রক্ত ঝরানো ও দেশ কাঁপানো গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জরুরি হয়ে পড়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ফেসবুক লাইভে এসে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আগুনে ঘি ঢেলেছেন। দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই তিনি মাঝেমধ্যেই এ ধরনের কাজ করছেন। ভারতে বসে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করাই তার এই অপতৎপরতার লক্ষ্য। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের দেশের বাইরে ও ভেতরে নানামুখী তৎপরতা, বিরাজমান সামগ্রিক অবস্থা, প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দূরত্ব তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে সব শক্তির ঐক্য অটুট রাখতে প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র ভূমিকা রাখতে পারে। আন্দোলনের নেতারা গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঘোষণাপত্র ঘোষণা করার উদ্যোগ নেন। বিএনপি এতে আপত্তি জানালে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রনেতাদের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রেস উইং থেকে তখন বলা হয়েছিল, ‘এটি একটি প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ। এটাকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
বিএনপি সে সময় ঘোষণাপত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ধারণা ছিল, দেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বিএনপির কয়েকজন নেতা সে সময় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র প্রতিনিধি আছেন। আন্দোলনের তিনজন নেতা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতির কাছে তারা শপথ নিয়েছেন।’ তাহলে বিদ্যমান সরকার কাঠামোয় থেকে কীভাবে এ ধরনের ঘোষণা দেওয়া যায়, এ নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন। জামায়াতে ইসলামী ঘোষণাপত্র না দেখে কোনো মন্তব্য করবে না বলে জানায়। আর বিভিন্ন বামদলের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই তৎপরতা রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি বৃহত্তর জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্য বৃদ্ধি এবং বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা থেকে সরে আসেন। প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তির ঐক্য বজায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করবে। ছাত্রনেতারা প্রথমে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানান। পরে তারা এ বিষয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি সময় নির্ধারণ করেন। কিন্তু ঘোষণাপত্র প্রণয়ন কোন পর্যায়ে আছে, কারা এটি তৈরি করছেন, কবে নাগাদ এটি ঘোষণা করা হবে, সে বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতির খবর জানা যায়নি।
জুলাই ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে, সে সম্পর্কে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ইতোমধ্যে কিছু আভাস দিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছিলেন, জুলাই-গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায় ও লক্ষ্য-সংবলিত নতুন রাজনৈতিক ইশতেহার হবে এই ঘোষণাপত্র। এতে একটি বৈষম্যহীন নতুন রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্রের পথ বিনির্মাণের কথা থাকবে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১৬ জানুয়ারি বিএনপি, জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে ঘোষণাপত্র নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিএনপি নেতারা অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর কেন ঘোষণাপত্র, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা জানতে চান, ঘোষণাপত্র কে দেবে? সরকার না ছাত্ররা? এই ঘোষণার রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এবং আইনি গুরুত্ব কি আছে? ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য দলের প্রতিনিধিরা ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এর পক্ষে তাদের অবস্থানের কথা জানান। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধে নয়। তবে ঘোষণাপত্রে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব শক্তির অবদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা অটুট রাখতে হবে। ঘোষণাপত্র প্রণয়নের কারণে নিজেদের মতবিরোধে ঐক্য বিনষ্ট করা যাবে না। প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব উল্লেখ করে ওই বৈঠকে বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ে সর্বসম্মতভাবে সামনে আসতে পারলে দেশের জন্য ভালো। আন্তর্জাতিকভাবেও ভালো। সবাই দেখবে, এ জাতির মধ্যে বহু ঠোকাঠুকি হয়েছে, কিন্তু নড়ে না। স্থির হয়ে আছে, শক্ত হয়ে আছে। তা দেশবাসীকে জানাতে চাই, সারা দুনিয়াকে জানাতে চাই।’
অভ্যুত্থানের সাড়ে ৫ মাস পর ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন আছে কি না, তখন সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। তবে বলতে হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র জরুরি। কেন জরুরি, এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, একাধিক কারণে ঘোষণাপত্র জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রধান কারণ হচ্ছে, মাত্র ৩৬ দিনে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, আয়নাঘর সৃষ্টি, পুলিশকে পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করা, প্রশাসনের দলীয়করণ, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, কুৎসিত দুর্নীতি, ব্যাংক সেক্টর ধ্বংস করা ইত্যাদি অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসব অপরাধের প্রধান দায়ভার শেখ হাসিনার। এর সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন আমলের মন্ত্রী, এমপি, দলের নেতা, রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট ব্যবসায়ী, পুলিশ, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকেও বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। জুলাই ঘোষণাপত্রে এ বিচার অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকতে হবে।
অনেকেই মনে করেন, গণহত্যা ও গত ১৫ বছরের দুর্নীতির যথাযথ বিচার করা গেলে বর্তমানে যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তার অনেকটা এমনিতেই হয়ে যাবে। এই বিচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ঘোষণাপত্র দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, পুলিশ ও প্রশাসনে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, জাতীয় অর্থনীতিতে লুটপাটের প্রবণতা বন্ধ করা। দুর্নীতি বন্ধ করার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে। আগামী দিনে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসনের পুনরুত্থান যাতে না ঘটে, সে বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। সর্বোপরি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সহস্রাধিক শহীদ এবং হাত-পা ও চোখ হারানো হাজার হাজার আহতের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি বিশেষভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ঘোষণাপত্রের ঘোষণা কি উপরোক্ত সব বিষয়ের গ্যারান্টি দিতে পারবে? সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-গণআন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা-পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলো কতটা বাস্তবায়ন করেছিল? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার পর প্রণীত সংবিধান তো দেশে গণতন্ত্রের স্থায়ী রূপ দিতে পারেনি।
সংবিধানকে সরকারগুলো বারবার কাটাছেঁড়া করে ক্ষতবিক্ষত করেছে। দেশের জনগণ একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, সেনাসমর্থিত শাসন এবং গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী শাসন দেখেছে। গত ১৫ বছরে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান স্বাভাবিক নিয়মে তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কখনো সামরিক অভ্যুত্থান, আবার কখনো গণঅভ্যুত্থানে তাদের অনেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, এমনকি কেউ কেউ নিহত হয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানও একদলীয় শাসন কায়েম করেন এবং একপর্যায়ে সপরিবারে নিহত হন। সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং একপর্যায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খেটেছেন। ১/১১-এর সেনাসামর্থিত সরকারের সময় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। শেখ হাসিনা তার শাসন আমলে খালেদা জিয়াকে কথিত দুর্নীতির মামলা দিয়ে জেলে পাঠান। আর গত ১৫ বছরে দেশে স্বৈরশাসন কায়েম করে গণহত্যার দায় নিয়ে শেখ হাসিনা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের অভিযাত্রার সূচনা হলেও তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, দেশে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধানের ক্ষমতা থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রস্থান ঘটেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সংবিধান যেখানে আইনের শাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি দিতে পারেনি, সেখানে জুলাই ঘোষণাপত্র কীভাবে তা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে? ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে একটি বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যেসব শক্তি গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন হওয়ার কথা। আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যারা সরকার গঠন করবে, তারা যদি গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে এবং সুশাসন বাদ দিয়ে ভিন্নপথে অগ্রসর হয়, তখন ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকারের কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাবে। যে তুলনাহীন রক্তপাতের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে, তার ‘স্পিরিট’ ভুলে যাওয়া ক্ষমতাসীনদের জন্য হয়তো কঠিন হবে। আর এ জন্যই ঘোষণাপত্র একান্ত জরুরি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক

