
ড. মাহবুবুর রাজ্জাক

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তথাকথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা সেক্যুলারিজমের নামে সমাজকে বিভাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। কোথাও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ ছিল না। স্বৈরাচারের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত না হলে চাকরি পাওয়া যেত না, পদোন্নতি হতো না। নানা ধরনের দোহাই দিয়ে পদে পদে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর তাহজিব তমদ্দুনকে অবমাননা করা হতো। কাউকে ইসলাম চর্চা করতে দেখলেই তাকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে অপদস্থ করা একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিয়ে শত শত ধর্মপ্রাণ যুবকের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। গুম আর খুনের আতঙ্কে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী আমলা মরহুম ড. আলী আকবর খান এই অবস্থাকে মাৎস্যন্যায়ের যুগের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
এমনি করেই ২০২৪-এর মধ্য জুলাইয়ে স্বৈরাচারের পাপের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। একদিন রাতের নীরবতা ভেঙে শত শত কিশোর-যুবক ছাত্রের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের বাণী, মুক্তির স্লোগান; ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ এই রাজাকার শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে কিশোর-যুবক-ছাত্ররা প্রকৃতপক্ষে তার আত্মপরিচয়ের সংশয় দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল মুসলমানিত্বের পরিচয়ই তাদের আসল পরিচয়; তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। মানুষ যখন তার নিজের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে, তখন পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাও পারেনি। তাকে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। এই প্রতিরোধে মুসলমান-অমুসলমান, বাম-ডান—সবাই শামিল হয়েছে। এই স্পিরিটই হলো বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এখন আর কোনো চাপিয়ে দেওয়া তত্ত্বের নামে এই দেশের মানুষের ওপর নিপীড়ন চলবে না। যার যার ধর্ম, যার যার সংস্কৃতি নিয়ে সবাই একসঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। গণঅভ্যুত্থানের বছরখানেক পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের অভূতপূর্ব ফলাফলে এই ধারণাটিই প্রতিভাত হয়। নতুন এই গণজাগরণের সৌন্দর্য হলো, এখন ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন নিয়ে যারা কটাক্ষ করে, তারা হালে পানি পাচ্ছেন না। ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমকে পাকিস্তানি আখ্যা দিয়েও তার ভূমিধস বিজয়কে ঠেকানো যায়নি। সাবিকুন্নাহার তামান্নার হিজাব নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন এঁকেও তাকে দমানো সম্ভব হয়নি। বিপুল সমর্থন নিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হেসেছেন। অহিজাবি তাসনিম জুমা এবং চাকমা সম্প্রদায়ের সর্বপ্রিয় চাকমা যেমন ইসলামপন্থিদের পক্ষভুক্ত হয়ে লড়াই করেছেন, ইসলামপন্থিরাও তেমনি তাদের আপন করে নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন। প্রমাণিত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা সেক্যুলারিজম নয়, সব মত ও পথের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই মাল্টিকালচারাল বাংলাদেশই মানুষের আসল চাওয়া।
তত্ত্বীয়ভাবে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেক্যুলারিজমের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নীতি, আইন, শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা কোনো ধর্মীয় প্রভাবের অধীনে চলবে না। প্রত্যেক নাগরিক নিজের পছন্দমতো ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কোনো ধর্ম না মানলেও বৈষম্যের শিকার হবে না। ইউরোপে ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে রেনেসাঁর যুগে সেক্যুলারিজমের ধারণার জন্ম হয়। এ সময় পর্যন্ত সেখানে রাজনীতি, শিক্ষা, আইন, এমনকি বিজ্ঞানের ওপরও চার্চের আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা চার্চের আধিপত্য মানতে অস্বীকার করেন। ফল হিসেবে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে ফেলার চিন্তার প্রসার ঘটে।
ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করার দাবি ওঠে। উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করা, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মাধ্যমেই সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারণা তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে প্রবেশ করে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তা আমাদের মন-মগজে গেঁথে দেওয়া হয়। অথচ মুসলিম সমাজে সেক্যুলারিজম একটি অপ্রয়োজনীয় মতবাদ। ইসলামে ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। ইসলাম চার্চের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের পথে কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ভারতের পরামর্শে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও ইসলামিক মূল্যবোধকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরে ১৯৮৮ সালে সেনাশাসক লে. জেনারেল এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। ২০১১ সালে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রেখে দেয়। অন্যদিকে নির্বাচনে ও রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় আবেগের অপব্যবহার শুরু করে। তাহাজ্জুদ নামাজের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ভণ্ডামি চালু হয়। খোলাখুলিভাবে তথাকথিত সেক্যুলার রাষ্ট্র ভারতের তাঁবেদারি শুরু হয়।
এ সময় ভারতে গুজরাটের কসাই হিসেবে কুখ্যাত মোদির বিজেপি সরকারের শাসনে মুসলিম ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী জম্মু-কাশ্মীর ও মণিপুরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ভারতের ইন্ধনে বাংলাদেশেও বিডিআর গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, আল্লামা সাঈদির রায়-পরবর্তী গণহত্যা সংঘটিত হয়। জঙ্গিবাদের নাটক সাজিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে কোণঠাসা করে রাখার নীতি গৃহীত হয়। ভারত ও বাংলাদেশে সেক্যুলার শাসনব্যবস্থায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। সেক্যুলারিজম মূলত বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করার মন্ত্রে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের সমাজ মূলত ধর্মনির্ভর সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশটাকে নরকে পরিণত করে প্রমাণ করে গিয়েছে যে, সেক্যুলারিজম বাংলাদেশে একটি অচল মতবাদ। ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সবার সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা লিখে রেখেছে; এটি স্বাধীনচেতা মানুষকে দাবিয়ে রাখার একটি ছলনা মাত্র। তেমনিভাবে আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদও দেশবিরোধী; ভারতের দাসত্ব করার মতবাদ। জাতি হিসেবে আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, জেন-জি প্রজন্ম এ বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে। অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।
এই চেতনাকে বিজয়ী করার জন্য ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ভোটবিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী চেতনার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। তারা একটি মাল্টিকালচারাল সমাজ চায়, যেখানে ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন মেনে বেড়ে ওঠা যায়। তারা চায় এমন একটি সমাজ, যেখানে ইসলামসহ সব ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের স্বাধীনতা থাকবে। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুসহ সমাজের সব অংশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। রাষ্ট্র কারো প্রতি কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করবে না। দাড়ি-টুপি-হিজাব পরার কারণে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। দাড়ি-টুপি-হিজাব না পরলেও কেউ হেনস্তার মুখোমুখি হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তথাকথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা সেক্যুলারিজমের নামে সমাজকে বিভাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। কোথাও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ ছিল না। স্বৈরাচারের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত না হলে চাকরি পাওয়া যেত না, পদোন্নতি হতো না। নানা ধরনের দোহাই দিয়ে পদে পদে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর তাহজিব তমদ্দুনকে অবমাননা করা হতো। কাউকে ইসলাম চর্চা করতে দেখলেই তাকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে অপদস্থ করা একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দিয়ে শত শত ধর্মপ্রাণ যুবকের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। গুম আর খুনের আতঙ্কে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী আমলা মরহুম ড. আলী আকবর খান এই অবস্থাকে মাৎস্যন্যায়ের যুগের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
এমনি করেই ২০২৪-এর মধ্য জুলাইয়ে স্বৈরাচারের পাপের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। একদিন রাতের নীরবতা ভেঙে শত শত কিশোর-যুবক ছাত্রের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের বাণী, মুক্তির স্লোগান; ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!!’ এই রাজাকার শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে কিশোর-যুবক-ছাত্ররা প্রকৃতপক্ষে তার আত্মপরিচয়ের সংশয় দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল মুসলমানিত্বের পরিচয়ই তাদের আসল পরিচয়; তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। মানুষ যখন তার নিজের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে, তখন পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাও পারেনি। তাকে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। এই প্রতিরোধে মুসলমান-অমুসলমান, বাম-ডান—সবাই শামিল হয়েছে। এই স্পিরিটই হলো বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এখন আর কোনো চাপিয়ে দেওয়া তত্ত্বের নামে এই দেশের মানুষের ওপর নিপীড়ন চলবে না। যার যার ধর্ম, যার যার সংস্কৃতি নিয়ে সবাই একসঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। গণঅভ্যুত্থানের বছরখানেক পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের অভূতপূর্ব ফলাফলে এই ধারণাটিই প্রতিভাত হয়। নতুন এই গণজাগরণের সৌন্দর্য হলো, এখন ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন নিয়ে যারা কটাক্ষ করে, তারা হালে পানি পাচ্ছেন না। ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমকে পাকিস্তানি আখ্যা দিয়েও তার ভূমিধস বিজয়কে ঠেকানো যায়নি। সাবিকুন্নাহার তামান্নার হিজাব নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন এঁকেও তাকে দমানো সম্ভব হয়নি। বিপুল সমর্থন নিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হেসেছেন। অহিজাবি তাসনিম জুমা এবং চাকমা সম্প্রদায়ের সর্বপ্রিয় চাকমা যেমন ইসলামপন্থিদের পক্ষভুক্ত হয়ে লড়াই করেছেন, ইসলামপন্থিরাও তেমনি তাদের আপন করে নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন। প্রমাণিত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা সেক্যুলারিজম নয়, সব মত ও পথের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই মাল্টিকালচারাল বাংলাদেশই মানুষের আসল চাওয়া।
তত্ত্বীয়ভাবে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেক্যুলারিজমের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নীতি, আইন, শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা কোনো ধর্মীয় প্রভাবের অধীনে চলবে না। প্রত্যেক নাগরিক নিজের পছন্দমতো ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কোনো ধর্ম না মানলেও বৈষম্যের শিকার হবে না। ইউরোপে ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে রেনেসাঁর যুগে সেক্যুলারিজমের ধারণার জন্ম হয়। এ সময় পর্যন্ত সেখানে রাজনীতি, শিক্ষা, আইন, এমনকি বিজ্ঞানের ওপরও চার্চের আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা চার্চের আধিপত্য মানতে অস্বীকার করেন। ফল হিসেবে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে ফেলার চিন্তার প্রসার ঘটে।
ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করার দাবি ওঠে। উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করা, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মাধ্যমেই সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারণা তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে প্রবেশ করে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তা আমাদের মন-মগজে গেঁথে দেওয়া হয়। অথচ মুসলিম সমাজে সেক্যুলারিজম একটি অপ্রয়োজনীয় মতবাদ। ইসলামে ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। ইসলাম চার্চের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের পথে কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ভারতের পরামর্শে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও ইসলামিক মূল্যবোধকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরে ১৯৮৮ সালে সেনাশাসক লে. জেনারেল এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। ২০১১ সালে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রেখে দেয়। অন্যদিকে নির্বাচনে ও রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় আবেগের অপব্যবহার শুরু করে। তাহাজ্জুদ নামাজের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ভণ্ডামি চালু হয়। খোলাখুলিভাবে তথাকথিত সেক্যুলার রাষ্ট্র ভারতের তাঁবেদারি শুরু হয়।
এ সময় ভারতে গুজরাটের কসাই হিসেবে কুখ্যাত মোদির বিজেপি সরকারের শাসনে মুসলিম ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন চরম আকার ধারণ করে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী জম্মু-কাশ্মীর ও মণিপুরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ভারতের ইন্ধনে বাংলাদেশেও বিডিআর গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, আল্লামা সাঈদির রায়-পরবর্তী গণহত্যা সংঘটিত হয়। জঙ্গিবাদের নাটক সাজিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকে কোণঠাসা করে রাখার নীতি গৃহীত হয়। ভারত ও বাংলাদেশে সেক্যুলার শাসনব্যবস্থায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। সেক্যুলারিজম মূলত বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করার মন্ত্রে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের সমাজ মূলত ধর্মনির্ভর সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশটাকে নরকে পরিণত করে প্রমাণ করে গিয়েছে যে, সেক্যুলারিজম বাংলাদেশে একটি অচল মতবাদ। ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সবার সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা লিখে রেখেছে; এটি স্বাধীনচেতা মানুষকে দাবিয়ে রাখার একটি ছলনা মাত্র। তেমনিভাবে আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদও দেশবিরোধী; ভারতের দাসত্ব করার মতবাদ। জাতি হিসেবে আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, জেন-জি প্রজন্ম এ বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে। অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।
এই চেতনাকে বিজয়ী করার জন্য ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ভোটবিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী চেতনার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। তারা একটি মাল্টিকালচারাল সমাজ চায়, যেখানে ইসলামি তাহজিব-তমদ্দুন মেনে বেড়ে ওঠা যায়। তারা চায় এমন একটি সমাজ, যেখানে ইসলামসহ সব ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের স্বাধীনতা থাকবে। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুসহ সমাজের সব অংশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। রাষ্ট্র কারো প্রতি কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করবে না। দাড়ি-টুপি-হিজাব পরার কারণে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। দাড়ি-টুপি-হিজাব না পরলেও কেউ হেনস্তার মুখোমুখি হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা নিছক একটি ছাত্র আন্দোলন ছিল না। ইতিহাসের ধারায় অনেক আন্দোলন আসে, কিছু ধূলিসাৎ হয়ে যায়, কিছু পারিপার্শ্বিক চাপে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু কিছু আন্দোলন থাকে, যেগুলো একটি জাতি, সমাজ এবং দেশকে বড়মাত্রায় নাড়া দিয়ে যায়। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন কিংবা জুলাই
১১ ঘণ্টা আগে
মুত্তাকি ভারতকে আফগানিস্তানের খনিজ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তালেবান সরকার অন্যান্য দেশকেও একই প্রস্তাব দিয়েছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেও সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। ইরানের চাবাহার বন্দরকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানোর বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এই ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ।
১১ ঘণ্টা আগে
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত একটি বৈপ্লবিক শক্তিই তাদের অধিকার দিয়েছে পুরোনো-অকেজো কিংবা বিতর্কিত, মনগড়া সংবিধানসহ সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যেতে। সে কারণে দেশ ও জাতির চাহিদা অনুযায়ী অতি আবশ্যকীয় কিছু মৌলিক সংস্কার-সংবলিত ‘জুলাই ঘোষণা’ কিংবা
১২ ঘণ্টা আগে
লাতিন আমেরিকার ‘মাদক সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলমান সামরিক অভিযান ক্যারিবীয় অঞ্চলকে একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেছে। মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন গত আগস্ট মাস থেকে এই অঞ্চলজুড়ে যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান এবং হাজার হাজার সেনা
১ দিন আগে