আজ থেকে ১৭ বছর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১/১১-এর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে পিজি হাসপাতালে অসুস্থ বড় ছেলে তারেক রহমানকে দেখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আর ১৭ বছর পর ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান স্বদেশে ফিরে এসে হাসপাতালে যাবেন মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে। মা ও ছেলের এমন সাক্ষাতের ঘটনাটি হবে যেন এক বিষাদসিন্ধু, যেখানে কথা নেই, শুধু থাকবে হৃদয়ের অব্যক্ত আর্তনাদ। তবে তারেক রহমান জননী জন্মভূমি দেশকে যদি সত্যিকারভাবে গড়ে তুলতে পারেন, সেটাই হয়তো হবে মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মায়ের স্বপ্নের সার্থক বাস্তবায়ন।
১৭ বছর পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছরেরও বেশি সময় লন্ডনে নির্বাসনে থাকার পর ২৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করবেন। বাংলাদেশ বিমানের একটি নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটে স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমানসহ পরিবারের পাঁচজনকে নিয়ে তিনি ঢাকায় অবতরণ করবেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি যাবেন ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে মা খালেদা জিয়াকে দেখতে। ঘটনাটি যেন ঠিক ১৭ বছর আগের মতোই। সেদিন হাসপাতালে তারেক রহমানকে দেখতে গিয়েছিলেন মা খালেদা জিয়া। আর আজ মুমূর্ষু মা খালেদা জিয়াকে দেখতে এসেছেন ছেলে তারেক রহমান। হয়তো সেদিন ছেলেকে অপলক তাকিয়ে দেখবেন মা। কারণ কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। আবেগঘন এই মুহূর্ত কাটিয়ে তারেক রহমান আসবেন পূর্বাচলের ৩০০ ফিট রাস্তায় তার জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। এই ১৭ বছরে তারেক রহমান অনেক কিছু হারিয়েছেন। ২০১৫ সালে ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। তার জানাজায়ও শরিক হওয়ার সুযোগ পাননি। মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন দীর্ঘদিন। শেখ হাসিনার কারাগারে মা যখন বন্দি, নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করছেন, দূরের প্রবাসে থেকে মায়ের জন্য তার মনটা ছটফট করেছে। অজানা আশঙ্কায় অস্থির ছিলেন। জেলে থাকার সময় নানিকেও হারিয়েছেন তিনি। সরাসরি রাজপথে থেকে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি। ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নেতাকর্মী ও জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেও গণমাধ্যমে তার কথা প্রচারের ওপর অন্যায়ভাবে আইনি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ সময়টিতে বাংলাদেশের মাটি, পরিচিত পরিবেশ, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তারেক রহমান। তবে মানসিকভাবে সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। প্রতিকূলতা ও মামলার বোঝা মাথায় নিয়েও লন্ডনে একটি ছোট ঘরে বসে ভার্চুয়ালি দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। নিজেকে নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে তিনি জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিলেন। গত বিজয় দিবসে লন্ডনে তার যে বিদায় সংবর্ধনা হয়, সেখানে তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছেন, তিনি সুস্থ ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বদেশে ফিরছেন। তবে লন্ডনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা ও স্মৃতি তিনি তার হৃদয়ে লালন করে দেশে যাচ্ছেন।
তারেক রহমানের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন
১/১১-এর জরুরি সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করার পর রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাকে চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়, উঁচু থেকে সিমেন্টের মেঝেতে ফেলে দিয়ে কোমরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়, দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই চোখ বেঁধে রাখা হয়। তার মেরুদণ্ডের ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে যায়। কারণ মেরুদণ্ডের ৬ ও ৭ নম্বর হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এই ভয়াবহ নির্যাতনের ফলে তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না, বসতে পারতেন না। হুইলচেয়ার ও স্ট্রেচারই ছিল চলাফেরার উপকরণ। তার ডান পায়ের পেশি শুকিয়ে গিয়েছিল, যার কারণে পঙ্গুত্বের ঝুঁকি ছিল। নির্যাতনের ফলে ব্যথায় তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। পেইন কিলার সেবনের কারণে তার কিডনিও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রিজন সেলের টয়লেটে পড়ে গিয়ে তখন মাথায়ও প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। এ জন্য লন্ডনে তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হয়েছে। লন্ডনে ওয়েলিংটন হাসপাতাল, হ্যামারস্মিথ হাসপাতাল, কিংস ওক হাসপাতাল ও লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা হয়েছে। মেরুদণ্ডের একাধিক অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি তাকে দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি দিতে হয়েছে। লন্ডনে পৌঁছার পরই তিনি বিশেষায়িত ফিজিও থেরাপি এবং নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসা নেন। এর ফলে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
লন্ডনে জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানোর আগে কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়েছিল। জেল হাসপাতালের চিকিৎসক এবং গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তাকে পরীক্ষার পর যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল, তাতেও তার ওপর এই শারীরিক নির্যাতনের বিবরণ ছিল। প্যারোলে জামিন নেওয়ার সময় আদালতে দাঁড়িয়ে তারেক রহমান নিজেও তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের কথা বিচারকের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ১/১১-এর কারাগারে বন্দিত্বের সময় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদকালে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হয়। দিনের ১৮ ঘণ্টাই তিনি নিগৃহীত হতেন এবং নিষ্ঠুরভাবে তাকে মারধর ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হতো।
গ্রেপ্তারের সেই মুহূর্ত
সেনাসমর্থিত ১/১১-এর জরুরি সরকারের যৌথবাহিনী ২০০৭ সালের ৭ মার্চ রাতে তারেক রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ মঈনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। অজুহাত হিসেবে তার বিরুদ্ধে আনা হয় দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ। সেই থেকে ৫৫৪ দিন (১৮ মাস) তিনি ১/১১-এর কারাগারে ছিলেন। গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘ওনারা আমাকে নিতে এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমার জন্য দোয়া করবেন।’ তাকে ধৈর্য ধারণ করে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা এবং সবসময় আয়তুল কুরসি পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তার বাসা থেকে তখন জানতে পারি, তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। মা খালেদা জিয়া তখন অঝোরে কাঁদছিলেন এবং তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করছিলেন। তারেক রহমানকে গ্রেপ্তারের পর ১/১১-এর জরুরি সরকার তার নামে ৮৪টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেয়। এসব মামলার মধ্যে অন্যতম ছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা, মানি লন্ডারিং ও চাঁদাবাজির মামলা। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় তাকে অন্যায়ভাবে দণ্ডও দেওয়া হয়। কিন্তু জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর আদালতের শুনানিতে একটি মামলাও টিকেনি। প্রমাণিত হয় মামলাগুলো ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সবগুলো মামলায় তিনি বেকসুর খালাস পান। তেমনি হাওয়া ভবন নিয়ে যেসব গল্প ছড়ানো হয়েছিল, সেগুলোও অসার প্রমাণিত হয়।

পিজি হাসপাতালে মা-ছেলের সেই হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ১/১১-এর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পিজি হাসপাতালে এসেছিলেন বড় ছেলে অসুস্থ তারেক রহমানকে দেখতে। সেই ঘটনা অন্য অনেকের মতো আমাকেও কাঁদিয়েছিল। সেই দৃশ্য ছিল হৃদয়স্পর্শী। নির্যাতনে নিষ্পেষিত মুমূর্ষু তারেক রহমান হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন। মা এসেছেন কিন্তু মায়ের বুকে মাথা রাখার ক্ষমতা তার ছিল না। মায়ের দিকে অসহায়ভাবে শুধু চেয়ে রইলেন তিনি। অনেকটা বাকরুদ্ধ ছিলেন। ছেলের এই অবস্থা দেখে অঝোরে কাঁদছিলেন খালেদা জিয়া। একপর্যায়ে তিনি মাথা নুইয়ে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় সন্তানকে। উভয়েই কাঁদছিলেন। দৃশ্যটি ছিল বুকফাটা হাহাকারের। স্ট্রেচারই তখন মুমূর্ষু তারেক রহমানের বিছানা। মুমূর্ষু ছেলের শীর্ণদেহ আর যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে একজন মায়ের মনে যে হাহাকারের সৃষ্টি হয়, তা দেখে মনে হয়েছে তৎকালীন পিজি হাসপাতালের ওই কক্ষটির পাষাণ দেয়ালকেও যেন কাঁদিয়েছিল। সেই দৃশ্য ছবি ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের মানুষ দেখে তারাও মর্মাহত হয়েছিলেন। ১৮ মাস বিচ্ছিন্ন থাকার পর সেদিন মা ও ছেলের এই করুণ মিলনের ঘটনা সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে তুলেছিল।
জরুরি সরকারের সময় গ্রেপ্তারের পর তারেক রহমান ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারোলে তিনি জামিন পান। জরুরি সরকার তাকে লন্ডনে জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি মুচলেকাতেও স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয় এই বলে যে, তিনি আর রাজনীতি করতে পারবেন না। জামিন পাওয়ার আট দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালের রাতে স্ত্রী-কন্যাসহ তাকে বিমানে করে লন্ডনে পাঠানো হয়। এর আগে পিজি হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। স্ট্রেচারে করে তোলা হয় বিমানে। সেদিন মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমরা কয়েকজন সাংবাদিকও পিজি হাসপাতালের কক্ষে গিয়ে তাকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। দিনকালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস এবং নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলীও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাকে সমবেদনা জানিয়ে মনোবল দৃঢ় রাখতে বললাম। তিনি শুধু বললেন, দোয়া করবেন। আজ তিনি রাজনীতির আলোকিত এক মানুষ, জাতীয় নেতা হিসেবে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিতে আসছেন।
লন্ডনের অভিজ্ঞতা
তারেক রহমান ২০০৮ থেকে প্রায় ১৭ বছর লন্ডনে প্রবাস জীবন কাটিয়ে ব্রিটিশ গণতন্ত্র, গণমাধ্যম এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তার বিভিন্ন সভা ও সাক্ষাৎকারে এই অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লক্ষ করেছেন, ব্রিটেনের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। সেখানে শক্তিশালী জবাবদিহি বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশে এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে শাসকগোষ্ঠী জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। লন্ডনে অবস্থানকালে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। তার বিশ্বাস, গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য এবং গণমাধ্যমকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের সেবায় কাজ করতে হবে।
তারেক রহমান ব্রিটিশ সমাজের পরিচ্ছন্ন সড়ক, সামাজিক সুবিধা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটিও পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরা যখন ব্রিটেনের এই উন্নত জীবনমান দেখেন, তখন তারা নিজ দেশকেও একইভাবে গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা পান। তিনি ব্রিটিশব্যবস্থার আধুনিকতা ও বহুমুখিতাকে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন এবং বাংলাদেশের পুরোনো রাজনৈতিক সংস্করণের পরিবর্তে একটি আধুনিক ও জনকল্যাণমুখী ব্যবস্থা প্রবর্তনের তার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ব্যক্তিগত সমালোচনার প্রতি ব্রিটিশদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আকৃষ্ট করেছে। এর উদাহরণ হিসেবে জুলাই বিপ্লবের পরপর তিনি নিজের একটি কার্টুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে বাংলাদেশে পরমতসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তারেক রহমানের দেশ গড়ার পরিকল্পনা
তারেক রহমান তার বাবা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ‘১৯ দফা’ এবং মা খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’-এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার ও আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটাকেই তিনি তার দল বিএনপির বর্তমান ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ বা ভিশন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গণতন্ত্রের দুই মহান নেতা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আদর্শে একটি সমন্বিত সংস্করণই এই তারেক রহমানের দেশ গড়ার পরিকল্পনা। তারেক রহমান ‘রেইনবো নেশন’ বা রংধনু রাষ্ট্র (অন্তর্বর্তীমূলক সমাজ) গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, যেখানে প্রতিহিংসার রাজনীতির বদলে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হওয়ার কথা বলেছেন। এতে সব ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ২০১৮ সালের পর তারেক রহমানের চিন্তা রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে রূপ পায়। পরে জুলাই বিপ্লবের পর আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব সংস্কার প্রস্তাব ঘোষিত হয়েছে, তার সবই ৩১ দফায় আছে। এর মূল বিষয়গুলো হলোÑপ্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা, টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, দ্বিকক্ষের সংসদ বা আপার হাউসের ধারণা, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল করা, বিচার বিভাগ, দুদক ও নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি সেবা সহজ করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। তারেক রহমান উৎপাদনমুখী শিক্ষার জন্য জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া প্রবর্তিত শিক্ষার আদর্শকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছেন। শহীদ জিয়ার শুরু করা খাল খনন কর্মসূচিকে আধুনিক রূপে ফিরিয়ে আনতে ২০ হাজার কিলোমিটার খাল খনন এবং ৫ বছরে ২৫ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। সামাজিক ব্যবস্থা উন্নত এবং নারী সমাজকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তিনি ঘোষণা করেছেন, দেশব্যাপী দুস্থ অসহায় পরিবারের জন্য প্রায় চার কোটি ‘ফ্যামিলি কার্ড’ বিতরণ করবেন। এই ফ্যামিলি কার্ড নারীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে, যাতে পরিবারগুলো সরাসরি আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতা পায়। তিনি কৃষক কার্ড চালু করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, যাতে প্রান্তিক কৃষকরা সার, বীজ, কীটনাশক এবং ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। ‘সবার আগে বাংলাদেশ’Ñএই স্লোগানে তিনি তার দেশ গড়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। এই স্লোগানের সারমর্ম হচ্ছে, দেশপ্রেম। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কোনো আপস নেই। বিদেশি শক্তির কাছে মাথা নত নয়। সবার আগে বাংলাদেশ স্লোগানে তিনি বলতে চেয়েছেন, দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে দেশের কল্যাণ বড়। তার পিতার ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে’র দর্শনই দেশের রক্ষাকবচ। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তার অধিকারী হবেন স্লোগানটির মাধ্যমেÑসেটাই জানান দিয়েছেন তিনি।
১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনে তিনি তার মায়ের মতোই গণতন্ত্রের প্রশ্নে অনড় থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ভার্চুয়ালি নেতৃত্ব দিয়েছেন। চব্বিশের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা দেখেছি, মেয়ে জাইমাকে পাশে বসিয়ে তিনি আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। জাইমা এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি। তার বক্তব্যে আমরা লক্ষ করেছি, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, প্রতিশোধ নয়, আইনের শাসন। শক্তি কিংবা ভয় দেখিয়ে নয়, ইনসাফ ও উদারতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা, মর্যাদা, অধিকার ও সেবার ব্রত নিয়ে বাংলাদেশে তিনি কাজ করবেন।
আজ এক ক্রান্তিকাল চলছে। দেশে অরাজকতা চালানোর প্রয়াস চলছে। শক্ত হাতে দেশের হাল ধরতে হবে। যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা, অবাধ সুষ্ঠু সেই নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। নির্বাচিত সরকার আসার মাধ্যমেই দেশের ঐক্য-সংহতি রক্ষা হবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ
Abdal62@gmail.com
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

