পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি নিয়ে দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে আওয়ামী সরকারকে বারবার সতর্ক করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সশস্ত্র সংগঠনটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং দেশে ফিরে পরিকল্পিতভাবে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। কিন্তু সে সময় ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার রিপোর্টগুলো অগ্রাহ্য করে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য কমাতে তৎকালীন সরকার কার্যত কোনো ব্যবস্থা তখন নেয়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে ছিল ভারতের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও রাজনৈতিক স্বার্থ। ফলে দিনদিন শক্তি সঞ্চয় করে এখন আপদ হয়ে দেখা দিয়েছে এ গোষ্ঠী। যার সর্বশেষ নজির খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দুটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভারতের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড়ে ইউপিডিএফ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে—এ বিষয়ে হাসিনার আমলে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বার সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলেও এসব অপতৎপরতা প্রতিরোধে তৎকালীন সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। কোনো কোনো জোন কমান্ডার নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নিলে তাকে শাস্তিস্বরূপ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হতো বা পদোন্নতি বঞ্চিত করে অপারেশন ইউনিট থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হতো। ফলে গত ১৫ বছরে শক্তি সঞ্চয়ের অবারিত সুযোগ পায় ইউপিডিএফ। এ সশস্ত্র গোষ্ঠী শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে এখন ভারতের মদতে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়নি হাসিনার সরকার। ভারতের ত্রিপুরা ও আসামে ইউপিডিএফের অবস্থান ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের খবর থাকলেও তা নিয়ে ঢাকায় প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। এমনকি বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বারবার বলা হয়েছিল, ইউপিডিএফ বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন পায় এবং দেশে ফিরে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়। এমনকি সম্প্রতি আলোচিত খাগড়াছড়ির কিশোরী ধর্ষণ নাটক নিয়েও গোয়েন্দারা বলছে, এটি ছিল ইউপিডিএফের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় এরকম রিপোর্টগুলোর বিপরীতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হইনি।
১৫ বছরের গোয়েন্দা রিপোর্টে যা আছে
রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি ও ইসলামপুর এলাকায় দুই গ্রামে ২০০৯ সালের এপ্রিলে ২২ বাঙালি কৃষকের আনারস বাগান রহস্যজনকভাবে নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল, ইউপিডিএফের মদতে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আনারস বাগানে বিষাক্ত রাসায়নিক স্প্রে করে। এতে বগাছড়ি এলাকায় সাতজন কৃষকের প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার আনারস এবং ইসলামপুর এলাকার ১৫ জন কৃষকের প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার আনারস নষ্ট হয়। পরে অভিযান চালিয়ে পুলিশ এ ঘটনায় ব্যবহৃত স্প্রে মেশিন এবং দুই বালতি রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার করে।
কৃষকদের ভাষ্য, এটি বিশেষ ধরনের স্প্রে মেশিন, যা সাধারণত বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত কিছু এনজিওর প্রকল্পে ব্যবহার করা হতো। এ ঘটনায় এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল।
ওই সময় গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, ঘটনাটি ইউপিডিএফের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ঘটানো হয়। নানিয়ারচরের টিঅ্যান্ডটি অফিসে অবস্থিত ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পিসিপি কার্যালয়ের মাঠপর্যায়ের নেতারা এ হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনাটির লক্ষ্য ছিল নানিয়ারচরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত করা, বাঙালি কৃষকদের আনারস বাগান ধ্বংস করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে তাদের উত্তেজিত করে প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এবং ২০০৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নানিয়ারচরে ইউপিডিএফের দুই শীর্ষনেতা—এলিন চাকমা ও সচীব চাকমা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সেখানকার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কুতুকছড়ি, মহালছড়ি ও খাগড়াছড়িতে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে। নানিয়ারচরের স্থানীয় নেতারা মূলত সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করছেন। আনারস বাগান ধ্বংসের ঘটনাও তারই অংশ ছিল।
ওই সময় দায়িত্বরত একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বলেন, এটি নিছক কৃষকদের ক্ষতি নয়, বরং সুপরিকল্পিত নাশকতা ছিল। ইউপিডিএফ বারবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক আঘাতের মাধ্যমে এলাকায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন গভীর করার চেষ্টা করছে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা
ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ও অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অন্তত চারবার পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের চেষ্টা চালিয়েছিল ইউপিডিএফ।
ওই সময়ের গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, এসব ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ দিতে চেয়েছিল সংগঠনটি। বাঙালিদের আনারস বাগান ধ্বংস, বিষাক্ত স্প্রে ব্যবহার এবং পরে রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে যে, ইউপিডিএফ পূর্বের তুলনায় অনেক সংগঠিত ও কৌশলগতভাবে হামলায় নেমেছে। সেনা সদরে পাঠানো চিঠিতে তাই এদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে বলা হয়। কিন্তু ফিরতি কোনো নির্দেশনা দেয়নি সেনা সদর।
রিপোর্টে বলা হয়, পোস্ট ইনসার্জেন্সি অপারেশনের সময় কোনো স্পষ্ট স্ট্র্যাটেজিক গাইডলাইন না থাকায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা দেখা দেয়। প্রতিটি রিজিয়ন ও জোন নিজেদের মতো করে সমস্যার দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসব স্বল্পমেয়াদি সমাধান কৌশলগত ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে নেতৃত্বের ঘনঘন পরিবর্তনের কারণে নীতিমালার ধারাবাহিকতাও বজায় থাকেনি। এ সুযোগেই ইউপিডিএফ ধীরে ধীরে নিজেদের একটি উগ্রপন্থি সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হচ্ছে।
ওই সময় রিপোর্টে বলা হয়, নানিয়ারচর জোন সদর থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে টিঅ্যান্ডটি বাজারে ইউপিডিএফকে স্থানীয় অফিস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন গাজী হত্যার পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের নভেম্বরে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর অফিসটি আবার চালু হয়। এরপর থেকে ওই কার্যালয়কেই সংগঠনের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জরুরি অবস্থার পর ইউপিডিএফের সশস্ত্র দলের অবাধ বিচরণ কমলেও রাষ্ট্রবিরোধী সাংগঠনিক কার্যক্রম বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ঘৃণার রাজনীতি ছড়িয়ে দিতে তারা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। স্থানীয় সূত্র মতে, স্কুল-কলেজের ছাত্রদের প্রভাবিত করে ইউপিডিএফ নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্যাডার গড়ে তুলছে।

