বাংলাদেশিরা হাজার বছর ধরে স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও স্বৈরশাসকরা এই স্বাধীনতা হুমকির মুখে ফেলেছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যুগে যুগে তাদের সময়, মেধা ও রক্ত দিয়ে বুক পেতে দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করতে কুণ্ঠবোধ করেননি।
স্বাধীন দেশ হয়েও পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে হয় শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, গাজী রাফিদের মতো হাজারো বীরের অগ্নি ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রামের প্রতিটি কোণে কোণে। স্বৈরাচারীর শেষ কামড় হিসেবে শুরু হয় এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ছাত্রদের হত্যা, গুম, জেল-জুলম, যা দেখে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের বুক কেঁপে ওঠে। তাদের সরল মনও বিদ্রোহ করে ওঠে স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে।
ফুঁসে ওঠে দল-মত, নারী-পুরুষ, শিক্ষক, শ্রমিক, ধনী-গরিব, এমনকি বিদেশে অবস্থানরত রেমিট্যান্সযোদ্ধারা।
সচেতন নাগরিকদের এই ঐক্যবদ্ধই স্বৈরাচারীর ক্ষমতার মসনদে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ৫ আগস্ট ২০২৪ এই ছাত্র-জনতা পতন ঘটায় স্বৈরাচারকে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিজয় শুধু দেশের ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর বুকে এক অসীম সাহসিকতা ও বিজয়ের নজির স্থাপন করে।
দ্বিতীয় এই স্বাধীনতার পরও একদলের ছোবলের চেষ্টা বন্ধ নেই। নতুন সরকারকে একদিকে যেমন সামাল দিতে হচ্ছে ১৫ বছরের ভয়াল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে, অন্যদিকে বারবার সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় দেশের মানুষ। ফলে মাত্র চার মাসে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে ‘সেরা দেশ’-এর তালিকায়, যা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর নিউজ লিডে উঠে এসেছে। এই সফলতার কৌশলের মূলে ছিল ‘একতা’। জাতির সচেতন নাগরিকের ‘একতা’ই এ ভগ্নদশা থেকে দেশকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে যাচ্ছে।
নতুন সরকারকে সহযোগিতার পাশাপাশি দরকার নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয় নির্ধারণ। শুধু সরকারের সমালোচনাই নয়, ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সত্য ও আইন মেনে চলতে হবে সবার আগে, যেখানে আমার অবস্থান দেশের যেকোনো জায়গাতেই হোক না কেন। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনাকে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করতে আমাদের কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে।
ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক এমন এক বিষয়, যা ধর্মীয় ও নৈতিকতার ভিত্তিতে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়। আমাদের এই ভ্রাতৃত্ব হবে ভালোবাসা, সংহতি এবং দেশ গড়ার বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। পরিবার, সমাজে এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও বিশ্বাস থাকবে অতুলনীয়, যা আমার আলাদা মত ও চিন্তার কারণে পারস্পরিক সুসম্পর্ককে ভাঙতে পারবে না এবং আমাদের সামাজিক প্রীতি ও বন্ধন রক্ষায় ভাই ভাই হয়ে থাকার সুযোগ করে দেবে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো।
সমাজের এই সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব থেকে দূরে সরে গেলেই সামাজিক অস্থিরতা ও বিপর্যয় বেড়ে যাবে, মানসিক শান্তি এবং একতা বিনষ্ট করে দেবে। অন্যদিকে শত্রু এ সুযোগ কাজে লাগাবে। তাই এ ব্যাপারে সবার আগে আমাকেই সুসম্পর্ক বজায় রাখার ‘মডেল’/অনুকরণীয় হতে হবে।
শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে নাগরিক হিসেবে ধর্ম-মত, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবার জন্য মানবিক আচরণ করতে হবে। এখানে কোনো ধরনের বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সবার সমতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। সবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আমি মানবিক কি না, আমার দ্বারা অন্যের হক নষ্ট বা ক্ষতি হচ্ছে কি না? তাহলেই আমি আদর্শ নাগরিক হিসেবে দেশ ও জাতি গড়তে অবদান রাখতে পারব।
বাংলাদেশে ৯০ শতাংশের মানুষ মুসলমান। ইসলামের মূল বিষয় হলো ‘উত্তম আচরণ ও ত্যাগের মানসিকতা’। দুঃখজনকভাবে আমরা ভুলেই যাই যে, আমার আচরণ সুন্দর নয়, অথচ অন্যজনের থেকে ঠিকই ভালো আচরণ আশা করি। সুতরাং অন্যের থেকে আশা করার চেয়ে আমাকেই উত্তম ব্যবহার করতে হবে, বিনয়ী হতে হবে, পরিবার থেকে সমাজের সবার সঙ্গে।
কারও ভুল হলে ক্ষমা করা বা সুন্দর আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়াটাই আমার কাজ হবে। কারও বিপদে-আপদে, নিজে কষ্ট করে, অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে সবার আগে আমাকেই এগিয়ে যেতে সচেষ্ট হতে হবে।
সমাজের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সবচেয়ে প্রধান কাজ একে অন্যের প্রতি সম্মান দেখানো।
তাই সবার আগে মা-বাবার সম্মান, মুরব্বি, আত্মীয়-প্রতিবেশী, নারী, শিক্ষক-ছাত্রের সম্মান দেওয়া নিজের চরিত্রের জন্য বাধ্যতামূলক করে ফেলতে হবে।
তাহলে মা-বাবা অসহায় হবে না, আত্মীয়স্বজন তাদের হক ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে না, শিক্ষক ও ছাত্ররা লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হবে না। নারীরা রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছিত হবে না। আর এভাবে সুন্দর সমাজের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ শিশুদেরও আদর্শবান নাগরিক হতে সাহায্য করবে, যা একটা সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দিতে সহায়তা করবে ।
বাংলাদেশের সমাজে সবচেয়ে বেশি যেটা হয় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে প্রতিবেশীর ঘরে, তা হলো অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো। এ ছাড়া কারও ধর্মীয় ব্যাপারে উপহাস বা কাউকে অন্যের ধর্মীয় উপাসনালয়ে যেতে বাধ্য করা কোনো ভালো মানুষের কাজ নয়। এ ব্যাপারে যার যার ধর্মকে সম্মান দিয়ে নিজেকে নিজের ধর্মকর্মে এবং ভালো কাজে নিয়োজিত রেখে অন্যের অধিকার হরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যাধি হলো পরচর্চা ও পরশ্রীকাতরতা। এর ফলে মানসিক লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দুঃখ-কষ্টের গ্লানি নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বেকারদের বিষণ্ণতা এবং প্রতিবেশীর মানুষিক অশান্তির এক ভয়ানক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাগরিক হিসেবে আমরা যেন কারও পরীক্ষার ফলাফল বেকার যুবকদের কর্মহীনতা এবং দুর্বল ও দরিদ্রদের নিয়ে উপহাস না করে। অন্যের প্রতি সমবেদনা, উৎসাহ ও সহযোগিতার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত। এভাবেই আমরা সমাজকে বদলে দিতে পারব।
প্রতিটি মানুষের ভালো কাজগুলোকে উৎসাহ দান এবং খারাপকে খারাপ বলার সৎসাহস থাকতে হবে।
বর্তমান নতুন সরকারের ভালো কাজগুলোকে উৎসাহ দেওয়াও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অন্যদিকে তাদের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়াও একজন নাগরিকের দায়িত্ব। কেননা, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার ভয় যখন একটা জাতির ওপর চেপে বসে, তখনই মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে সবাইকে মাথানত করতে হয়। আর ধীরে ধীরে সে সমাজ ভাঙনের দিকে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: গবেষক, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া

