নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও শোডাউন

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৩২

নির্বাচন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শনিবার কুমিল্লার ময়নামতিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে সময় বলেছেন, সে সময় নির্বাচন হবে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করছে। তারা আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি সুরাহা করবেন। জুলাই সনদে তারা সবাই স্বাক্ষর করবেন, বর্ষা শেষে দেখবেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে নির্বাচনের হাওয়া বইছে।

নির্বাচন কি আদৌ হবে? এমন একটি প্রশ্ন এখন সর্বত্রই শোনা যায়। প্রশ্নটি রাজনৈতিক অঙ্গনেই বেশি শোনা যাচ্ছে। সাংবাদিকদের দেখলে যে কেউ এই প্রশ্নটি করেন। কেন এমন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে? বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।

বিজ্ঞাপন

প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী এপ্রিলের মাঝামাঝি নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেন। এতে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিএনপি কিছুতেই এপ্রিলে নির্বাচন মানছিল না। তারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসছিল। দলটি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ, মিছিলও করে। রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফরে যান। সেখানে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ওই বৈঠকের পর একটি যৌথ বিবৃতি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে হবে। অর্থাৎ ডিসেম্বরেও নয়, এপ্রিলে নয়। এ ঘোষণায় বিএনপি উৎফুল্ল হয়। বিএনপি নেতারা বলতে থাকেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ কেটে গেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এতে ক্ষুব্ধ হয়। তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে নয়। কারণ জামায়াতে ইসলামী রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করার প্রস্তাব করেছিল। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর এমন যৌথ বিবৃতি কেন দিলেন, এটাই আপত্তি। এই বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এমন বক্তব্য জামায়াত ও এনসিপি দিয়েছে। বেশ কিছুদিন এ নিয়ে বিতর্ক চলেছে। তবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের তারিখ ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা চলতে থাকে। জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করে প্রাথমিকভাবে প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করে। তাদের প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগও শুরু করে দেন। নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী অসংখ্য। একেকটি আসনে তিন-চারজন করে বিএনপির প্রার্থী। তারাও জনসংযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তরুণদের দল এনসিপি চুপচাপ থাকে। কারণ তাদের তখনো দল গঠন চূড়ান্ত হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটি হলেও জেলায় জেলায় কমিটি হয়নি।

জোরালোভাবে সামনে আসে সংস্কার ও বিচারের প্রসঙ্গটি। এনসিপিই বিষয়টি সামনে আনে। বলা হয়, সংস্কার এবং বিচার ছাড়া নির্বাচন হবে না। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যরাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলে। বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হয়, ফ্যাসিবাদের বিচার অবশ্যই বিএনপি চায়। সংস্কারও চায়। তবে বিচার ও সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ চলবে না। প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে হবে এবং সংস্কারও দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। মৌলিক বিষয়ে যেসব সংস্কার এখনই অপরিহার্য, সেগুলো করা হোক। তারপর নির্বাচিত সরকারের জন্য বাকিগুলো থাকবে। তারা বাকি সংস্কার সম্পন্ন করবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিচারও শুরু হয়েছে।

এরই মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের কাজ দ্রুত শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম দফায় সিরিজ বৈঠক হয়েছে। এখন দ্বিতীয় দফায় বৈঠক চলছে। বৈঠকে কয়েক দিন বিরতি ছিল। আবার গতকাল রোববার থেকে বৈঠক শুরু হয়েছে।

সংস্কারের অগ্রগতি

সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। প্রথম পর্বে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রায় দুই মাস আলোচনা চলে। এ পর্বে ১৪৭টি প্রস্তাবের বিষয়ে সুরাহা হয়। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি এমন ১৯টি বিষয়কে মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার প্রস্তাব হিসেবে চিহ্নিত করে ঐকমত্য কমিশন। সেগুলোর বিষয়ে ৩০টির মতো দলকে একসঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা চলতে থাকে। গত ৩ জুন থেকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়। রোববারের আগ পর্যন্ত ১৪ দিনের আলোচনায় ১৫টির মতো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে আটটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দলগুলো। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব দুই মেয়াদের বেশি অর্থাৎ টানা ১০ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না বিষয়ে বিএনপি শর্ত দিয়ে একমত হয়েছে সবার সঙ্গে।

এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে

১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন : জাতীয় সংসদে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। তবে বিষয়টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। দলটি জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় গেলে দুটোর সঙ্গে সংবিধান সংশোধন এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দলের বিপক্ষে এমপিরা ভোট দিতে পারবেন না, এ বিধান যুক্ত করবে।

২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটি : সরকারি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ও বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি যিনি হবেন বিরোধী দল থেকে নেওয়া হবে। চারটি স্থায়ী কমিটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে সংখ্যা আনুপাতিক হারে বিরোধী দল থেকে সভাপতি পদ দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো।

৩. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়। এরপর প্রতি আদমশুমারি অনধিক ১০ বছর পর সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের দফা একের ‘ঘ’ শেষে আইনের দ্বারা একটি বিধান যুক্ত করা। এর অর্থ হচ্ছে, সংসদীয় আসন নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা।

৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান : রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়ে একটি সুপারিশ কমিটি বা বোর্ড গঠন করা হবে। এ কমিটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমার বিষয়ে পরামর্শ দেবে।

৫. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ : বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনে একমত হয়েছে দলগুলো। তবে বিএনপির পক্ষে প্রস্তাব করা হয়েছে বিষয়টির জন্য সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে। নাগরিক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে অধস্তন আদালত স্থাপনে একমত হয়েছে দলগুলো। একই সঙ্গে বিদ্যমান চৌকি আদালত, দ্বীপাঞ্চল ও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত উপজেলা আদালতকে স্থায়ী আদালত করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছে দলগুলো।

৬. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ : আপিল বিভাগ থেকে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচনে ইশতেহার-পূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতি থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন। এমন বিধান সংযোজন করতে পারবে। তবে অসদাচরণ বা অসামর্থ্য অভিযোগের কারণে ৯২ অনুচ্ছেদের অধীন কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান থাকলে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

৭. জরুরি অবস্থা ঘোষণা : জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, ১৪১-এর ক(১) ধারা মতে, রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, যা যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের দ্বারা বাংলাদেশ বা এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তার বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহলে তিনি অনধিক নব্বই দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগেই মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা বিরোধীদলীয় উপনেতা উপস্থিত থাকবেন।

৮. সংবিধান সংশোধন : সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে গত মঙ্গলবারের আলোচনায় দলগুলো প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছে। রোববারের সংলাপে এ বিষয়ে ঘোষণা আসার কথা। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট। নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, গণভোটের ব্যবস্থা না থাকা এবং উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট। বিদ্যমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।

যে সাতটি বিষয়ে এখনো একমত হয়নি দলগুলো : ১. সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি (আগে ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলÑএনসিসি)। প্রস্তাবটিতে আপত্তি বিএনপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। এ ছাড়া জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, সিপিবি, বাসদসহ সংলাপে অংশ নেওয়া বাকি ২৪টি দল প্রস্তাবের পক্ষে।

২. দ্বিকক্ষের সংসদ : দ্বিকক্ষের সংসদের বিরোধিতা করছে সিপিবি ও বাসদ। বাকি ২৮টি দল একমত। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টনের মতো উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিকে উভয় কক্ষের নির্বাচনের দাবি করেছে। এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, জেএসডি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ বাকি ২১টি দল সংখ্যানুপাতিকে (পিআর) উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করেছে। এরই মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে। তবে কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এরপর বিষয়টি নিয়ে দলটির উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দলটির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে।

৩. সংসদে নারী আসন : সংসদে নারী আসন বাড়ানোর পক্ষে অধিকাংশ দলই একমত। বিএনপি ও তার সমমনা চারটি দল বিদ্যমান ব্যবস্থায় আসন বণ্টনের পক্ষে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হলে ১০০ আসনের পক্ষে। এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, বাসদসহ কয়েকটি দল সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

৪. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি : বিএনপি ও তার সমমনা চারটি দলে এবং জোট সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। জামায়াতসহ অধিকাংশ দল ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। দু-একটি দল সরাসরি ভোট চেয়েছে।

৫. রাষ্ট্রের মূলনীতি : বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল কমিশনের প্রস্তাবিত পাঁচটি মূলনীতির পাশাপাশি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হওয়া আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস যুক্ত করার পক্ষে। এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবে একমত। সিপিবি, বাসদসহ বামপন্থি দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে বিদ্যমান মূলনীতি রাখার পক্ষে।

৬. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল : একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। তবে বিএনপি বলেছে, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি হলে (এনসিপি) তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে।

৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার : দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার প্রবর্তন করতে দলগুলো একমত। তবে গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোতে দ্বিমত রয়েছে। রোববার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলগুলো সমঝোতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে জানা গেছে। আগামীকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে চূড়ান্ত হবে।

এখনো আলোচনা হয়নি : ১. সংসদ সদস্যদের একাধিক পদে থাকার বিধান। ২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান। ৩. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত বিধান। ৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ ৪৮) (৩)।

সংঘাত-সংঘর্ষ ও শোডাউন

লালমনিরহাটের পাটগ্রামে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের থানা ঘেরাও এবং থানা থেকে আসামি (বিএনপি নেতাকর্মী) ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক মহলে। বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে দায়ী নেতাকর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করে। জামায়াতে ইসলামী এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় সমাবেশ করে। সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এ অবস্থায় কীসের নির্বাচন? একইভাবে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে যুবদলকর্মী লাল চাঁদ সোহাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়েও রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়িক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবদলের দুই গ্রুপের বিরোধের জের হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড হয়। হত্যাকাণ্ডটি এতই বর্বর এবং নৃশংসভাবে সংঘটিত হয়, এর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় বইয়ে যায়। বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের বহিষ্কার করলেও এ ঘটনা নিয়ে দলটি প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন, যার বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজিসহ এমন অপকর্মের অভিযোগ উঠবে, তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে। তিনি এ ব্যাপারে সরকারকেও উদ্দেশ্য করে বলেন, দোষীদের বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? এ ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাব ইতোমধ্যে মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের কাছে সোপর্দ করেছে।

দেখতে দেখতে জুলাই ছাত্র গণআন্দোলনের বর্ষপূর্তি এসে পড়ে। ১ জুলাই থেকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, সরকারসহ বিভিন্ন মহল নানা অনুষ্ঠানমালা শুরু করে। তরুণদের দল এনসিপি দেশব্যাপী ‘জুলাই পদযাত্রা’ শুরু করে। এতে নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, ডা. তাসনিম জারাসহ জুলাই যোদ্ধারা নেতৃত্ব দেন। এ জুলাই পদযাত্রা অভূতপূর্ব সারা জাগায়। তবে জুলাই যোদ্ধাদের বক্তব্যে বিএনপির প্রতি বেশি আক্রমণ হচ্ছে বলে বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হয়। তারা এও বলেন, বিএনপিকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলতে থাকে। এনসিপি গোপালগঞ্জ অভিমুখে তাদের পদযাত্রা শুরু করে। কিন্তু নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সেখানে আগে থেকেই ক্যাডার ও অস্ত্রশস্ত্র এনে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এনসিপির মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়। পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এনসিপির জুলাই যোদ্ধাদের সেখানে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পর ফেরার সময় তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করা হয়। এর আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল নাহিদ, হাসনাত ও সারজিসকে হত্যা করা। পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে পড়ে। সংঘর্ষ, আগুন, থানা লুট, এসপি কার্যালয় ঘেরাও করে আগুন দেওয়া এবং জেলা কারাগার আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী তলব করা হয়। সেনা, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ অভিযান এবং কারফিউ জারির ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এ ঘটনায় ইতোমধ্যে পাঁচজন নিহত হয়।

জুলাই যোদ্ধারা তাদের পদযাত্রা নিয়ে ফরিদপুর, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ হয়ে কক্সবাজার যান। কক্সবাজারের সভা সঞ্চালনা করতে গিয়ে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে লক্ষ্য করে নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমানের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘শিলং থেকে এখানে আরেক গডফাদার এসেছেন।’ এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। চকরিয়ায় এনসিপির মঞ্চ ভেঙে দেন সালাহউদ্দিন আহমেদের কর্মীরা।

এসব ঘটনায় রাজনীতিতে সংঘাত ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে জনমনে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। অনেকেই বলছেন, ঘটনাগুলো স্বাভাবিক নয়। নির্বাচন ভন্ডুল করে দেওয়ার জন্যই এমন ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনার পেছনে পরাজিত শক্তির হাত এবং ইন্ধন আছে। তারা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে চাচ্ছে। নির্ধারিত সময় থেকে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারলে দেশে আর নির্বাচন হবে না। এ দফায় নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারলে নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে আর বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের নিয়েই নির্বাচন করতে হবে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এখন গোপালগঞ্জে নাশকতা চালিয়েছে। এরপর তারা নাশকতার সংখ্যা অন্যান্য জেলাতেও চালাবে। প্রতিবেশী ভারতও তাদের সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ব্রিফিং করে বলেছেন, বাংলাদেশে সব দল নিয়ে ইনক্লুসিভ নির্বাচন করতে হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে খুব তৎপর বলে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নজরে এসেছে।

তবে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা তৈরি হলেও রাজনৈতিক দলগুলোও সচেতন। শনিবার জামায়াতে ইসলামী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ করেছে। এটি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাসের প্রথম সমাবেশ। এই বিশাল শোডাউনে এটাও প্রমাণিত, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখেই এটি ছিল জামায়াতের শোডাউন। জামায়াতের আমির সমাবেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার বক্তব্যেও এসেছে তারা নির্বাচিত হলে কী কী করবেন। তারা সরকারি প্লট নেবেন না, শুল্কমুক্ত গাড়ি নেবেন না, প্রতিটি এলাকায় সরকারি বরাদ্দ কীভাবে ব্যয় করবেন, তার প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন। তারা চাঁদাবাজি করতে দেবেন না, দুর্নীতি করতে দেবেন না এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করবেন। এগুলো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিরই আগাম ঘোষণা। এনসিপিও জুলাই পদযাত্রার মাধ্যমে তাদের শোডাউনই করেছে। বিএনপিও দেশব্যাপী শোডাউন করে চলেছে। নয়াপল্টনে বিশাল শোডাউন করেছে বিএনপি। তারেক রহমান শোডাউনে বক্তব্য রেখেছেন। এগুলো নির্বাচনেরই আলামত। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ঘোষণা, ‘নির্বাচনে কোনো অনিশ্চয়তা নেই’ সময়োপযোগী বক্তব্য। নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিরোধেরও সমাধান আশা করি হয়ে যাবে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই ঐকমত্য হয়ে গেছে। বাকিগুলোও হয়ে যাবে। আমরা আশাবাদী, আগামী ৫ আগস্ট জুলাই সনদ ঘোষণা হয়ে যাবে। দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে যাবে। এটাই হওয়া উচিত। ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলায় জুলাই ঐক্যের বিকল্প নেই।

নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন চুপচাপ। কোনো বক্তব্য রাখছেন না রাজনৈতিক বিষয়ে। আমার মন বলছে, আগামী ৮ কিংবা ৭ আগস্ট সরকারের এক বছর পূর্তির দিনে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারেন। সবাই এই ভাষণে খুশি হবে এবং পরদিন থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়ে যাবে। প্রেস সচিব শফিকুল আলম যেমনটা বললেন, ‘বর্ষা শেষে দেখবেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে নির্বাচনের হাওয়া বইছে।’

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত