উপহার কেন গ্রেটা থুনবার্গের বই

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫, ০৯: ৩৫

রাজনীতিতে নতুন এক রূপকথার জন্ম দিয়েছে লন্ডন বৈঠক। দক্ষিণ লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষাৎ ও দেড় ঘণ্টা স্থায়ী একান্ত বৈঠক নিয়েই সৃষ্টি হয় এই রূপকথা। তাদের এই দেখা-সাক্ষাৎ নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনা। রাজনৈতিক অঙ্গনকে দারুণ আলোড়িত করেছে এ ঘটনা।

বৈঠকটির পর দেশে নির্বাচনি হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অন্যদিকে এই বৈঠকের চুলচেরা বিশ্লেষণও চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা এটাকে দেখছে তাদের বড় সাফল্য হিসেবে। তারা বলছে, অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে গেছে। নির্বাচনে নামতে আর বাধা নেই। বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী বলছেÑপ্রধান উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখিয়েছেন। এতে তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে তারা কোনো আপত্তি করেনি। বরং জামায়াতে ইসলামী বলেছে, এই সময়সীমা তারা আগেই প্রস্তাব করেছিল। এনসিপিও সময়সীমা নিয়ে কিছু বলেনি। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, লন্ডন বৈঠকে কি আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের কাছে জানতে চাইবে তারা।

বিজ্ঞাপন

তবে যে যা-ই বলুক, লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচনের পালে দারুণভাবে হাওয়া লেগেছে। সংসদীয় ৩০০ আসনজুড়েই এখন হইহুল্লোড়। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন। হয়তো সেটা ১২ ফেব্রুয়ারিও হতে পারে। কিন্তু উত্তেজনা এতটাই যে, কয়দিন পরই যেন নির্বাচন। কে কোথায় মনোনয়ন পাবেন, সেটা নিয়েই মুখ্য আলোচনা এবং দৌড়ঝাঁপ। গ্রামাঞ্চলে চায়ের কাপেও উঠছে এখন তুমুল ঝড়।

তবে আমাকে আকৃষ্ট করেছে অন্য একটি বিষয়। তারেক রহমানের উপহার। তিনি কেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রেটা থুনবার্গের বই উপহার দিলেন?

সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ কৈশোরে জলবায়ু আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন। তার এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে সফল হয়। ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট সুইডেনের স্টকহোম সংসদ ভবনের সামনে ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসেছিল ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরী। সেই মেয়েটিই গ্রেটা থুনবার্গ। ওই সময় তার দাবি ছিল সুইডিশ পার্লামেন্ট যাতে পরিবেশকে বাঁচাতে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়। সামনে ছিল সুইডেনের সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচন পর্যন্ত স্কুল বর্জন করে এই প্রতিবাদ শুরু করে দেন গ্রেটা। এরপর সবার জানা, আলোচিত এক পরিবেশকর্মী হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশ নেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। জাতিসংঘে ভাষণ দেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা করেন। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার একটি নিয়ম হলো, যে বিষয় নিয়ে সেখানে কথা বলবেন, শুরুতে সে বিষয়ে একটা স্টেটম্যান দিতে হয়। গ্রেটা তার স্টেটমেন্টে বলেন, ‘আমার কথা শুনতে হবে না, তোমরা বিজ্ঞানীদের কথা শোনো।’ এরপর গ্রেটা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘ বিজ্ঞানীদের ২০১৮ সালের রিপোর্টটি পড়ে শোনান। এরপর জাতিসংঘ ভাষণে গ্রেটা বলেন, ‘আপনারা আমাদের স্বপ্ন ও শৈশব হরণ করেছেন। বিশ্বের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। আর আপনারা শুধু অর্থ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গালগল্প করে যাচ্ছেন। কতবড় দুঃসাহস আপনাদের।’ টাইম ম্যাগাজিন ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মাত্র ১৭ বছর বয়সি গ্রেটাকে বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত করে। তারেক রহমান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উপহার দেওয়ার জন্য তার বই বাছাই করলেন।

তারেক রহমানের সাক্ষাতের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যসূচিতে লন্ডন সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা খালি রাখা ছিল। তারেক রহমান নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে যান হোটেলে। প্রথম দেখাতেই ড. ইউনূসকে সালাম জানিয়ে বলেন, ‘স্যার আম্মা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন।’ ড. ইউনূসও পরম স্নেহে তারেক রহমানের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন। হাসিমুখে দুজনই দুজনকে দেখে অভিভূত হন।

প্রথমে কুশলবিনিময় এবং সঙ্গীদের পরিচিতি পর্ব চলে ১৫ মিনিট এবং পরে ইউনূস-তারেক এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের একান্ত বৈঠক। তাদের আলাপচারিতা শেষে তারেক রহমান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দুটি বই ও একটি কলম উপহার দিয়ে হোটেল থেকে বিদায় নেন। তার এই উপহার দেওয়ার দৃশ্য টিভিতে দেখানো হয়নি। কারণ তখন সেখানে টিভি ক্যামেরা উপস্থিত ছিল না। বৈঠকের শুরুতে ক্যামেরাগুলো ঝলসে উঠেছিল। উপহারের বিষয়টি জানা যায় প্রেসসচিব শফিকুল আলমের ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট থেকে। বই ও কলমের ছবি দিয়ে তিনি লেখেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য তারেক রহমানের উপহার।

বিশ্ব জলবায়ু সমস্যা ও পরিবেশ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সোচ্চার ব্যক্তি। পরিবেশ তার আগ্রহের বিষয়। বিশ্বব্যাপী ড. ইউনূস একজন সেরা মোটিভেশনাল বক্তা হিসেবে পরিচিত। তার বক্তব্যে জলবায়ু ও পরিবেশ সমস্যা সুন্দরভাবে আসছে। বিষয়টি সম্ভবত জানতেন তারেক রহমান। তাই বিশ্বব্যাপী আলোচিত পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের লেখা ‘নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেক অ্যা ডিফারেন্স’ এবং কবি মোনো আরশি ও ক্যারেন ম্যাকার্থি উলফ সংকলিত ‘নেচার ম্যাটার্স’ নামের দুটি বই তাকে উপহার দেন তারেক রহমান। দুটিই পরিবেশবিষয়ক বই। গ্রেটা থুনবার্গ ড. ইউনূসের অতি পরিচিত। নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম আলোচিত হচ্ছে। একদিন হয়তো দেখা যাবে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন।

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের লেখা ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’ বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটি বই। শূন্য বেকারত্ব, শূন্য দারিদ্র্য এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ বইটির মূল প্রতিপাদ্য। বইটির উল্লেখযোগ্য বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে এতে। আর এ কারণেই হয়তো তারেক রহমানের মনে হয়েছে পরিবেশ ও জলবায়ু-সংক্রান্ত বই স্যার পছন্দ করবেন।

গ্রেটা থুনবার্গ সম্প্রতি আবার খবরে এসেছেন গাজায় ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইতালি থেকে একটি জাহাজে করে তিনি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন ফিলিস্তিনি ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য। কিন্তু বর্বর ইসরাইলি বাহিনী তার এই ত্রাণ ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। মাঝপথে জাহাজটি আটকে ইসরাইলি সৈন্যরা থুনবার্গকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

সেই আলোচিত থুনবার্গের বই, বাংলায় যার শিরোনাম দাঁড়ায়Ñ‘কেউই এত ছোট নয় যে পার্থক্য তৈরি করতে পারবে না’। তার এই বই ২০১৯ সালের ৩০ মে প্যাঙ্গুইন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। বিশ্ব জলবায়ু সংকট সম্পর্কে তার লেখা এবং উপস্থাপন করা ১১টি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার একটি সংগ্রহ এ বই। এতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরে পৃথিবীকে বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। স্কুল ধর্মঘট, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বিশ্ব ফোরামে দেওয়া বক্তৃতাগুলোই বইতে স্থান পেয়েছে। এটি কত গুরুত্বপূর্ণ বই, বোঝা যায় বিষয়গুলো দেখলেই। থুনবার্গের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাগুলোর মধ্যে একটির শিরোনাম হচ্ছেÑআমাদের ঘর আগুনে জ্বলছে। তেমনি এতে আছেÑআমাদের জীবন আপনাদের হাতে, প্রায় সবকিছু সাদাকালো, অজনপ্রিয়, আমাকে ভুল প্রমাণ করো, আমি এটা করার জন্য খুব ছোট, তোমরা নষ্ট দায়িত্ব জ্ঞানহীন শিশুর মতো আচরণ করছো, একটি অদ্ভুত পৃথিবী, বিশ্ব জেগে উঠেছে, ‘আমরাই পরিবর্তন, পরিবর্তন আসছে’ ইত্যাদি।

বইটি প্রথম প্রকাশের পর সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। বর্ধিত সংস্করণে থুনবার্গ আরো পাঁচটি বক্তৃতা যুক্ত করেছেন। ফলে বইটিতে তার ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা রয়েছে। ইতোমধ্যে ওয়াটারস্টোনস কর্তৃক থুনবার্গকে বইটির জন্য বর্ষসেরা লেখক ঘোষণা করা হয়েছে।

ড. ইউনূসকে উপহার দেওয়া তারেক রহমানের দ্বিতীয় বই ছিল কবি মোনা আরশি এবং ক্যারেন ম্যাকার্থি উলফের বই ‘নেচার ম্যাটার্স’। এটাও প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক একটি বই। প্রকৃতির বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির গুরুত্বই তুলে ধরা হয়েছে। এর বৈচিত্র্যময় কবিতাগুলো জলবায়ু সংকট এবং নৃ-তাত্ত্বিকতা, নগর প্রকৃতি, নির্জনতা, আদিবাসী জ্ঞানসহ পরিবেশগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা।

ড. ইউনূসকে পরিবেশবিষয়ক বই উপহার দেওয়া এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার বিষয়গুলোও লন্ডন বৈঠক থেকে জানা গেছে। তারেক রহমানকে লন্ডনে পার্কে হাঁটার অভিজ্ঞতা বলেছিলেন ড. ইউনূস। তারেক রহমানও তাকে জানান বগুড়ায় তিনি সুন্দর পার্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং সেখানে হাঁটতেন। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তারেক রহমান নির্বাসনে। ১/১১-র সময় ছিলেন জেলে। এতদিন বগুড়ার পার্কটি ময়লা-আবর্জনায় ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের বগুড়ার রিপোর্টার জানিয়েছেন, আবার পার্কটি আপন সজীবতায় জেগে উঠবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত