সালেহ উদ্দিন সিফাত
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেড় যুগ ধরে চলা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয় এবং এমপি-মন্ত্রীসহ ফ্যাসিবাদী রেজিমের অধিকাংশ অংশীদার বিদেশে, বিশেষত ভারতে পালিয়ে যান। অভ্যুত্থানের সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষ বিগত ১৫ বছরে সংঘটিত সেনা হত্যাকাণ্ড, শাপলা ম্যাসাকার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারের কথা বলে আসছে। তবে ছাত্ররা এ ক্ষেত্রে ইউনিক প্রস্তাবনা এনেছে। তারা শুধু আওয়ামী লীগের বিচারই চাচ্ছে না; বরং যে মতাদর্শ, বয়ান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চিহ্ন আওয়ামী লীগের মতো গণবিরোধী দল এবং বাকশাল-ফ্যাসিবাদ তৈরি করেছে এবং গড়ন দিয়েছে, সেসব মতাদর্শ, বয়ান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চিহ্নকেও চিরতরে বিলোপের কথা বলছে।
জুলাইয়ে এমন অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সুশীলসমাজ, গবেষক ছাত্র-জনতার ওপর চলা গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বিচার দাবিতে সরব হয়েছিলেন, যারা বিগত ফ্যাসিবাদী জমানায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রণীত বয়ানের পক্ষে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন জুগিয়েছিলেন। সম্প্রতি এমন কেউ কেউ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে বাধা দেওয়াকে ‘অগণতান্ত্রিক’ মনে করছেন। এমনকি অনেকে আগ বাড়িয়ে ‘ফ্যাসিবাদী আচরণ’ও বলছেন। অথচ যেসব মতাদর্শ, চিন্তা, চিহ্ন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, তার বিরুদ্ধে তাদের কোনো বয়ান নেই। যেন শুধু আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী-নেতাকর্মীদের ফৌজদারি বিচারের মধ্য দিয়ে একটি ‘পরিশোধিত আওয়ামী লীগ’ পাওয়া যাবে। ওনাদের চোখে ‘আওয়ামী লীগ’কে মূলত কলুষিত করা হয়েছিল। সুতরাং, বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে কলুষ ও পাপপঙ্কিলতা মুক্ত করা যাবে। এই চিন্তার সুর ফ্যাসিবাদী জমানায় ‘আপাকে ভুল বোঝানো হয়েছে’ রাজনীতির সমার্থক। আওয়ামী লীগের ফৌজদারি বিচার অবশ্যই একমাত্র আশু কর্তব্য। কিন্তু যেসব মতাদর্শিক পাটাতন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি আওয়ামী লীগকে ৭১-পরবর্তী সময়ে বাকশাল গঠনে এবং বিগত দেড় যুগ ধরে চলা ফ্যাসিবাদ কায়েমের ভিত্তিমূল তৈরি করে দিয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিলে আওয়ামী লীগ নিজের নামে না হলেও একই গণবিধ্বংসী মতাদর্শ ও সংস্কৃতি নিয়ে ফের ফিরে আসবে এবং নাগরিকদের রক্তপাত করবে। ফলে আওয়ামী লীগের জুলুম-শোষণ ও ফ্যাসিবাদী কায়েমের খায়েশের সঙ্গে এর মতাদর্শে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য কারণÑফল সম্পর্ককে খারিজ করার কোনো সুযোগ নেই।
বহুত্ববাদের পরিবর্তে জনগণকে ‘আওয়ামী লীগ’ বানানো এবং এর বিরোধী মতাবলম্বীদের নাগরিক পরিচয় খারিজ করার আওয়ামী রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং এর থেকে উদ্ভূত খুনখারাবি, লুটপাট ও তার বৈধতা উৎপাদনের আওয়ামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আজতক বিদ্যমান। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল কায়েম, রক্ষীবাহিনী গঠন এবং অগণিত জাসদ নেতাকর্মীদের (যাদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন) হত্যার পরও শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ তকমা নিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ক্ষমাপ্রার্থনা ও বিচার ব্যতিরেক অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। আওয়ামী রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সংস্কৃতিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে মোকাবিলা না করায় বাকশালের পতনের পরও হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েমের সুযোগ পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শুধু খুন করতেই উৎসাহিত করে না; খুনের বৈধতাও উৎপাদন করে। বিগত দেড় যুগে কখনো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, কখনো উন্নয়নবিরোধী, কখনো সাম্প্রদায়িক শক্তি, কখনো জঙ্গিবাদী তকমা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক মত-পথকে দমন ও নিঃশেষ করেছিল আওয়ামী লীগ। এই বয়ান প্রতিষ্ঠায় আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবীদের অবদানও কম নয়। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একমাত্র শক্তি(!)’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে এমনকি ভোটডাকাতিরও বৈধতা দিয়েছেন, পাছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি ক্ষমতা দখল করে! এই জুজু বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
শুরুটা হয়েছিল এই জনপদের মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি নৃ-তাত্ত্বিক বহুত্ববাদী পরিচয় ও চেহারাকে ভেঙে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নামক একক পরিচয় ও চেহারা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এই তথাকথিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’র মধ্যেই বাকশাল ও পরে ফ্যাসিবাদ কায়েমের সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। তদুপরি, বিগত দেড় যুগ ধরে ১৯৭১-এর জনযুদ্ধের ওপর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে নিজেদের একক ও একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বদলে নিজেদের দলীয় মূলনীতিকে মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে ফ্যাসিবাদী জমানায় যেকোনো আওয়ামী বিরোধী মতকে দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা। ফ্যাসিবাদী জমানায় বিরোধী মতের বিরুদ্ধে পুলিশের করা শতকরা ৯০ ভাগ মামলার এজাহারে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’র অভিযোগ পাওয়া যাবে। আওয়ামী বয়ানে আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক ও বাহক এবং আওয়ামী বিরোধিতাকারীরা অপরিহার্যভাবেই মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রবিরোধী। ফলত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ জিয়াউর রহমানকে ‘রাজাকার’ কিংবা ‘পাকিস্তানি চর’ বললেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কোনো আঘাত লাগত না। এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক মহলেও কোনো নিন্দার ঝড় উঠত না।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি দিক জাতির জনযুদ্ধকে পুঁজি করে আওয়ামীবিরোধী মতকে ঊনমানুষে পরিণত করা বা বিমানবীকরণ। কাউকে ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি খুন করার বৈধতাও উৎপাদন করা হয়েছে। এই অপরাজনীতি থেকে হিন্দু-মুসলিম কেউই রেহাই পাননি। জুলাই অভ্যুত্থানে খুনি হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলার মধ্য দিয়ে তাদের খুনের বৈধতা উৎপাদন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এবার সেই অস্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, খুনের বৈধতা উৎপাদনের রাজনীতির কার্যকারিতা নির্ভর করে এ রাজনীতির সপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্মতি বিদ্যমান থাকার ওপর। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে এই অপরাজনীতির কার্যকারিতা হাজির ছিল। অর্থাৎ, বিরোধী মতকে ঊনমানুষে পরিণত করে হত্যাযোগ্য করার ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উপাদান ও ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল। এ কারণেই আওয়ামী লীগের শাসনামল স্বৈরতন্ত্র না; বরং স্পষ্ট ফ্যাসিবাদ। এই অপরাজনীতি প্রথম ধাক্কা খায় বিশ্বজিৎ হত্যায় এবং বুমেরাং হয়ে যায় আবরার ফাহাদ হত্যার মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ, জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনার ‘রাজাকার’ তকমা দেওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা এই বিমানবীকরণের রাজনীতিকে উৎখাত করে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুনখারাবি এবং তার বৈধতা উৎপাদনের ইতিহাসে সমৃদ্ধ। দেড় যুগ ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দল-মত এবং সাধারণ জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন-ধর্ষণ, সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতি, সেনা কর্মকর্তা হত্যা, শাপলা ম্যাসাকার, এবং সর্বশেষ জুলাই গণহত্যা সংঘটিত করার পরও দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কারো মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা-অনুতাপের চিহ্নটুকুও নেই। সম্প্রতি এক ভারতীয় পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই পতিত ফ্যাসিবাদী দলের নেতা ও জুলাই গণহত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা আসাদুজ্জামান খান কামাল গণঅভ্যুত্থানকে ‘একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ এবং ইসলামি উগ্রবাদ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভ্যুত্থান হিসেবে উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ, জনতার অভূতপূর্ব স্ফূরণের যথেষ্ট পূর্ব সংকেত পেলে, সে ও তার নেত্রী আরো খুন করত। সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্যরা জনতার বুকে গুলি চালাতে অস্বীকার করায় তাদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার এবং পাল্টা বয়ান তৈরি করছে তারা। এ ছাড়া হাজার হাজার থানা পোড়ানো, অস্ত্র লুট ও পুলিশ হত্যার বিকৃত ও আজগুবি তথ্যপ্রচারের মধ্য দিয়ে পাল্টা বয়ান তৈরি করে অভ্যুত্থানের সব শক্তি এবং জনতার বুকে গুলি চালানোর আদেশ অমান্য করা সেনা সদস্যদেরও ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করছে খুনি লীগ। অন্যদিকে, মাঠপর্যায়ে গোপালগঞ্জ, গাজীপুরসহ আরো নানা স্থানে নিষিদ্ধ ফ্যাসিবাদী সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বিভিন্ন শক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুপ্ত ও প্রকাশ্য হামলা জারি রেখেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও প্রতীককে উচ্ছেদকারী প্রত্যেক নাগরিকের তালিকা করছে পলাতক খুনিরা। এর থেকে রেহাই পাননি প্রেসসচিব ও তার পরিবারের সদস্যরাও।
আওয়ামী লীগের এমন রক্তপিপাসু চিত্র চোখে দেখার পরও ইদানীং কেউ কেউ ‘ভালো আওয়ামী লীগ’ বলে বায়বীয় একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আওয়ামী মতাদর্শ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাটাতনে প্রতিষ্ঠিত যেকোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ বাকশাল অথবা ফ্যাসিবাদে পর্যবসিত হতে বাধ্য। আর ‘ভালো ফ্যাসিবাদ’ বলতে দুনিয়ায় কিছু নেই। ফলে আওয়ামী লীগের শুধু ফৌজদারি বিচার নয়; বরং যেসব ভাবাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক পাটাতনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ বাকশাল-ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, সেগুলো চিরতরে উৎখাত করাই হবে এখনকার কর্তব্য।
লেখক : সহ-মুখপাত্র, জাতীয় নাগরিক কমিটি
ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেড় যুগ ধরে চলা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয় এবং এমপি-মন্ত্রীসহ ফ্যাসিবাদী রেজিমের অধিকাংশ অংশীদার বিদেশে, বিশেষত ভারতে পালিয়ে যান। অভ্যুত্থানের সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষ বিগত ১৫ বছরে সংঘটিত সেনা হত্যাকাণ্ড, শাপলা ম্যাসাকার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারের কথা বলে আসছে। তবে ছাত্ররা এ ক্ষেত্রে ইউনিক প্রস্তাবনা এনেছে। তারা শুধু আওয়ামী লীগের বিচারই চাচ্ছে না; বরং যে মতাদর্শ, বয়ান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চিহ্ন আওয়ামী লীগের মতো গণবিরোধী দল এবং বাকশাল-ফ্যাসিবাদ তৈরি করেছে এবং গড়ন দিয়েছে, সেসব মতাদর্শ, বয়ান, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চিহ্নকেও চিরতরে বিলোপের কথা বলছে।
জুলাইয়ে এমন অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সুশীলসমাজ, গবেষক ছাত্র-জনতার ওপর চলা গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বিচার দাবিতে সরব হয়েছিলেন, যারা বিগত ফ্যাসিবাদী জমানায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রণীত বয়ানের পক্ষে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন জুগিয়েছিলেন। সম্প্রতি এমন কেউ কেউ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে বাধা দেওয়াকে ‘অগণতান্ত্রিক’ মনে করছেন। এমনকি অনেকে আগ বাড়িয়ে ‘ফ্যাসিবাদী আচরণ’ও বলছেন। অথচ যেসব মতাদর্শ, চিন্তা, চিহ্ন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, তার বিরুদ্ধে তাদের কোনো বয়ান নেই। যেন শুধু আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী-নেতাকর্মীদের ফৌজদারি বিচারের মধ্য দিয়ে একটি ‘পরিশোধিত আওয়ামী লীগ’ পাওয়া যাবে। ওনাদের চোখে ‘আওয়ামী লীগ’কে মূলত কলুষিত করা হয়েছিল। সুতরাং, বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে কলুষ ও পাপপঙ্কিলতা মুক্ত করা যাবে। এই চিন্তার সুর ফ্যাসিবাদী জমানায় ‘আপাকে ভুল বোঝানো হয়েছে’ রাজনীতির সমার্থক। আওয়ামী লীগের ফৌজদারি বিচার অবশ্যই একমাত্র আশু কর্তব্য। কিন্তু যেসব মতাদর্শিক পাটাতন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি আওয়ামী লীগকে ৭১-পরবর্তী সময়ে বাকশাল গঠনে এবং বিগত দেড় যুগ ধরে চলা ফ্যাসিবাদ কায়েমের ভিত্তিমূল তৈরি করে দিয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিলে আওয়ামী লীগ নিজের নামে না হলেও একই গণবিধ্বংসী মতাদর্শ ও সংস্কৃতি নিয়ে ফের ফিরে আসবে এবং নাগরিকদের রক্তপাত করবে। ফলে আওয়ামী লীগের জুলুম-শোষণ ও ফ্যাসিবাদী কায়েমের খায়েশের সঙ্গে এর মতাদর্শে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য কারণÑফল সম্পর্ককে খারিজ করার কোনো সুযোগ নেই।
বহুত্ববাদের পরিবর্তে জনগণকে ‘আওয়ামী লীগ’ বানানো এবং এর বিরোধী মতাবলম্বীদের নাগরিক পরিচয় খারিজ করার আওয়ামী রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং এর থেকে উদ্ভূত খুনখারাবি, লুটপাট ও তার বৈধতা উৎপাদনের আওয়ামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আজতক বিদ্যমান। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল কায়েম, রক্ষীবাহিনী গঠন এবং অগণিত জাসদ নেতাকর্মীদের (যাদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন) হত্যার পরও শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ তকমা নিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ক্ষমাপ্রার্থনা ও বিচার ব্যতিরেক অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। আওয়ামী রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সংস্কৃতিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে মোকাবিলা না করায় বাকশালের পতনের পরও হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েমের সুযোগ পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শুধু খুন করতেই উৎসাহিত করে না; খুনের বৈধতাও উৎপাদন করে। বিগত দেড় যুগে কখনো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, কখনো উন্নয়নবিরোধী, কখনো সাম্প্রদায়িক শক্তি, কখনো জঙ্গিবাদী তকমা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক মত-পথকে দমন ও নিঃশেষ করেছিল আওয়ামী লীগ। এই বয়ান প্রতিষ্ঠায় আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবীদের অবদানও কম নয়। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একমাত্র শক্তি(!)’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে এমনকি ভোটডাকাতিরও বৈধতা দিয়েছেন, পাছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি ক্ষমতা দখল করে! এই জুজু বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
শুরুটা হয়েছিল এই জনপদের মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি নৃ-তাত্ত্বিক বহুত্ববাদী পরিচয় ও চেহারাকে ভেঙে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নামক একক পরিচয় ও চেহারা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এই তথাকথিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’র মধ্যেই বাকশাল ও পরে ফ্যাসিবাদ কায়েমের সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। তদুপরি, বিগত দেড় যুগ ধরে ১৯৭১-এর জনযুদ্ধের ওপর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে নিজেদের একক ও একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বদলে নিজেদের দলীয় মূলনীতিকে মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে ফ্যাসিবাদী জমানায় যেকোনো আওয়ামী বিরোধী মতকে দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা। ফ্যাসিবাদী জমানায় বিরোধী মতের বিরুদ্ধে পুলিশের করা শতকরা ৯০ ভাগ মামলার এজাহারে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’র অভিযোগ পাওয়া যাবে। আওয়ামী বয়ানে আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক ও বাহক এবং আওয়ামী বিরোধিতাকারীরা অপরিহার্যভাবেই মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্রবিরোধী। ফলত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার শহীদ জিয়াউর রহমানকে ‘রাজাকার’ কিংবা ‘পাকিস্তানি চর’ বললেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কোনো আঘাত লাগত না। এ নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক মহলেও কোনো নিন্দার ঝড় উঠত না।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি দিক জাতির জনযুদ্ধকে পুঁজি করে আওয়ামীবিরোধী মতকে ঊনমানুষে পরিণত করা বা বিমানবীকরণ। কাউকে ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি খুন করার বৈধতাও উৎপাদন করা হয়েছে। এই অপরাজনীতি থেকে হিন্দু-মুসলিম কেউই রেহাই পাননি। জুলাই অভ্যুত্থানে খুনি হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলার মধ্য দিয়ে তাদের খুনের বৈধতা উৎপাদন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এবার সেই অস্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, খুনের বৈধতা উৎপাদনের রাজনীতির কার্যকারিতা নির্ভর করে এ রাজনীতির সপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্মতি বিদ্যমান থাকার ওপর। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে এই অপরাজনীতির কার্যকারিতা হাজির ছিল। অর্থাৎ, বিরোধী মতকে ঊনমানুষে পরিণত করে হত্যাযোগ্য করার ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উপাদান ও ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল। এ কারণেই আওয়ামী লীগের শাসনামল স্বৈরতন্ত্র না; বরং স্পষ্ট ফ্যাসিবাদ। এই অপরাজনীতি প্রথম ধাক্কা খায় বিশ্বজিৎ হত্যায় এবং বুমেরাং হয়ে যায় আবরার ফাহাদ হত্যার মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ, জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনার ‘রাজাকার’ তকমা দেওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা এই বিমানবীকরণের রাজনীতিকে উৎখাত করে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুনখারাবি এবং তার বৈধতা উৎপাদনের ইতিহাসে সমৃদ্ধ। দেড় যুগ ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দল-মত এবং সাধারণ জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন-ধর্ষণ, সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতি, সেনা কর্মকর্তা হত্যা, শাপলা ম্যাসাকার, এবং সর্বশেষ জুলাই গণহত্যা সংঘটিত করার পরও দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কারো মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা-অনুতাপের চিহ্নটুকুও নেই। সম্প্রতি এক ভারতীয় পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই পতিত ফ্যাসিবাদী দলের নেতা ও জুলাই গণহত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা আসাদুজ্জামান খান কামাল গণঅভ্যুত্থানকে ‘একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ এবং ইসলামি উগ্রবাদ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভ্যুত্থান হিসেবে উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ, জনতার অভূতপূর্ব স্ফূরণের যথেষ্ট পূর্ব সংকেত পেলে, সে ও তার নেত্রী আরো খুন করত। সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্যরা জনতার বুকে গুলি চালাতে অস্বীকার করায় তাদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার এবং পাল্টা বয়ান তৈরি করছে তারা। এ ছাড়া হাজার হাজার থানা পোড়ানো, অস্ত্র লুট ও পুলিশ হত্যার বিকৃত ও আজগুবি তথ্যপ্রচারের মধ্য দিয়ে পাল্টা বয়ান তৈরি করে অভ্যুত্থানের সব শক্তি এবং জনতার বুকে গুলি চালানোর আদেশ অমান্য করা সেনা সদস্যদেরও ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করছে খুনি লীগ। অন্যদিকে, মাঠপর্যায়ে গোপালগঞ্জ, গাজীপুরসহ আরো নানা স্থানে নিষিদ্ধ ফ্যাসিবাদী সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বিভিন্ন শক্তি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুপ্ত ও প্রকাশ্য হামলা জারি রেখেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও প্রতীককে উচ্ছেদকারী প্রত্যেক নাগরিকের তালিকা করছে পলাতক খুনিরা। এর থেকে রেহাই পাননি প্রেসসচিব ও তার পরিবারের সদস্যরাও।
আওয়ামী লীগের এমন রক্তপিপাসু চিত্র চোখে দেখার পরও ইদানীং কেউ কেউ ‘ভালো আওয়ামী লীগ’ বলে বায়বীয় একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আওয়ামী মতাদর্শ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাটাতনে প্রতিষ্ঠিত যেকোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ বাকশাল অথবা ফ্যাসিবাদে পর্যবসিত হতে বাধ্য। আর ‘ভালো ফ্যাসিবাদ’ বলতে দুনিয়ায় কিছু নেই। ফলে আওয়ামী লীগের শুধু ফৌজদারি বিচার নয়; বরং যেসব ভাবাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক পাটাতনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ বাকশাল-ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে, সেগুলো চিরতরে উৎখাত করাই হবে এখনকার কর্তব্য।
লেখক : সহ-মুখপাত্র, জাতীয় নাগরিক কমিটি
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৪ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৫ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৫ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে