবং ভবিষ্যতের স্মার্ট কানেক্টিভিটি যেমন আওটি, স্মার্ট সিটি ও জাতীয় ডিজিটাল সেবার সম্প্রসারণ আরও বাস্তবসম্মত হবে। দীর্ঘদিন আটকে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পেকট্রাম ব্যান্ড নীতিগতভাবে উন্মুক্ত হওয়ায় খাতটি একটি বড় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।

