দিল্লি থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হাসিনার

প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫: ১৭

নির্বাচন কি হবে—এমন একটি প্রশ্ন আজকাল অনেকেই করে থাকেন। বিশেষ করে সাংবাদিকদের সামনে পেলে কেউ কেউ এই প্রশ্নটি করেন। তাদের মধ্যে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট নাগরিকরাও রয়েছেন। তাদের যখন পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, ‘তারা কেন এই প্রশ্ন করছেন কিংবা কেন নির্বাচন হবে না’—তার কোনো জবাব পাওয়া যায় না। তারা শুধু বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যেই একটা সন্দেহ আছে।’

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আদৌ কি কোনো অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ-সংশয় আছে? প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রায় প্রতিদিনই তার ভাষণে নির্বাচনের কথা তুলে ধরছেন। তিনি জোর গলায় বলে যাচ্ছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে একটি অসাধারণ সুন্দর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তার ভাষায়, ফেব্রুয়ারিতে দেশে ‘নির্বাচনি মহোৎসব’ হবে। ড. ইউনূস জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনের জন্য বর্তমানে নিউইয়র্কে রয়েছেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম সারির তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নেতা। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই তিনটি দল—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান নিয়ামক। নির্বাচনে মূলত এরাই আলোচিত দল। জাতিসংঘ অধিবেশনে এই তিনটি দলের ছয়জন নেতাও অংশ নিয়েছেন। অধিবেশনে বাংলাদেশ ডেস্কে তারাও বসেছেন। তাদের সামনে বসা অবস্থায় জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তিনি এই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা জাতিসংঘকে অবহিত করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘকে বাংলাদেশে আগামী সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকার কথাও তুলে ধরেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে পুনর্ব্যক্ত করেছেন, সেটা খুবই জোরালো ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষণকে তাৎক্ষণিকভাবে অভিনন্দিত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসাইন। পরে প্রেস ব্রিফিংয়েও তারা বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য খুবই ইতিবাচক। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ড. ইউনূসের এই ভাষণ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ভাষণের প্রশংসা করে ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ভাষণটি প্রশংসনীয়। এই প্রথম কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণ করেছেন, যা ব্যতিক্রমী ও প্রশংসনীয়।

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের মতো সর্বোচ্চ বৈশ্বিক ফোরামে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আসেন, তখন এ নিয়ে সংশয়ের আর কোনো অবকাশ থাকার সুযোগ নেই। ভাষণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ ও সংস্কার উদ্যোগের কথাও বিস্তারিত বলেছেন। তার বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার, সংস্কার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশের মতো সহজ পথে না গিয়ে একটি টেকসই পথে তারা এগোচ্ছেন। সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন এবং কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা, সংস্কার ও ঐক্য প্রচেষ্টা সত্যিই এক কঠিন কাজ। তবুও সেই প্রচেষ্টা এগিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না। জুলাই সনদ এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে জুলাই ঘোষণায় সবাই স্বাক্ষর করেছেন। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবেন, সংস্কার বাস্তবায়ন করাটা তাদের মূল দায়িত্ব হবে।

আমরা দেখেছি, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী অন্তবর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। জানা গেছে, নির্বাচনে ৮০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য দায়িত্বে থাকবেন।

সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি জানিয়েছেন, ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের মধ্যকার মতভিন্নতা দূর করতে আলোচনা চলছে। গত শুক্রবার রাতে ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামতে বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে সংস্কার প্রশ্নে গণভোট করা যেতে পারে। জুলাই সনদ নিয়ে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে সেটার ভিত্তিতে গণভোট হতে পারে। আর গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভা গঠন করা হলে সেটাও জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গেই করা যাবে। এর আলোকে ঐকমত্য কমিশন থেকে সরকারের কাছে দুটি প্যাকেজ প্রস্তাব যাচ্ছে। প্রথমটিতে থাকছে সংবিধান আদেশ, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ (রেফারেন্স পাঠানো) ও গণভোটের সুপারিশ। এর বিকল্প হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার দ্বারা নির্বাচিতদের মাধ্যমে সমাধান করার সুপারিশ। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে জুলাই সনদের অচলাবস্থা কাটবে বলে উল্লেখ করছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

abdal vai

সাংবাদিকরা তার কাছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরেছেন। তারা জানতে চেয়েছেন কোনো অনিশ্চয়তা আছে কিনা। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা আছে বলে তিনি মনে করেন না। অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অবশ্যই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। তার মতে, নির্বাচন না হলে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সে রকম পরিস্থিতি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে। তাই নির্বাচন প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তার মূল কথা হচ্ছে, নির্বাচন না হলে ঝুঁকিতে পড়বে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা। আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানও শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অবশ্যই হতে হবে। নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়েই বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই বিরোধ মিটিয়ে ফেলবেন, এ ব্যাপারে সবাই আশাবাদী। ছয়জন রাজনীতিককে নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেওয়া, অধিবেশনে বাংলাদেশ টেবিলে সদস্য হিসেবে তাদেরকে রাখা, তাদের সামনে রেখে বিশ্বমঞ্চে ভাষণ দেওয়া—এটা তারই অংশ। শুধু তা-ই নয়, প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছেন। সব বৈঠকেই বাংলাদেশের আসন্ন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলছেন। বিশ্বনেতারা ড. ইউনূসের সরকারকে এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতার কথা বলছেন।

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো খুবই তৎপর। বলা যায়, তারা নির্বাচনি প্রচারে পুরো মন দিয়েছেন। তাদের পক্ষ থেকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না করার কোনো বক্তব্য নেই। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, তা মেনে নিয়েই নির্বাচনি কাজ করছেন। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী পুরোদমে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের উপস্থিতিতে এলাকার জনপদ সরগরম হয়ে উঠছে। প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে দৌড়ঝাঁপও করছেন তারা। তাই কে আটকাবে নির্বাচন?

অবশ্য নির্বাচনের জন্য একটি বড় বাধা হতে পারে পলাতক শেখ হাসিনা ও তার রাজনৈতিক মুরুব্বি প্রতিবেশী ভারত। আসন্ন নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্য দিল্লিতে বসে কলকাঠি নাড়ছেন শেখ হাসিনা। প্রতিবেশী ভারতের ডিপ স্টেটও সক্রিয়। শেখ হাসিনা দেশের অভ্যন্তরে যেমন দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে ঝটিকা মিছিল করিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চাচ্ছেন, তেমনি ভারতের ডিপ স্টেট দেশের কিছু ব্যক্তিকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছে—‘১/১১-এর আদলে আরেকটি সরকার হবে দেশে, নির্বাচন হচ্ছে না।’ তাদের কিছু কিছু তৎপরতাও অনেকের চোখে পড়েছে। একজন টিভি ব্যক্তিত্বের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফটোকার্ড ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। একজন অর্থনীতিবিদও সরকারের খুব সমালোচনা করছেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পর তারা কিছুটা চুপ। শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েই চলেছেন। তার টেলিফোন নির্দেশনা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্কে নেতাকর্মীদের তিনি বলেছিলেন, ড. ইউনূসের সঙ্গী একজনও যেন বাংলাদেশে ফেরত না আসে। এ বক্তব্যের পর নিউইয়র্কে আওয়ামী নেতাকর্মীরা বেদম পিটুনির শিকার হন। শেখ হাসিনার জ্বালা অন্য। তার বিচার শেষ পর্যায়ে। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রায় ঘোষিত হবে। ইতোমধ্যে গণহত্যার সব প্রমাণ একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার নৃশংসতার আলামত প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। তিনি যে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন, মানুষ হত্যা করতে বলেছেন, তার সেই কণ্ঠ সবাই শুনছে। এসব দালিলিক প্রমাণ বেরিয়ে যাওয়ায় তিনি রীতিমতো বিচলিত। এজন্যই দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। নির্বাচন বানচাল করতে দিল্লি থেকে ষড়যন্ত্র করছেন। কলকাতায় ৭৩৪ জন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা, আওয়ামী পুলিশ ও সেনাকর্মকর্তা বসবাস করছেন। তারা কোথায় আছেন, তার নাম-ঠিকানা ও তৎপরতা আমাদের কূটনৈতিক রিপোর্টার বশীর আহমেদের হাতে এসেছে। তারা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। পতিত শেখ হাসিনার নির্দেশে তারা দেশকে অশান্ত করতে এবং নির্বাচন বানচালে যত ষড়যন্ত্রই করুন, লাভ হবে না। বাংলাদেশের মানুষ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনা ও পলাতক আওয়ামী নেতাদের এই আশা পূরণ হতে দেবে না।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ

abdal62@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত