তদন্ত কমিশন গঠনের পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার কারণে, আমার মতো অসংখ্য মানুষের মনে ওই কমিটির কার্যক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়ে থাকলেও আজ আমরা সদ্য সমাপ্ত তদন্তের মূল উদ্দেশ্য অর্জনে বেশ কিছুটা আশাবাদী। ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরেই অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক জনগণের কাছে পেশ করা একাধিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে বহিঃশত্রুর পরিকল্পনা ও সহায়তায় দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসঘাতক স্বদেশদ্রোহীর দ্বারা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত অনুষ্ঠান ছিল অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার। তাই অনেক জল্পনা-কল্পনা, হতাশা, অবিশ্বাস, সংশয় এবং অনিশ্চয়তা পার করে অবশেষে স্বাধীন তদন্ত কমিশন দ্বারা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন তৈরি ও সরকারপ্রধানের কাছে তা হস্তান্তর, শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার, তথা সমগ্র দেশবাসীর বহুপ্রতীক্ষিত দাবি পূরণ ও ন্যায়বিচারের অভিমুখে একটি শুভসূচনা বলেই সর্বজন দ্বারা বিবেচিত হবে-এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই।
তবে শুধু একটি তদন্তের মাধ্যমে পরিকল্পিত ও পৈশাচিক এই হত্যাকাণ্ডের ডিটেইল (Detail) এবং আনডিস্টোর্টেড ফ্যাক্টস (undistorted facts) উদঘাটন করা দিয়েই নিহত সেনা কর্মকর্তাদের আত্মার শান্তি নিশ্চিত করা এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের অন্তরের হাহাকার ও চোখের অশ্রু মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এ আকাঙ্ক্ষার সঠিক প্রতিফলন ও তদন্তের মূল উদ্দেশ্যের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত সামরিক ও বেসামরিক, দেশি এবং বহির্দেশীয় সব অপরাধীকে অতি দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করে দৃষ্টান্তমূলক ও সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এবং ভবিষ্যতে পঞ্চম বাহিনী ও বহিঃশত্রুদের গোপন পরিকল্পনায় অনুরূপ বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রোধকল্পে বর্তমান সরকার কর্তৃক নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো দ্রুততম সময়ে গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক বলে আমি মনে করি-
১. জনগণের অবগতির জন্য মানবসভ্যতার ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত সব ব্যক্তি, গোষ্ঠীর নামসহ পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন অবিলম্বে প্রকাশ করা উচিত, অন্যথায় বর্তমান সরকার অথবা পরে নির্বাচিত সরকার দ্বারা অপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হয়ে থাকবে অধিকাংশ নাগরিকদের আশঙ্কা।
২. হত্যাযজ্ঞে প্রতিবেশী ভারত সরকারের পূর্বপরিকল্পনা ও সে দেশের বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ এবং সশস্ত্র অংশগ্রহণের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার কারণে শত্রুভাবাপন্ন ওই দেশের সরকার থেকে ব্যাখ্যা তলব এবং প্রয়োজনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে অভিযোগ উত্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ।
৩. হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আগাম তথ্যপ্রাপ্তি ও অধীন সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা বারবার আবেদিত হওয়ার পর তা প্রতিরোধ এবং নিবারণ করার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকার পরও তদানীন্তন সেনাপ্রধানের নির্লিপ্ততা ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অনীহা প্রদর্শনের কারণে তাকে এবং বিদেশে অবস্থানরত ও পলাতক অন্য সব অপরাধীকে ইন্টারপোলের সহযোগিতায় দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা।
৪. স্বৈরাচার সরকারের আমলে বিচারে সাজাপ্রাপ্ত বিদ্রোহে অংশ নেওয়া বিডিআর সদস্যদের পক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করা সব মামলা অতিদ্রুত নিষ্পত্তির করে শুধু প্রকৃত অপরাধীর সাজা দিয়ে নিরপরাধীদের খালাস দেওয়ার বন্দোবস্ত করা।
৫. দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে নিয়োজিত সব আধা সামরিক এবং পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে বিদ্রোহ ও সর্বপ্রকার হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্যতা এড়ানোর উদ্দেশ্যে এবং তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিকল্পে ও সার্বক্ষণিক শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে এক উচ্চপর্যায়ের জাতীয় কমিটির মাধ্যমে এসব বাহিনীর কার্যক্রম, কর্মদক্ষতা, পেশাদারিত্বে ও প্রশিক্ষণে আমূল এবং যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা একান্ত অপরিহার্য।
৬. সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সময় শাসক দলের ইচ্ছায় দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা জলাঞ্জলি দিয়ে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন করে শুধু ক্ষমতা অবৈধভাবে দীর্ঘায়িত করা এবং এ দেশের সম্পদ লুট করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত যত্রতত্র গড়ে ওঠা অজস্র গোয়েন্দা সংস্থার পুনর্বিন্যাস করে প্রয়োজনীয় ও সীমিতসংখ্যক গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা বাহিনী পুনর্গঠন করে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করা এখন এক গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
৭. সব শহীদ ও আহত সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের রক্ষার্থে বিদ্রোহীদের শিকার অন্য বিডিআর সদস্যদের পরিবারদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।
৮. দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হৃত গৌরব ও মর্যাদা পুনঃস্থাপনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পর তদানীন্তন পাকিস্তানের অধীনে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) নাম পরিবর্তন করে বিডিআর নাম এবং এই বাহিনীর পোশাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বৈরাচার কর্তৃক যে পরিবর্তন করা হয়েছিল, তা বাতিল করে আগের নাম ও পোশাকে ফিরে যাওয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতিশ্রুতি অতিসত্বর বাস্তবায়ন করা।
আমার বিশ্বাস, উপর্যুক্ত সুপারিশমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে তা শুধু শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের আত্মার শান্তি ও তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করবে না, বরং ভবিষ্যতে দেশ ও জাতিকে অনুরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত, কলঙ্কিত, নৃশংস ও বিষাদময় ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ণিত এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে তা কার্যকর করা এক দুরূহ ও প্রায় অসম্ভব কার্য হয়ে দাঁড়াবে বলে আমি গভীরভাবে আশঙ্কা করছি। সেই ব্যর্থতা জাতির বুকে শুধু নতুন কলঙ্কই নয়, এক চিরস্থায়ী অভিশাপ হয়ে ভার বহন করতে হবে।

