বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ভারত বারবার ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগকে। ক্ষমতায় থাকতে এবং ক্ষমতার বাইরে উভয় অবস্থাতেই আওয়ামী লীগ বারবার প্রমাণ করেছে তাদের সুতা বাঁধা রয়েছে ভারতের পাঁচ আঙুলের মাথায়। এ কারণে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা বা না করার সঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত।
ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু জাতিকে বিভক্ত করার খেলায় মেতে ওঠেনি, রক্তাক্ত এক নিপীড়নমূলক শাসন কায়েম করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের নামে তারা জাতিকে বিভক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারা এমনভাবে মেরূকরণ করেছিল, যা শুধু তুলনা করা যায় আফ্রিকা মহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ-পূর্ব পরিস্থিতির সঙ্গে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নামক ফ্যাসিবাদকে যদি এখনই গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা না যায়, তাহলে আগামীতে বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা পাবে কি না, তা নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।
গণরোষে পালিয়ে যাওয়া মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনা ভারতে বসে ভারতের সহায়তায় এখনো বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিশোধের পরিকল্পনা করছেন। দিয়ে যাচ্ছেন প্রকাশ্য হুমকি। দেশ ও বিদেশে পলাতক হাসিনার দোসররা তাদের অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্র সমন্বয়ক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িতদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার। ইতোমধ্যে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় পাল্টা আঘাত শুরু করেছে সরকারের উদাসীনতার সুযোগে।
হাসিনার ষড়যন্ত্র আর হুমকি যতটা না দুশ্চিন্তার, তার চেয়ে সহস্রগুণ আশঙ্কার বিষয় হলো ভারত এখনো শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করে চলছে। এ বিষয়ে তাদের কোনো রাখঢাক নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন সফরের আগে সে দেশের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্র গণমাধ্যমকে বলেছেন, মোদি বাংলাদেশের বিষয়টি উত্থাপন করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে। বৈঠকের পরও বিক্রম মিশ্র আবার বলেছেন, মোদি ট্রাম্পের সামনে উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অবস্থান।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের অবস্থান, আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। কারণ ভারতের আচরণ এখন এমন, বাংলাদেশ যেন ছিল ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্য। আর সেই অঙ্গরাজ্যটি ভারতের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেছে গত ৫ আগস্ট। ভারত এখন বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে আর নালিশ করছে তাদের হারানো বাংলাদেশ নামক সেই রাজ্যটি আবার ফিরে পাওয়ার জন্য।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ বছরে বাংলাদেশকে এমন অবস্থানে নামিয়ে এনেছিল, ভারতের একটি রাজ্য যে মর্যাদা ভোগ করে, সে মর্যাদাও ছিল না বাংলাদেশের। বাংলাদেশকে আবার সে অবস্থানে ফিরে পেতে চায় ভারত। কেন ভারত আবার বাংলাদেশকে আগের মতো করে ফিরে পেতে চায়? কারণ শেখ হাসিনা নিজের মুখেই বলেছেন, ‘তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন, ভারত তা সারা জীবন মনে রাখবে।’ শেখ হাসিনা ১৬ বছরে বাংলাদেশকে ভারতের সর্বগ্রাসী শোষণের এক লীলাভূমিতে পরিণত করেছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চাহিবামাত্র সবকিছু ভারতকে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। সে কারণে আওয়ামী লীগের মতো সরকারকে হারিয়ে ভারত এখন পুরোপুরি দিশাহারা। বাংলাদেশ বিষয়ে তারা যা করছে আর বলছে, তা কূটনীতি আর শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে না কোনো অবস্থাতেই।
আওয়ামী লীগকে আবার বাংলাদেশে পুনর্বাসনের জন্য ভারতের প্রকাশ্য আর গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার অপরিহার্যতা। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আর ভারতের সর্বগ্রাসী আধিপত্যের বিরুদ্ধে। এ দেশের মানুষ আবার সেই দুর্বিষহ অধ্যায়ে ফিরে যেতে চায় না কোনো অবস্থাতেই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে না পারলে খুবই সম্ভাবনা আছে আবার বাংলাদেশকে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার। কারণ ভারত এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সে চেষ্টাই করে যাচ্ছে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে। একে কোনো অবস্থাতেই হাল্কাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা যদি প্রতিহত করা না যায়, তাহলে সত্যি সত্যি বাংলাদেশে নেমে আসতে পারে আমাদের পাশের মিয়ানমার এবং কাশ্মীরের মতো পরিস্থিতি।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সেক্টর এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার চিহ্নিত দোসররা। বিভিন্ন সেক্টরে থাকা হাসিনার চিহ্নিত দোসরদের সঙ্গে এখনো ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়মিত যোগাযোগের অভিযোগ আছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দলের যে বৈশিষ্ট্য, তা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থেকে যে দল তার দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে রাষ্ট্রীয় অস্ত্র তুলে দেয় বিরোধীদের হত্যার জন্য, সেটা কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় সমস্ত অস্ত্রধারী বাহিনীকে আওয়ামী লীগ সরকার পরিণত করেছিল দলীয় বাহিনীতে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের লেলিয়ে দিয়েছিল দেশের মানুষকে হত্যার জন্য।
ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে ধ্বংস করেছে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে রাষ্ট্রকে দাড় করিয়েছিল জনগনের মুখোমুখি আর শত্রু হিসেবে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিনত করেছিল সমস্ত বিরোধীদের দমনের হাতিয়ারে। শেখ হাসিনা দেশকে এমন অবস্থানে নিয়ে আসেন যেখানে কেবল তার দলের লোকজনই এদেশের নাগরিক বাকীরা গোলাম। দলের বাইরের সবাইকে আওয়ামী লীগ আখ্যায়িত করেছে দেশের শত্রু হিসেবে।
আওয়ামী লীগকে যদি আবার ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তারা আবার তাই করবে, যা করেছে অতীতে। কারণ তাদের মধ্যে ১৬ বছরের অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে বিন্দু পরিমাণ কোনো অনুশোচনা নেই। এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছে তারা আসলে বিবেকবর্জিত মানুষ নামক এক ধরনের প্রাণীমাত্র। সে কারণে অনুশোচনার পরিবর্তে তারা এখন উন্মত্ত হয়ে আছে এবং জ্বলছে তীব্র এক প্রতিশোধ স্পৃহায়। এই আওয়ামী লীগকে যারা পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে চায়, তাদের থেকেও জাতিকে সাবধান হতে হবে।
১৬ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে তারা বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসকের পুতুলমাত্র। এশিয়া, আফ্রিকায় ইউরোপিয়ানদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও শত শত বছর ধরে সে শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার মূল ভিত্তি ছিল ষড়যন্ত্র আর শক্তি প্রয়োগ। পলাশীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা এর একটি উদাহরণ। দেশ দখলের পর ইউরোপিয়ানরা তাদের দখলদারিত্ব, শোষণ আর লুটপাট টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অবলম্বন করেছে নির্মম বর্বরতার পথ। স্থানীয়দের সমস্ত প্রতিবাদ প্রতিরোধ দমনের ক্ষেত্রে তাদের প্রধান উপায় ছিল হত্যা আর নিষ্ঠুরতম নির্যাতন।
দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা টিকিয়ে রাখার কৌশলের ক্ষেত্রে মিল রয়েছে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের সঙ্গে। তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ এবং ভারত মিলে ষড়যন্ত্রের এক মহাজাল বিস্তার করে ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসায় আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে। এরপর ১৬ বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গুম, খুন ও গণহত্যা পরিচালনা করেছেন। শাপলা চত্বর গণহত্যা, আয়নাঘরসহ নিষ্ঠুরতম নির্যাতন আর দমন-পীড়নের যে পথ অবলম্বন করেছেন এবং দেশ থেকে যেভাবে বিদেশে অর্থ পাচারের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা মনে করিয়ে দেয় ঔপনিবেশিক শাসনামলকে। শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হাজার হাজার নয়, বরং লাখ লাখ মানুষ হত্যা করতেও প্রস্তুত ছিলেন ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো।
জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করার পর আওয়ামী লীগ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গণহত্যাকারী দল। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি পরিকল্পনা এবং নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে জুলাই গণহত্যা, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শেখ হাসিনা সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন ছাত্রনেতাদের হত্যা করে লাশ লুকিয়ে ফেলার জন্য। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পরিচালনা করেছে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা।
আওয়ামী লীগের সহায়তায় ১৬ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করে সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনা। বাংলাদেশ যাতে কখনোই ভারতের নিরাপত্তার হন্য হুমকি হয়ে না উঠতে পারে, সেটি নিশ্চিত করে নয়াদিল্লি। এই লক্ষ্যে ভারত টার্গেট করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাখা এবং দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিক শক্তিকে ধ্বংস করার।
আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে ভারতের সাথে এতটাই একাকার করে ফেলে যে, ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রার্থী তালিকাও চূড়ান্ত করে দেয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থী নির্বাচনী জনসভায় নিজেকে দাবি করেন ‘ভারতের প্রার্থী’ হিসেবে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলেই এ দেশ বিপদমুক্ত হবে এমন নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আওয়ামী অপরাধী এবং সর্বস্তরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা, অন্যথায় দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হবে না। আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের এত বড় মাত্রার অপরাধের সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যদি তাদের বিচার করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে বিশ্বের বুকে জাতি হিসেবে আমরা কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। আমরা বলতে পারব না ন্যায়বিচারের কথা। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের এত বড় পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে এ জাতি সামনের দিকে চলতে পারবে না।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

