বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের সমগ্র জনগণ একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। এমন বাস্তবতায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের প্রত্যাশার বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
আমার মতে, সমসাময়িক জনপ্রত্যাশাকে তিনটি আঙ্গিক থেকে দেখা উচিত। প্রথমত, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের, বিশেষত দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর, বেশ কিছু যৌক্তিক প্রত্যাশা রয়েছে। সঠিক নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এবং যৌক্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের মাধ্যমে এসব প্রত্যাশার অধিকাংশই পূরণ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, সমাজের নৈতিক অবকাঠামো (moral fabric) ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বিবেকহীনতা ও অমানবিকতাকে ভয়ংকরভাবে normalize করা হয়েছে। জগদ্দল পাথরের মতো জাতির বুকে চেপে বসা ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হলেও, রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনে কিংবা সমাজের নৈতিক অবকাঠামো পুনরুদ্ধারে বিগত ১৬ মাসে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকারের কাছে জনগণ এ বিষয়ে সুদৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে। তৃতীয়ত, রক্তক্ষয়ী জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের আপামর জনগণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেই মাত্রার নির্মমতা ও অমানবিকতা প্রত্যক্ষ করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় বেশ কিছু নতুন নতুন জনপ্রত্যাশারও জন্ম হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি সত্য, হাসিনার নির্মমতা ও অমানবিকতা জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি চূড়ান্ত মাত্রায় আস্থাহীন করে তুলেছে। তারা এখন অন্তহীন সংস্কারের দ্বিধাদ্বন্দ্বে (Reform Dilemmas) আক্রান্ত। আস্থাহীনতা থেকে উদ্ভূত সংস্কারবিষয়ক অনেক জনপ্রত্যাশা internally inconsistent, বাস্তবতার বিবেচনায় fanciful এবং দীর্ঘ মেয়াদে counterproductive। এতৎসত্ত্বেও এসব সংস্কার-ভাবনার জন্ম অস্বাভাবিক নয়। রক্তক্ষয়ী পটপরিবর্তনের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই স্বল্প মেয়াদে এমনটি ঘটেছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তি বিগত ১৬ মাসে সংস্কারের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও আস্থাহীনতা নিরসনে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। বরং বেশ কিছু রাজনৈতিক শক্তি ও সুযোগসন্ধানী মহল জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ক্ষুদ্র দলীয় এবং গোষ্ঠী স্বার্থে ওই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও আস্থাহীনতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই-উদ্ভূত জনপ্রত্যাশা নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকারের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। অত্যন্ত সংবেদনশীল এসব জনপ্রত্যাশা পূরণে নতুন সরকারকে দৃঢ় নৈতিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে এবং যথাসম্ভব সর্বোচ্চসংখ্যক অংশীজনকে আস্থায় নিতে হবে।
প্রেক্ষাপটগত এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা সফল গণতান্ত্রিক উত্তরণের স্বপ্ন দেখি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অনেকটা একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সফলভাবে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছিলেন। সেই অনুপ্রেরণায় পরবর্তী সরকারও সফল হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।
অগ্রাধিকার-১
রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোচনা করা যায় :
আস্থাহীনতার কারণ
ক. হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন; খ. জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতা; গ. গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব ও ঘ. দুর্নীতি।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সুসংহত নয়। উপরন্তু, দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী ন্যূনতম মাত্রার গণতন্ত্রও প্রত্যক্ষ করেনি। নতুন সরকারকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে। জনগণ শক্তিশালী গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য ও সুফল ভোগ করলে, রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকদের ন্যায্য মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণের মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার হবে। ফলে, আস্থাহীনতার সংকট দূর হবে।
একই সঙ্গে গতানুগতিক রাজনৈতিক চর্চার বাইরে বেরিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্য নতুন ধারার রাজনীতি বিনির্মাণ করতে হবে।
কর্মকৌশল
Ñআইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা।
Ñসুশাসন।
Ñদুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতা (দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে দুদকের ওপর একক নির্ভরশীলতা যথেষ্ট নয়; সরকারিভাবে ও দলীয়ভাবে দুর্নীতি চিহ্নিতকরণে বিশেষ মেকানিজম গড়ে তুলতে হবে)।
Ñরাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জন-আস্থা প্রতিষ্ঠা।
Ñরাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন (বিশেষত. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ, ‘প্রতিশোধের রাজনীতি’র অবসান, আক্রমণাত্মক বক্তব্য এবং সহিংসতা পরিহার করে গঠনমূলক ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতি বিনির্মাণ)
অগ্রাধিকার-২
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর পুঁজিবাদ (crony-capitalism) ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। শ্রমবাজারে প্রবেশকারী তরুণদের ন্যায়সংগত সুযোগ সংকুচিত হয়েছে।
কর্মকৌশল
Ñরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণ।
Ñভারসাম্যমূলক নীতিকৌশলের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুসংহতকরণ।
Ñকর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ এবং আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণ সুবিধা নিশ্চিতকরণ।
Ñচাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ।
অগ্রাধিকার-৩
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন
বিগত বছরগুলোয় সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং জনতুষ্টিবাদী নীতিকৌশলের কারণে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুতরভাবে মানের অবনতি হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে নতুন সরকারকে তাই বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে।
ইতোমধ্যে বিএনপি দলীয়ভাবে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে, তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বিশেষত, শিক্ষকতায় মেধাবী তরুণদের উদ্বুদ্ধকরণ, ‘ওয়ান টিচার, ওয়ান ট্যাব’, ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন’, ‘বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষা’ ও ‘বাধ্যতামূলক তৃতীয় ভাষা শিক্ষা’Ñশুধু জনপ্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে না, বরং জনগণের মধ্যে গুণগত শিক্ষা বিষয়ে নতুন স্বপ্নের জন্ম দেবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সীমিত পরিসরে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেমন :
Ñএক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণামুখী centre of excellence হিসেবে গড়ে তোলা।
Ñবিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাস্টার্স ও পিএইচডি বৃত্তির ব্যবস্থা করা।
অগ্রাধিকার-৪
স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন
বর্তমানে শহর ও গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্যসেবার মানে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত সেবা এখনো দুষ্প্রাপ্য। চিকিৎসার পেছনে ব্যক্তিগত খরচ (Out-of-Pocket Expenditure) এখনো বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর চরম অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সর্বোপরি, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় রোগীর আস্থার সংকট বিদ্যমান।
কর্মকৌশল
Ñমানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য কমিয়ে আনা।
ÑOut-of-Pocket Expenditure কমিয়ে আনা [বিশেষত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার ক্ষেত্রে]
Ñস্বাস্থ্যসেবায় জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ।
Ñইতোমধ্যে বিএনপি দলীয়ভাবে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে, তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বিশেষত, ‘প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং দেশের সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।
অগ্রাধিকার-৫
আওয়ামী শাসনামলের গুরুতর অবিচার ও নিপীড়নের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি (Accountability) নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে, অন্যায় ও প্রতিশোধমূলক বিচার প্রক্রিয়া যেন সমাজে নতুন করে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকা।
আসন্ন নির্বাচনটি নির্ধারণ করবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র কোন পথে চালিত হবে। এটি শুধু নতুন সরকার গঠন নয়, বরং এটি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার এক অগ্নিপরীক্ষা। স্পর্শকাতর এই সময়ে আমরা যদি জনপ্রত্যাশা পূরণে যথেষ্ট সচেষ্ট না হই, তবে জাতির জীবনে ভয়াবহ ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
লেখক : ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক উপ-আইন অনুষদ
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

