সরকারের নির্দেশনা সত্ত্বেও শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতির কারণে মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনেও সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। প্রাথমিকের একাংশের কর্মবিরতির মধ্যেই আরেকটি অংশ একই দাবিতে নতুন করে স্কুলে ‘তালা ঝুলানোর’হুমকি দিয়েছে। এতে প্রাথমিকে শিক্ষা কার্যক্রমে পুরোপুরি স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মাউশি কর্তাকর্তাদের সঙ্গে দাবি নিয়ে বৈঠক করছেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে এ প্রতিবেদন লেখা নাগাদ বৈঠকটি চলছিল।
বৈঠকে অংশ নেয়া বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি ও কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক রেবেকা সুলতানা রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমার দেশকে বলেন, এখনো বৈঠক চলছে, বৈঠক শেষে বিস্তারিত জানাতে পারবো।
তবে নাম প্রকাশ ও শর্তে এক শিক্ষক নেতা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে; তাদের আশ্বাসের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহার হতে পারে। ফলে বুধবার থেকে স্কুলে যথারীতি শিক্ষকরা কাজে যোগ দিতে পারেন । তবে বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
চার দফা দাবিতে সোমবার থেকে দেশের শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনেও মঙ্গলবার ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফিরে যায়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে কর্মচারীদের পাহারায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের হুমকি
অন্যদিকে তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশের কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনে অধিকাংশ স্কুলে পরীক্ষা হয়নি। সোমবার থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি-এর সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক খায়রুন নাহার লিপি আমার দেশকে বলেন, সোমবারের চেয়েও মঙ্গলবার জোরালোভাবে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে। সোমবার যারা অংশ নেয়নি তারাও মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালন করেছেন। দাবি আদায় না হওয়া নাগাদ আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
এদিকে একাদশ গ্রেডে বেতন, উচ্চ গ্রেডের জটিলতা নিরসন ও সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বারোটি সংগঠনের মোর্চা বুধবার পর্যন্ত সময় দিয়েছে। ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ বলেছে, এর মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে বৃহস্পতিবার থেকে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ঐক্য পরিষদ সোমবার রাতে ভার্চুয়ালি সভা করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবি বাস্তবায়নের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি আরো বলেন, সহকারী শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন যোগাযোগ চললেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ায় তারা বাধ্য হয়েই কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বার্ষিক পরীক্ষার সময়েও শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
গত সপ্তাহের রোববার ও সোমবার অর্ধদিবস এবং মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন এই মোর্চাভুক্ত শিক্ষকরা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারাদেশে বর্তমানে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মরত। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সহকারী শিক্ষক। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বর্তমানে দশম গ্রেডে উন্নীত হয়েছেন। সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তারা এ নিয়ে অসন্তুষ্ট। গ্রেড উন্নীতকরণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন।
সহকারী শিক্ষকদের দাবি হলো- দশম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ১০ বছর ও ১৬ বছরপূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড সমস্যার সমাধান ও শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি। তবে সরকার দশম গ্রেড দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে আপাতত ১১তম গ্রেডের সুপারিশ করেছে। শিক্ষকরাও আপাতত সেই প্রতিশ্রুতির (১১তম গ্রেড দেওয়ার) বাস্তবায়ন দাবি করেন।
প্রাথমিকের চার শিক্ষকনেতাকে শোকজ
পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার অভিযোগে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের চার নেতাকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. নুরুল হাসান তাদেরকে এই নোটিশ দেন। নোটিশে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শোকজ নোটিশ পাওয়া শিক্ষক নেতারা হলেন প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খায়রুন নাহার লিপি, বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নোয়াখালী সদরের কৃপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শামছুদ্দীন মাসুদ, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আবুল কাশেম এবং প্রাথমিক শিক্ষক দশম গ্রেড বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক ও জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মাহবুবার রহমান।
শিক্ষা উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি
এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার বলেছেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আপনাদের কিন্তু তৈরি থাকতে হবে। এখানে সরকার একেবারে দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।’

