‘ঘোষণা’-এর দায়
‘শুরু থেকে ছত্রিশ জুলাই নাগাদ’ বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তার জন্য একটি ‘ঘোষণা’ অনিবার্য। এই ঘোষণা কার্যত এক ‘স্বীকৃতি’। স্বীকার করতে হবে, সেই ঘোষণায়, ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে অর্জন করা ‘স্বাধীনতার বিজয়’ বাংলাদেশের যৌথ অর্জন, জনগণের অর্জন। এই অর্জন করতে গিয়ে যা কিছু ঘটেছে, তা বাংলাদেশের জনগণের সম্মতিতে ঘটেছে। এই জনগণ বাংলাদেশের ‘মালিক’ (ওনার)। তাই জনগণের সম্মতিতে ঘটে যাওয়া ‘সবকিছু’ বৈধ। চিরকালীন বৈধ। কারণ তা ঘটেছে এই মালিক জনগণের ইচ্ছে না উইল বাস্তবায়নের জন্য। তা-ই জনগণের ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (জেনারেল উইল)-এর প্রকাশ। একটি ‘রিপাবলিক বা জনতন্ত্রে’ জনগণের ইচ্ছাই সার্বভৌম, শেষ বিধান। তাই সেসব ঘটনা, কখনো-কোনোভাবে-কোনো আদালতে, অভিযোগযোগ্য নয়। বিদ্যমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এর সরকার (কার্যত এর নির্বাহী বিভাগ) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যসব অংশীদের নিয়ে এ ঘোষণা দেবে, স্বীকৃতি দেবে।
স্বীকৃতির এই ‘আনুষ্ঠানিকতা’ বা প্রকাশ না ঘটালে ঝুঁকি থেকে যাবে। ঝুঁকি থাকবে এই গণঅভ্যুত্থানের বীর নায়কদের জন্য, এর কর্মী-সমর্থকদের জন্য। তা ঘটতে পারে কিঞ্চিৎ ‘দূর ভবিষ্যতে’। এমনটি ঘটেছে ‘আগের আগস্টের’ বেলায়। সেই ভুল, সেই অবহেলা, সেই অপরাধ আর নয়, কোনোভাবেই নয়।
সংযমী নেতৃত্ব
অন্তর্বর্তী সরকারের (পড়ুন ‘নির্বাহী বিভাগ’) কথিত ‘নিরপেক্ষতা’, দাবি করা নতুন দল, অভিযুক্ত ‘কিংস পার্টি’ এবং তাতে ‘তিন ছাত্র উপদেষ্টার’ সম্ভাব্য অংশগ্রহণ নিয়ে একটি বিতর্ক হয়ে গেল। একদিকে ছাত্র উপদেষ্টারা অন্যপক্ষে ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি মহাসচিব। এ বিতর্কে দাবি ছিল, দাবি খণ্ডন ছিল, ‘নতুন তথ্য’ ছিল, তা নিয়ে ঝুঁকি ছিল। ‘চট করে ঢুকে পড়া’-এর আশঙ্কা বহুজনকে তাড়িয়ে ফেরে, ন্যায্যতই।
তবে আশার কথা, আনন্দের বিষয়, তর্কের পক্ষ সিনিয়র রাজনীতিকরা সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। তর্কের লাগাম টেনেছেন। উল্লেখযোগ্য ভালো উদাহরণ তৈরি করলেন তারেক রহমান। তিনি চমৎকার সহনীয় উচ্চারণে তর্কের ‘দুই পক্ষকেই’ দরদের সঙ্গে এই বিতর্ক থেকে নিবৃত্ত করলেন। অনেকটা ‘সব কূল রক্ষা’-এর মতো। সঙ্গে বললেন, ‘দেশের তরুণরা রাষ্ট্ররাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। এই তরুণরা গত দেড় দশকে একটি নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত এই তরুণদের কেউ যদি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে, বিএনপি সেই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।’
তারেকের এই পর্যবেক্ষণ ও বিবৃতি বিশেষভাবেই উদার। তাই তা প্রশংসাযোগ্য। তিনি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের কাঙ্ক্ষিত অবসানে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখলেন, অবদান রাখতে সক্ষম হলেন।
বিএনপির প্রতি ভালোবাসার দায়
দল হিসেবে বিএনপির প্রতি ভালোবাসা আছে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির। এই ভালোবাসার উৎস শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং আপসহীন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। দলটিকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন কার্যত, (ড্য ফ্যাক্টো, ‘জনপ্রিয় উচ্চারণ’ ডি ফ্যাক্টো। শুদ্ধ উচ্চারণের পরিচিত নমুনা চার্লস ‘ড্য গল’, ‘ডি গল’ জনপ্রিয় হয়নি, ভাগ্যিস। ‘ডি ফ্যাক্টো’ একটি ‘ফ্র্যাংলা’, ‘ফ্র্যাঞ্চ+বাংলা’, বাংলা টেক্সট/পাঠ্যবই ‘রচনাকারীদের অবদানে সৃষ্ট, ‘বাংলিশ’ অনুকরণে) তারেক রহমান। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির সুনির্দিষ্ট অভিযোগও আছে এই দলটির নেতাকর্মীদের বিষয়ে। অভিজ্ঞতা বলে, বস্তুগত লেনদেন ও আচরণের বেলায় তাদের সঙ্গে ধীকৃত, পরাজিত ও পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পাওয়া যায় না। তারা ওদের মতোই, প্রায়, একেকজন জঘন্য ব্যক্তি। লোকরা উপহাস-নিন্দা (ট্রল?) করছে। বলছে, ‘টেম্পোস্ট্যান্ড পার্টি', বলছে ‘চাঁদাবাজির শুধু হাত বদল হয়েছে’। এই সর্বগ্রাসী চাঁদাবাজি নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়াচ্ছে, গণপরিবহনের ভাড়া বাড়াচ্ছে, ‘সিএনজিকে ঘোষিত ভাড়ায়’ চলতে দিচ্ছে না এবং আরো বহুমাত্রিক সমস্যা-জটিলতার উৎস এই চাঁদাবাজি। দাবি করা অভিযোগটি শুদ্ধ হয়ে থাকলে, পলাতক আওয়ামী গুণ্ডাদের শূন্যস্থান ‘কথিত বিএনপি নেতাকর্মীরা’ দখল করে থাকলে, বিএনপির নেতৃত্বের বিশেষ দায় আছে, এ সমস্যার সমাধান করায়।
সন্দেহ নেই, তারেক রহমান ইতোমধ্যে স্পষ্ট উচ্চারণে তার দলীয় নেতাকর্মীদের এ যাবতীয় অনাচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং এমন অভিযোগে কয়েক শ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দলীয় শাস্তি আরোপ করেছেন। এগুলো সবই প্রশংসাযোগ্য পদক্ষেপ। বিএনপিকে ভালোবাসা জনগণের প্রতি দায় পূরণের জন্য এর নেতৃত্বকে আরো কঠোর এবং দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দৃশ্যমান শাস্তি মানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশবাসী ও পর্যবেক্ষকরা দেখতে সক্ষম হবেন দোষী বিএনপিদলীয় নেতাকর্মীরা শাস্তি ভোগ করছেন দলীয় কর্তৃত্বের আওতায়। একটি ‘রাজনৈতিক ইচ্ছা’ (পলিটিক্যাল উইল) যে একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে সক্ষম ভূমিকা পালন করতে পারে, তারেক রহমান তেমন একটি ‘উদ্ধৃতিযোগ্য’ উদাহরণ সৃষ্টির ভালো পরিবেশ পেয়েছেন, আমি মনে করি। তিনি এর সদ্ব্যবহার করতে পারলেন কি না, কাছাকাছি সময়েই তা স্পষ্ট হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

