দেশে বড় একটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভূমিকম্পটি যদি রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার হয়, তাহলে রাজধানী ঢাকার দুই থেকে তিন লাখ লোক হতাহত এবং ৩৫ শতাংশ ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী আমার দেশকে এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আজ (গতকাল শুক্রবার) ৫ দশমিক ৫ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছে, তার কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে এবং এর স্থায়িত্ব ছিল ২০ সেকেন্ডের মতো। এ ভূমিকম্পকে আমি মনে করি একটা ফোর শক (পূর্বাভাস)। অর্থাৎ একটা বড় ভূমিকম্প আসার আগে যে ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো হয় তেমন।
ড. আনসারী বলেন, বড় ভূমিকম্পের এ আশঙ্কার ফলে আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঝুঁকি মোকাবিলার পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকা শহরে ২১ লাখের মতো ভবন রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ লাখ হচ্ছে একতলা বা দোতলা এবং চারতলার ওপর বাসা আছে প্রায় ছয় লাখ। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের এ বাসাগুলো পরীক্ষা করা দরকার। এখানে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না।
বাংলাদেশ ও এর চারপাশে গত ১০০ থেকে ১৫০ বছরের প্রায় ছয়টি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১৮৬৯ সালে ৭ দশমিক ৬-এর কাছাড় ভূমিকম্প; ১৮৯৫ সালে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প (যার জন্য যমুনা ব্রিজের বিশেষ ডিজাইন করা হয়); ১৮৯৭ সালের ৮ দশমিক ১ মাত্রার গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প (বলা হয় বিশ্বের বড় ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম); ১৯১৮ সালের ৭ দশমিক ৬ মাত্রার শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প এবং ১৯৩০ সালের ৭ দশমিক ১ মাত্রার ধুবড়ি ভূমিকম্প।
ড. আনসারী বলেন, ‘এসব ভূমিকম্পকে ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো মোটামুটি ১০০ থেকে ১২৫ বছর পরপর আসার সম্ভাবনা আছে। আর যেগুলো ৮ মাত্রার ভূমিকম্প, সেগুলো আসার সম্ভাবনা ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর। গত প্রায় ১০০ বছরে, অর্থাৎ ১৯৩০ সালের পর থেকে আমাদের এখানে কিন্তু তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু অতীতে আমাদের যে তথ্য, সেখানে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের বড় ভূমিকম্প কিন্তু আমাদের এলাকায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং আজ যেটি হয়েছে, আমি মনে করি এটা একটা পূর্বাভাস।
বাংলাদেশে গতকাল শুক্রবার অনুভূত হওয়া ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভূমিকম্পে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাসাবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এমনকি ঢাকার বিমানবন্দরের ভেতরে কিছু জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভবনে ক্র্যাক দেখা দিয়েছে। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন করলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করেন ড. আনসারী। তিনি বলেন, এ ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে যতগুলো ভবন ও স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যেগুলো দেবে গেছে; যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয় আরো অনেক ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হবে, অনেক বিল্ডিং দেবে যাবে, ভেঙে যাবে এবং অনেক মানুষ হতাহত হবে।
এ ভূমিকম্প গবেষক বলেন, ‘আমাদের একটা প্রেডিকশন আছে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প যদি ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে হয়, তাহলে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ লোক হতাহত হবে এবং ঢাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ দেবে যাবে অথবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ঝুঁকি মোকাবিলায় ঢাকায় বিল্ডিং পরীক্ষা জরুরি ভিত্তিতে শুরু করতে হবে বলে মনে করছেন এ গবেষক। তিনি বলেন, গুরুত্ব সহকারে ভবনগুলো চেকিং ও সার্টিফাই করতে হবে এবং এর অংশ হিসেবে কালার ক্ল্যাসিফিকেশন করতে হবে। এটি সাধারণত তিনভাবে হয়—একটা হচ্ছে সবুজ রঙের ভবন, যেগুলোতে কোনোরকম ঝুঁকি নেই, পুরোপুরি বিল্ডিং কোড মেনে করা হয়েছে; দ্বিতীয় হচ্ছে—হলুদ বা কমলা রঙের ভবন, যেগুলোতে কমবেশি ঝুঁকি আছে অর্থাৎ, অর্থ ব্যয় করে এগুলো মজবুত করতে হবে। আরেকটা হচ্ছে লাল রঙের ভবন—যেগুলো জরুরিভিত্তিতে খালি করে মজবুত করতে হবে। এভাবে ভবনগুলোকে ট্যাগ করে সেগুলোর গায়ে ‘কালার কোড’ বসিয়ে দেওয়া যায় প্ল্যাকার্ড দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপানেও এমনটা করা হয়েছে। সেখানে ভূমিকম্পের আগেই ভবনগুলো চেক করে সেটাকে ক্যাটাগরিজ করা হয়েছে।
ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ আছে। এখন এগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। এটি বাস্তবায়নে আমাদের প্রায় ৫০টির মতো কোম্পানি আছে, যাদের এ প্রশিক্ষণ আমরা দিয়েছি রানা প্লাজার ঘটনার পর। সেই সঙ্গে আরো প্রশিক্ষণ ও আরো প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রফেশনাল আর্কিটেক্ট ট্রেনিং, প্রফেশনাল প্ল্যানার ট্রেনিং আমাদের শুরু করতে হবে।’
বুয়েটের এ গবেষক মনে করেন, আইইবির মেম্বারশিপ থেকেও বেশি দরকার প্রফেশনাল ট্রেনিং, এটিকে নিয়মিত বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, বিল্ডিং কোডের যে চেঞ্জগুলো আসছে সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন শর্ট কোর্সের মাধ্যমে মানুষকে প্রশিক্ষিত করা দরকার। তিনি বলেন, এখন এজন্য একটা ন্যাশনাল লেভেলের ইনস্টিটিউট গড়া দরকার। একটা সেন্ট্রালাইজড ইনস্টিটিউশন দরকার। এটার জন্য বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে রাজউককে অর্থায়ন করে এবং সিজিএসের মতো একটা ইনস্টিটিউট করার ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপও আছে। কিন্তু সেটা স্থবির হয়ে আছে। এটাকে জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা উচিত।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে গতকালের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। অন্যদিকে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) মতে, এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫।


ভূমিকম্পে নরসিংদীর ৫ জনসহ সারা দেশে নিহত ১১