আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বৈশ্বিক বয়ান ও হাসিনার ‘ডার্ক ডকট্রিন’

আবু সুফিয়ান

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বৈশ্বিক বয়ান ও হাসিনার ‘ডার্ক ডকট্রিন’
আবু সুফিয়ান

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর আমেরিকাকেন্দ্রিক ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বিশ্বরাজনীতিতে একটি প্রধান নিরাপত্তা বয়ান হিসেবে গড়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই বয়ান শুধু আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি বৈশ্বিক একটি নীতিকাঠামোয় পরিণত হয় যার ছায়া বহু রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় গভীরভাবে বিস্তার লাভ করে। এই বয়ান রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, নজরদারি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ দমনের মতো কর্মকাণ্ডকে এক ধরনের বৈধতার আবরণ দেয়।

ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন তার ‘স্টেট অব এক্সসেপশন’ তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ‘অসাধারণ অবস্থা’ ঘোষণা করে স্বাভাবিক আইন ও সংবিধানের নিয়ম স্থগিত করার চর্চা শেখে। এর ফলে রাষ্ট্র নিজের জন্য ‘অসীম ক্ষমতা’ প্রতিষ্ঠা করে, যা গুম, ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মিথ্যা মামলা দায়েরের মতো দমননীতির প্রধান অস্ত্রে পরিণত হয়। ২০১৬ সালে রাজধানীর কল্যাণপুরে ‘তাজ মঞ্জিল’ বা ‘জাহাজবাড়ি’ হত্যাযজ্ঞ, ‘হলি আর্টিজান’ হামলার পরের ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ধারাবাহিক গুমের ঘটনা—সবই এই ‘অসাধারণ অবস্থা’র বাস্তব উদাহরণ, যেখানে নাগরিক অধিকার কার্যত মাটিতে মিশে গিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

মিশেল ফুকোর ‘বায়োপলিটিক্স’ ও ‘গভর্নমেন্টালিটি’ ধারণা অনুসারে, আধুনিক রাষ্ট্র এখন জনগণের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যাদের ‘ঝুঁকি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাদের জীবনকে বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনে। হাসিনার শাসনামলে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে মানুষের জীবন ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ডিজিএফআই, সিটিটিসি, এটিইউ, ডিবি ও র‍্যাবের হাতে সংঘটিত গুম, নির্যাতন এবং তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো এই ‘জীবন-শাসন’ ক্ষমতার নগ্ন প্রকাশ।

নোয়াম চমস্কি তার ‘হু আর দ্য গ্লোবাল টেররিস্টস?’ গ্রন্থে প্রশ্ন তোলেন—প্রকৃত সন্ত্রাসবাদী কারা : বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী, না রাষ্ট্র? বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা গেছে, শেখ হাসিনার জমানায় ‘সন্ত্রাসবাদ’ রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। রাজনীতিবিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই চলত দমন-পীড়ন। কয়েকটি গণমাধ্যম ‘সন্ত্রাসী নির্মাণ’ এবং ‘ভীতি সৃষ্টির’ প্রধান যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। ‘সন্ত্রাসী’ চিত্রায়ণ এবং ‘জননিরাপত্তার হুমকি’ প্রচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো মানুষের মনোজগৎ। গণআতঙ্ক এবং ভয়ের শাসন হয়ে উঠেছিল শাসনের কার্যকর অস্ত্র। বিচার বিভাগও ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নীরব অংশীদারে পরিণত হয়েছিল।

যেসব প্রতিষ্ঠান নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গঠিত হয়েছিল, শেখ হাসিনার শাসনামলে সেগুলোই পরিণত হয় ভয়ের প্রতীকে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগ ছিল বহুমাত্রিক নিপীড়নের এক দীর্ঘ চিত্র এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’র নামে পরিচালিত হয়েছিল একটি সুপরিকল্পিত ভয়ের প্রকল্প। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, ইসলামপন্থি জনগোষ্ঠী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নজরদারি, গুম, ক্রসফায়ার, সাজানো মামলা এবং তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে একটি ভীত ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ নির্মাণ করা হয়েছিল। জনগণকে স্থায়ী ভয়ের বলয়ে আটকে রাখা হয়েছিল।

সে জমানায় বিভিন্ন সাজানো অভিযানের আড়ালে কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে এবং এর রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য কী ছিল—সে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার তাড়না ছিল সব সময়ই। ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর আমার দেশ পুনঃপ্রকাশের পর সেসব ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করি; প্রকাশ হতে থাকে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কখনই সহজ ছিল না। শেখ হাসিনার শাসনামলে তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। সত্য বলা, লেখা কিংবা প্রশ্ন তোলা কালোতালিকাভুক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াত। এরপর শুরু হতো নানামুখী হয়রানি, গুমের আশঙ্কা, মামলার হুমকি, চাকরিচ্যুতি আর হাসিনার পোষ্য সাংবাদিকদের মাধ্যমে অপপ্রচার।

এই সময় আমি দেশের অসংখ্য অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়েছি—জেলগেট, মর্গ, আদালতের বারান্দা, গ্রামাঞ্চল আর বন্দুকের শব্দে জেগে ওঠা শহর। কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল তথ্যের উৎসের কাছাকাছি পৌঁছানো। রাষ্ট্র যখন নিজেই অপরাধের অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তখন সত্য অনুসন্ধান রাষ্ট্রদ্রোহের ঝুঁকি তৈরি করে।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিকবার হুমকির মুখে পড়েছি, গোপনে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে, সহযোগীদের ওপর নজরদারি করা হয়েছে, গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ২০২৪ সালে দেশ এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে পৌঁছায়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন, শেখ হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, রাজনৈতিক মামলা ও সার্বিক আতঙ্ক মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ। ওই বছরই হাসিনার শাসনের অবসান ঘটে; তিনি দলবলসহ ভারতে পালিয়ে যান।

এই বাস্তবতায় হাসিনার আমলে সংঘটিত বিভিন্ন ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বা ছদ্ম আক্রমণের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বলতে বোঝানো হয় রাষ্ট্র বা কোনো সংগঠন যখন নিজেরাই একটি হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে, যাতে সেটিকে শত্রুপক্ষের কাজ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। এতে রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে এবং জনগণের মধ্যে ভয়, বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনই অনেক ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ সময়ের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে। ২০১৬ সালের কল্যাণপুর ‘জাহাজবাড়ি অভিযান’ তেমনই একটি অধ্যায়, যেখানে তথাকথিত জঙ্গি দমন অভিযানের নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা নিরপরাধ তরুণদের হত্যা করা হয়েছিল। তবে সেই নির্মম সত্য রাষ্ট্রীয় প্রচারের আড়ালে চাপা থাকেনি। ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর আমার দেশ একটি যুগান্তকারী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা মিথ্যার দেয়ালে বড় ফাটল সৃষ্টি করে। সেখানে দেখানো হয়, ‘জঙ্গি দমন’-এর আড়ালে সেটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হিসেবে প্রচারিত সরকারি বক্তব্যে একের পর এক অসংগতি ধরা পড়ে। অভিযানের সময় তীব্র গোলাগুলির দাবি থাকলেও বাস্তব আলামতে তার প্রতিফলন ছিল না। অধিকাংশ নিহতের শরীরে কাছ থেকে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়—যা ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার প্রমাণ।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে উঠে আসে, নিহতদের মধ্যে কয়েকজন আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ছিলেন। ডিবি অফিস থেকে নিখোঁজ যুবকদের লাশ ‘জাহাজবাড়ি’তে পাওয়া যায় সাজানো জঙ্গি নাটকের অংশ হিসেবে। অভিযানের পর পুলিশের ব্যাখ্যাতেও ফাঁকফোকর ধরা পড়ে—গ্রেনেড বিস্ফোরণের দাবি থাকলেও ভবনের কাঠামোগত কোনো ক্ষতি হয়নি, আর যেসব অস্ত্র ‘উদ্ধার’ করা হয়েছিল, সেগুলো আগের অভিযানে ব্যবহারের চিহ্ন বহন করছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলে—কারা সেই তরুণরা, যাদের ‘জঙ্গি’ বানিয়ে হত্যা করা হলো।

তবে সেই অনুসন্ধানের কাজটি সহজ ছিল না। ২০১৬ সালের সে ঘটনাটি যে সাজানো—এ বিশ্বাস সমাজে থাকলেও চাক্ষুষ প্রমাণ সংগ্রহ ছিল কঠিন। স্থানীয় বাসিন্দা, নিহতদের পরিবার ও সাজানো সাক্ষীদের কথায় সন্দেহ স্পষ্ট ছিল। ডিবি থেকে ‘জাহাজবাড়ি’তে তরুণদের নিয়ে যাওয়ার এক প্রত্যক্ষদর্শীর অস্তিত্ব জানতাম। কয়েক মাসের প্রচেষ্টায় মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামানের মাধ্যমে সেই সংযোগ সম্ভব হয়। তিনি দীর্ঘ দেড় দশক হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনে এবং প্রায় এক দশক এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারে জাতিসংঘে প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তিনি গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ভুক্তভোগীদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন।

এই অনুসন্ধানের সময় কারাবন্দি এক ব্যক্তির সূত্রে শেখ মো. সেলিম হোসাইনের নাম জানতে পারি। জানা যায়, তিনি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামানের সহায়তায় তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয় এবং তার পূর্বঅভিজ্ঞতা ও নির্যাতনের বিবরণ সংগ্রহ করি।

আমার দেশ-এ জাহাজবাড়ির প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দীর্ঘদিন থেমে থাকা বিচারপ্রক্রিয়ায় নতুন গতি আসে। ‘ডিবি থেকে নিয়ে ৯ তরুণ খুন’ প্রতিবেদনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং সাবেক এসপি জসিম উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। আইন বিশেষজ্ঞরা মত দেন, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে দোষ প্রমাণ অসম্ভব কিছু নয়, যদিও বিচার কতটা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাবের বাইরে থাকবে—সে উদ্বেগ রয়ে গেছে। নিহতদের পরিবার ও মানবাধিকার কর্মীরা দ্রুত বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।

নরসিংদীর ‘নিলুফার ভিলা’য় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর জীবন এলোমেলো করে দিয়েছিল হাসিনার পুলিশ। এ নিয়ে আরেকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল আমার দেশ-এ, যা জনমনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে।

খাদিজা পারভিন মেঘনা ও ইশরাত জাহান মৌ—দুটি নাম, দুটি জীবন। বিনাবিচারে টানা ছয় বছর কারাবাস, নির্যাতন, অপমান ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তাদের জীবনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।

মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, হিজাব পরা, নিয়মিত নামাজ পড়া ও ধর্মীয় অনুশাসনে আগ্রহী হওয়ার কারণে তাদের ‘তথাকথিত জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ধর্মপ্রাণ ছাত্রীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া এবং ইসলামপন্থি জীবনাচার নিয়ন্ত্রণে আনা।

এ ঘটনার নেপথ্যে উঠে আসে সিটিটিসির দুই শীর্ষ কর্মকর্তার নাম—মনিরুল ইসলাম ও মো. আছাদুজ্জামান। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর তারা দেশত্যাগ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তারা শুধু এই সাজানো ‘জঙ্গি নাটক’-এর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণহত্যার সঙ্গেও তাদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে উঠে আসে, জঙ্গিবিরোধী অভিযানকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশলটি এই কর্মকর্তাদ্বয় নিয়মিতভাবে বাস্তবায়ন করতেন। নির্জন এলাকা বা মফস্বল শহরে নাটক সাজিয়ে নিরীহ মানুষকে ‘জঙ্গি’ বানানো, কখনো ‘বন্দুকযুদ্ধ’, কখনো ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণ’—এসবই ছিল তাদের ব্যবহৃত পদ্ধতি।

নরসিংদীর ‘নিলুফার ভিলা’ সেই বৃহৎ ষড়যন্ত্রেরই এক অধ্যায়, যেখানে মেঘনা ও মৌ এই ব্যবস্থার শিকার হন। তাদের স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশেই এই অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল এবং দুই পরিবার চরম মানসিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হয়।

এই দুই তরুণী টানা ছয় বছর কোনো বিচার ছাড়াই কারাগারে কাটান। সে সময়টি ছিল অন্ধকার ও আতঙ্কে ভরা। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৫ সালে তারা জামিনে মুক্তি পান।

এ ঘটনা শুধু দুটি জীবনের ট্র্যাজেডিই নয়; এটি রাষ্ট্রীয় দমননীতির এক নগ্ন দলিল। তারা এখন কারাগারের বাইরে, কিন্তু মিথ্যা মামলা, মিডিয়া ট্রায়াল এবং সমাজে ‘জঙ্গি’ অপবাদ আজও তাদের পিছু ছাড়েনি।

‘নিলুফার ভিলা’য় সাজানো তথাকথিত জঙ্গি নাটক কোনো সাধারণ দৃশ্য নয়, এটি ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। রাষ্ট্র তাদের জীবন থেকে যে ছয় বছর কেড়ে নিয়েছে, তার মূল্য কি কখনো ফেরত দেওয়া সম্ভব?

এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘নিলুফার ভিলা’ সংক্রান্ত সাজানো সেই মামলা থেকে ওই দুই শিক্ষার্থী খালাস পান।

২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো আমাকে সাংবাদিকের চেয়ে, একজন নাগরিক হিসেবে বেশি নাড়া দিয়েছে। এ সময়কালে আমাকে যারা তথ্য দিয়েছেন, এমন অনেক তথ্যদাতা দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। আমার চলাচল পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, পরিচিত মানুষদের কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবুও আমি থামিনি, থামবও না। এসব অনুসন্ধানকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য নীরবে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে তথ্য দিয়েছেন। নিরাপত্তার কারণে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব নয়; কিন্তু তাদের সহমর্মিতা ও তথ্য সরবরাহের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এই নীরব সাহসিকতা প্রমাণ করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও মানবিকতার সব আলো নিভে যায়নি।

লেখক: বিশেষ সংবাদদাতা, আমার দেশ

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন