বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কত ঘটনার কত তদন্ত কমিটি হয়েছে, তার হিসাব নেই। কিন্তু কোনো তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জনসম্মুখে এমনভাবে কখনো প্রকাশ পায়নি। এই প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে দেশের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট বিলম্বে হলেও আলোর মুখ দেখল। শুধু তা-ই নয়, এমন একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, যে রিপোর্টে স্বয়ং সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, যা অতীতে কখনো ঘটেনি।
এটা হচ্ছে ঢাকার পিলখানার বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট, যার মাধ্যমে ওই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা কুশীলবদের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। ১৬ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা চলছে। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ওই সময়ে যেসব কুশীলবদের নাম শোনা যাচ্ছিল, তাদেরই নাম এই রিপোর্টে ফুটে উঠেছে।
এই রিপোর্টকে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যা জুলাই বিপ্লবেরই ফসল। কারণ জুলাই বিপ্লব না ঘটলে এবং শেখ হাসিনার পতন না হলে হয়তো কোনো কালেই এ ধরনের রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ পেত না। এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে এমন একটা নজির স্থাপিত হলো যে, যিনি যত বড়ই শক্তিশালী হোন না কেন একদিন না একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। একেই বলে নিয়তির নির্মম পরিহাস।
তদন্ত রিপোর্টে বিডিআর হত্যাকাণ্ডকে দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত এর পেছনে ছিল, তা তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সাক্ষ্যে বেরিয়ে এসেছে। সাক্ষ্য প্রদানকালে তিনি বলেছেন, ‘পিলখানায় সেনা অভিযান চালাতে গেলে ভারত বাংলাদেশের ওপর হামলা চালাবে—এই হুমকি ছিল।’ এ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের পক্ষে ওই কথা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ সেনাপ্রধান হিসেবে নিজের অফিসারদের রক্ষা করতে যেকোনো বৈদেশিক আক্রমণ মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল একটি স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব। জেনারেল মইন ইউ সে দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে একটা স্বাধীন দেশের একটি বাহিনীর বিদ্রোহ দমনে সেনা অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারত কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে? তাহলে কি বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করেছে? আর এটা এমন একটা সময়ে ঘটানো হয়েছে যখন সবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। অনেকের হয়তো স্মরণ আছে যে, ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের মাত্র ৫০ দিনের মাথায় এই তথাকথিত বিদ্রোহ এবং ঠান্ডা মাথায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনা ঘটে। সম্ভবত অনেক হিসাব করে সরকারের শুরুতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে; কারণ সদ্য জনগণের ম্যানডেট পাওয়া সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পক্ষ থেকে হুমকি আসবে না এবং জনগণও রাস্তায় নামবে না।
অনেকেই মনে করে থাকেন, বড়াইবাড়ী ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে ভারত এটা করে থাকতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিডিআরের নাম ও পোশাক বদল এরকম একটি ধারণা দেয় যে, বড়াইবাড়ীতে যে বিডিআর বাহিনী ভারতীয় বাহিনীকে পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবিয়েছিল, সে বাহিনীর নাম ও পোশাক থাকা উচিত নয়। হয়তো সেরকম একটি পরিকল্পনা থেকে এই নাম ও পোশাক বদলের ঘটনা ঘটেছে।
এখন স্মরণ করুন সেই দিনটির কথা। সেটা ছিল ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী সীমান্তে বড়াইবাড়ী গ্রামে আক্রমণ করে বসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। বিডিআর জোয়ানরা পাল্টা আক্রমণ চালালে শুরু হয় ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষ। একপর্যায়ে আক্রমণকারী ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা পালিয়ে যায়। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষে ১৬ জন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী নিহত হয়। এই পরাজয় ভারতীয়রা কখনো মেনে নিতে পারেনি।
এখানে আরো উল্লেখ করতে হয়, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী কর্তৃক বড়াইবাড়ী আক্রমণ করার ঘটনাটি ছিল প্রতিশোধমূলক একটি আক্রমণ। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ১৫ ও ১৬ এপ্রিল সিলেট সীমান্তে পাদুয়া ক্যাম্প দখল নিয়ে বিডিআর ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী পরাজিত হয় এবং পাদুয়া ক্যাম্প বিডিআর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এই ঘটনায় ভারতীয়রা প্রচণ্ড বিব্রত অনুভব করে। যার ফলে এর দুদিন পর প্রতিশোধ নিতে ১৮ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে বড়াইবাড়ীতে আক্রমণ চালায়। কিন্তু এবারও তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
পরপর দুটি সীমান্ত সংঘর্ষে ভারতীয়দের এই পরাজয় তাদের পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্নকে কেবল ধূলিসাৎই করেনি, বরং বিশ্ববাসীর সামনে তাদের সম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের বিজয়গাথাকেও যেন কটাক্ষ করা হয়েছে। সুতরাং ভারত তার অনুগত সরকারের মাধ্যমে বিডিআরের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী বাহিনীকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল—এই সিদ্ধান্তটি অমূলক নয়। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হচ্ছে, সে তার প্রতিশোধ নিতেই থাকে, কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতারা কি কখনো ভেবেছিলেন বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার একদিন হবে?
এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর এখন বলা যায়, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এই রিপোর্টের পর আজ এটা মনে হয়েছে, বিডিআর বিদ্রোহের নামে যে বিচার হয়েছে, তা ছিল একটা প্রহসনমূলক বিচার। অর্থাৎ মূল হোতাদের বাঁচানোর জন্য বিচারের একটি নাটকই কেবল মঞ্চস্থ হয়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সেই পাদুয়া ও বড়াইবাড়ী সীমান্ত সংঘর্ষের সময় বিডিআরের ডিজি ছিলেন মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান। আর এত বছর পর সেই ফজলুর রহমানই কমিশনের সভাপতি।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, সেই দুটো সীমান্ত সংঘর্ষে বিডিআর জোয়ানদের বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সক্ষমতা প্রমাণ করেছিল। কিন্তু সেই বিজয়ে আবার দুর্ভাগ্য নেমে এসেছিল তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের ওপর। ভারতীয়দের চাপে তাকে অকাল অবসরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম কে খণ্ডাবে!
পরিশেষে এই জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি সাবেক জেনারেল ফজলুর রহমান এবং অন্যান্য সদস্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ তারা ১৬ বছর আগের সুপরিকল্পিত একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সত্য উদ্ঘাটন করে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। সেইসঙ্গে এই কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পুরোপুরি সহযোগিতা প্রদান এবং নিজে সাক্ষ্য দেওয়ায় বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকাও ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নজির হিসেবে থাকবে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তখন ঢাকায় অবস্থিত ৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন এবং ঘটনাস্থলের বাইরে তিনি অবস্থান করছিলেন। সুতরাং তিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

