এম আবদুল্লাহ
নির্বাচন এগিয়ে আসছে। বিস্ময়করভাবে বেশ কিছুদিন আলোচনায় নেই জুলাই সনদ। হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে বহুল কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার উদ্যোগ। ঐকমত্য কমিশন দফায় দফায় তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি আর ভিআইপি সুবিধা-প্রটোকলে রাজনীতিকদের মজমা বসিয়ে চলছিল। গত পক্ষকাল কেন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কিছু বিষয়ে মতদ্বৈধ আছে। থাকবেই। কোন দেশে, কোন কালে সব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে? তা হলে তো বহুদলীয় রাজনীতির অস্তিত্বই থাকত না। কাজের কাজটা না করে ঐকমত্য কমিশনের অনেকেই ভবিষ্যৎ লাইন-ঘাট ঠিক করায় মনোযোগী। ভাবী-সরকারের নেক-নজরে থাকার কোশেশ করছেন—এমন কানাঘুষাও হচ্ছে। অনেকের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পদ-পদবি নিয়েও বোঝাপড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ‘মুলা’র দিকে চোখ। ফলে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারছেন না তারা।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনা, তাপস আর ইনুদের যে চাঞ্চল্যকর ফোনালাপ ফাঁস করা হলো, তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা-আলোড়ন নেই। শেখ হাসিনার গণহত্যার নির্দেশ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়ে জুলাই বিপ্লবীদের ফাঁসানোর ফন্দি, জঙ্গি কার্ড ব্যবহারের নকশা ইত্যাদির অকাট্য প্রমাণ হাজির করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা যে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছেন, তাতে কারো যেন আগ্রহ নেই। ‘নির্দেশনা দিয়ে দিছি, যেখানো পাবে সোজা গুলি করবে’—শেখ হাসিনার এই টেলি-কনভারসেশন কতজন নিজেদের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করেছেন? চায়নিজ রাইফেল থেকে কোমরের নিচে গুলি করতে ডিএমপি কমিশনারের ওয়্যারলেস বার্তাও যেন মামুলি। জুলাই আন্দোলন দমন ও গণহত্যা-সংশ্লিষ্ট ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল ফোনের ডেটা ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারার জন্য কোনো বিপ্লবী বা বিপ্লবপন্থি রাজনীতিক প্রসিকিউশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন? সাধুবাদ দিয়ে উৎসাহিত করেছেন? শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে এসব অকাট্য দলিল যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তা কি জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরছেন? না। সে ফুরসত কারো নেই।
সবাই ক্ষণস্থায়ী সরকারের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ‘শেখ হাসিনার চেয়েও খারাপ শাসক’, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ সরকার’, ‘১৩/১৪ মাসে কিছুই করতে পারেননি’—এমন বয়ান প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রাখছি সবাই। ছয় রাজনীতিককে কেন সফরসঙ্গী করা হলো, কেন ড. ইউনূস তাদের নিজের গাড়িতে তুলে বিমানবন্দর ত্যাগ করলেন না, সফরসঙ্গীর বহর কেন এত বড়, আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল প্রতিরোধে ড. ইউনূস ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কেন রাস্তায় এবং অলিগলিতে সশরীরে পাহারায় দিন-রাত কাটান না—এ ধরনের ইস্যুগুলো এখন দৃশ্যত সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে!
লুটের ৫৮ হাজার কোটি টাকা যে জব্দ করা সম্ভব হয়েছে, ২৮ লাখ কোটি টাকা লুট-পাচারের তথ্য যে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে উদঘাটন করা গেছে, রিজার্ভের চুরি করা অর্থ যে জব্দ করে ফেরত আনার ব্যবস্থা হচ্ছে, ভয়াবহ ডাকাতির কবলে পড়া ব্যাংক খাত যে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে, রিজার্ভ যে নাজুক ১৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, বাজারের উল্লম্ফন যে থেমেছে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির ত্রৈমাসিক মূল্যবৃদ্ধি না করেও যে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে, বিচারব্যবস্থার ধস যে ঠেকানো গেছে, কথায় কথায় গুলি-গুম-খুন না করেও যে ১৩ মাসে ১ হাজার ৭০০ আন্দোলন মোকাবিলা করা গেল, দলবাজ, ভঙ্গুর জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন দিয়ে এখনো যে দেশটা চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে—এসবে কোনো সাফল্য নেই। শুধুই ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা! ফলে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ভয়াবহ দুঃশাসন, নিপীড়ন, গুম, খুন, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার হরণকে একধরনের বৈধতা ও নরমালাইজ করার কাজটি হচ্ছে অতি চাতুর্যের সঙ্গে।
গণহত্যার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার পাশাপাশি ওই বিচার ও রায়ের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরানোর আওয়ামী কৌশল ও ফাঁদে বুঝে না বুঝে পা দিচ্ছি অনেকেই। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পর্যন্ত বুঝতে পারছি না যে, ড. ইউনূসের শাসনের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সাড়ে ৪ মাস পর ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও করা যাবে। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা ও প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী শক্তির এক নম্বর শত্রু ড. ইউনূস ও তার সরকার। কারণ তিনি ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন। তিনি দুর্বল হলে, জনগণের আস্থা হারালে শক্তি সঞ্চয় করবে পতিত শক্তি। দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ পাবে।
স্বরূপে ফেরার পাটাতন তৈরি হবে। আসন্ন নির্বাচনটিও হুমকির মুখে পড়বে। এটাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছি, প্রচণ্ড জনরোষ থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া খুনি-লুটেরা চক্রকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই শুধু হবে না, সেই বিচারের পক্ষে জনসমর্থনকে সক্রিয় ও দৃশ্যমান রাখাটাও জরুরি। ফ্যাসিস্টদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পাবলিক পারসেপশন অনুকূলে থাকতে হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে সরকার ও তার কালচারাল উইংগুলো কী করেছিল, তা একবার স্মরণ করতে পারেন।
যেকোনো বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তির প্রচলিত আইনি সুরক্ষা এবং সুবিধা পাওয়ার নজির নেই। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পালাবদলে তা পেতে পারে। কারণ, বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ক্ষেত্রেও আইন ও মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না ফ্যাসিস্টরা। জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বিপ্লবীদের কী পরিণাম হতো, সময় সময়ে শেখ হাসিনার হুংকার তা জানান দিচ্ছে। যেসব খুনি, লুটেরা ও দাগি অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরা হয়েছে, তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরির চেষ্টা করছে ফ্যাসিস্ট শক্তির সুবিধাভোগী ল্যাসপেন্সাররা। তাদের মানবাধিকার, আইনি অধিকারের নামে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বুঝে, না বুঝে গণঅভ্যুত্থানপন্থি অনেককে তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যাচ্ছে। সেই সুযোগ নিচ্ছে নতুন করে গজিয়ে ওঠা কিছু মানবাধিকার সংগঠন। এসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব গত ১৫ বছরে দেখা যায়নি।
শুক্রবার আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্রে সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের সরাসরি আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন ভারতে পালিয়ে থাকা পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে হাসিনা এ নির্দেশনা দেন। দলের নেতাকর্মীদের হাসিনা বলেন, ‘কোনোভাবেই কেউ যাতে অক্ষত ফিরতে না পারে, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
শেখ হাসিনার হুকুমে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্তা করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা মো. আখতার হোসেনের পিঠে ডিম ভেঙেছে। ডিম নিক্ষেপকারীকে গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্ত হলে শেখ হাসিনা ভিডিও কলে তাকে অভিনন্দিত করে বীরোচিত প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লবপন্থিদের অনেককে ভার্চুয়াল জগতে ও টকশোতে দেখা গেছে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীদের সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি করতে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের সময় জাতিসংঘ ভবনের বাইরে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ হয়েছে। মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের আওয়ামী লীগ সভাপতি কিল-ঘুসি খেয়ে হাউমাউ করে কান্নাকাটির ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিএনপি-জমায়াতকর্মীদের দুষছিলেন। আরো একাধিক আওয়ামী লীগ কর্মী কমবেশি মার খেয়েছেন। এয়ারপোর্টের নোংরামি ‘পাটকেল’ হয়ে আঘাত হেনেছে জাতিসংঘ ভবনের সামনে। কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত নয়। দেশের মর্যাদাহানিকর। নিউ ইয়র্ক পুলিশকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে দুপক্ষকে সামলাতে। শুধু আমেরিকার নয়, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের সমাবেশ ঘটানো হয় নিউ ইয়র্কে। ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের ‘ক্ষত’ করতে গিয়ে তারা অনেকে ‘অক্ষত’ যেতে পারেননি। অথচ হুকুমদাতারা ঠিকঠাক আছেন বিলাসী জীবনে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ সফরসঙ্গী হিসেবে ১০৪ জনের তথ্য দিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলা হয়েছে। বিলম্বে হলেও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রেসসচিব। তিনি বলেছেন, সংখ্যাটি ভিত্তিহীন। বাস্তবতা পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি আমি নিজেও। ভিভিআইপি সফরে দুটি তালিকা থাকে। একটি প্রকৃত সফরসঙ্গীর তালিকা। যারা বাংলাদেশ থেকে একই ফ্লাইটে সঙ্গী হন। সফর-সংক্রান্ত একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। তাতে যাদের নাম থাকে, তারাই সরকারি সফরে প্রকৃত সফরসঙ্গী। এবার প্রধান উপদেষ্টার এমন সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৬২। গত বছর ছিল এ সংখ্যা ৫৭। বেড়েছে পাঁচজন। এই সফরসঙ্গীদের মধ্যে উপদেষ্টাদের পাশাপাশি রয়েছেন তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নেতা।
সফরসঙ্গীর তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্য হিসেবে তার দুই মেয়ে এবং উপদেষ্টা ও সমমর্যাদার ছয়জন রয়েছেন। মুখ্যসচিব, সামরিক সচিব, পিজিআর কমান্ডার, চিকিৎসকসহ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ৯ জন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা এবং বিডারপ্রধান রয়েছেন। মিডিয়া টিমে গিয়েছেন প্রেস উইংয়ের পাঁচ সদস্য। রীতি অনুযায়ী বিটিভি, বাসস ও ইউএনবি থেকে একজন প্রতিবেদক ও বিটিভির ক্যামেরাপারসন গিয়েছেন। অর্থাৎ প্রেস টিমসহ প্রকৃত সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৪০। এর সঙ্গে ব্যতিক্রম হিসেবে রাজনীতিক ছয়জন যোগ হয়ে ৪৬ জন। এর মধ্যে এক রাজনীতিক নিউ ইয়র্ক থেকে যুক্ত হয়েছেন। মানে মূল সফরসঙ্গী ৪৫ জন তার সঙ্গে বিমানে ঢাকা থেকে গিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে—তাহলে ১০৪ সদস্যের বাকিরা কারা? তালিকা অনুযায়ী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্য থেকে দুটি ক্যাটাগরিতে ১৯ জন অগ্রবর্তী নিরাপত্তা সদস্য এবং সহযোগী নিরাপত্তা সদস্য হিসেবে গিয়েছেন। আইন ও বিধি অনুযায়ী নিরাপত্তা দলের সদস্য নির্ধারণ করা হয় স্বাধীনভাবে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ঝুঁকি বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার নেই বললেই চলে। এবার আওয়ামী লীগের হুমকির কারণে সম্ভবত নিরাপত্তা টিমের সদস্য বাড়ানো হয়েছে।
১০৪ জানের তালিকার বাকি সবাই সেই অর্থে সফরসঙ্গী নন। তারা মূলত জাতিসংঘ মিশন ও নিউ ইয়র্ক কনস্যুলেটের সদস্য। প্রোটোকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাদের কেউ কেউ অন্যান্য দেশের মিশন থেকেও সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। নিরাপত্তা পাসের জন্য তাদের নাম তালিকায় রাখা হয়। বহরটি হয়তো আরো একটু ছোট করা যেত। রাষ্ট্রীয় অর্থের সাশ্রয় হতো। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৫ বছর ধরে ২০০ থেকে ২৫০ সদস্যের লটবহরের তুলনায় এটি অবশ্যই অনেক ছোট ও সাশ্রয়ী। ২০১৯ সালে ২৯২ জন নিয়ে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন টিআইবি কোনো বিবৃতি দিয়েছিল কি না, গুগলের সহযোগিতা চেয়ে খুঁজে পেলাম না। একটি টিভি টকশোতে দেখলাম ড. ইউনূসের সঙ্গে দুই মেয়ের সঙ্গী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করে বলা হয়েছে, দুই মেয়ের কী কাজ? একজন বয়স্ক মানুষ। স্ত্রী অসুস্থ ও শয্যাসায়ী থাকায় সঙ্গী হতে পারেননি। বার্ধক্যে ব্যক্তিগত কত সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সেসব কে দেখবেন? বিগত সময়ে ছেলে, মেয়ে, নাতি-পুতি, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই ও তাদের গোষ্ঠী-জ্ঞাতিকে সফরসঙ্গী করার সময় এমন প্রশ্ন টকশোতে তোলার মুরোদ কোনো টেলিভিশনের হয়নি। এটাই নতুন বাংলাদেশ। সরকারপ্রধানের উদ্দেশে কারণে-অকারণে আঙুল তোলা যায়।
সফরের অর্জন নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অবশ্যই তুলতে পারেন। মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দেওয়ার সফরটি বার্ষিক রুটিন সফর। তবু সরকারপ্রধান হিসেবে সাইডলাইনে সম্ভবত ড. ইউনূসই সর্বাধিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছেন। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা জানান দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। বস্ত্র খাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন। আরো শুল্কসুবিধা চেয়েছেন। কয়েকটি দেশের কাছ থেকে জনশক্তি রপ্তানির আশ্বাস আদায় করেছেন। বিস্তারিত হয়তো তার ফেরার পর জানা যাবে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে বড় কোনো ইস্যু চাপা দিতে পরিকল্পিতভাবে নানা ঘটনা ঘটাতেন। স্যাবোটাজ করতেন। মানুষের দৃষ্টি-বিভ্রাটে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এবারও নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সফরকে ম্লান করতে বড় বাজেটে নেতাকর্মীদের সমবেত করে নোংরামি, ফাতরামির বড় পরিকল্পনা করেছিলেন। কিছুটা সফলও হয়েছেন। তবে ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীরা এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত ‘অক্ষত’ই আছেন। আশা করি, দেশে ‘অক্ষত’ই ফিরবেন। তবে সফরের উজ্জ্বল দিকগুলো মলিন করতে শেখ হাসিনার দূরভিসন্ধির ফাঁদে অনেক বিপ্লবপন্থির পা দেওয়া হতাশাজনক। আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দেখাই হয়নি বলে প্রচার করে বিকৃত আনন্দ করছিলেন। শেষে দেখা গেল নৈশভোজে সাক্ষাৎই শুধু হয়নি, হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশনও হয়েছে। বিরাট ‘লট বহর’র প্রচারও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি।
গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত অনেকে নন-ইস্যুকে ইস্যু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। কিছু ডলার কামাইকে প্রাধান্য দিয়ে তিলকে তাল করছেন। ফল হচ্ছে—পতিতরা মুচকি হাসছে। বগল বাজাচ্ছে। গর্ত থেকে মাথা তুলছে। উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আশাবাদী হয়ে উঠছে। তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। এভাবে শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দিতে থাকলে বিপ্লবপন্থিরাও একদিন সত্যি সত্যি ‘অক্ষত’ থাকতে পারবেন না। আবার নিরাপদ আয়েশি জীবনে থাকা নেত্রীর হুকুম পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরাও যে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা তো নগদেই প্রমাণিত হলো।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতিবিশ্লেষক
নির্বাচন এগিয়ে আসছে। বিস্ময়করভাবে বেশ কিছুদিন আলোচনায় নেই জুলাই সনদ। হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেছে বহুল কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার উদ্যোগ। ঐকমত্য কমিশন দফায় দফায় তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি আর ভিআইপি সুবিধা-প্রটোকলে রাজনীতিকদের মজমা বসিয়ে চলছিল। গত পক্ষকাল কেন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কিছু বিষয়ে মতদ্বৈধ আছে। থাকবেই। কোন দেশে, কোন কালে সব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে? তা হলে তো বহুদলীয় রাজনীতির অস্তিত্বই থাকত না। কাজের কাজটা না করে ঐকমত্য কমিশনের অনেকেই ভবিষ্যৎ লাইন-ঘাট ঠিক করায় মনোযোগী। ভাবী-সরকারের নেক-নজরে থাকার কোশেশ করছেন—এমন কানাঘুষাও হচ্ছে। অনেকের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পদ-পদবি নিয়েও বোঝাপড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ‘মুলা’র দিকে চোখ। ফলে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারছেন না তারা।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনা, তাপস আর ইনুদের যে চাঞ্চল্যকর ফোনালাপ ফাঁস করা হলো, তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা-আলোড়ন নেই। শেখ হাসিনার গণহত্যার নির্দেশ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়ে জুলাই বিপ্লবীদের ফাঁসানোর ফন্দি, জঙ্গি কার্ড ব্যবহারের নকশা ইত্যাদির অকাট্য প্রমাণ হাজির করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা যে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছেন, তাতে কারো যেন আগ্রহ নেই। ‘নির্দেশনা দিয়ে দিছি, যেখানো পাবে সোজা গুলি করবে’—শেখ হাসিনার এই টেলি-কনভারসেশন কতজন নিজেদের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করেছেন? চায়নিজ রাইফেল থেকে কোমরের নিচে গুলি করতে ডিএমপি কমিশনারের ওয়্যারলেস বার্তাও যেন মামুলি। জুলাই আন্দোলন দমন ও গণহত্যা-সংশ্লিষ্ট ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল ফোনের ডেটা ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারার জন্য কোনো বিপ্লবী বা বিপ্লবপন্থি রাজনীতিক প্রসিকিউশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন? সাধুবাদ দিয়ে উৎসাহিত করেছেন? শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে এসব অকাট্য দলিল যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তা কি জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরছেন? না। সে ফুরসত কারো নেই।
সবাই ক্ষণস্থায়ী সরকারের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ‘শেখ হাসিনার চেয়েও খারাপ শাসক’, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ সরকার’, ‘১৩/১৪ মাসে কিছুই করতে পারেননি’—এমন বয়ান প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রাখছি সবাই। ছয় রাজনীতিককে কেন সফরসঙ্গী করা হলো, কেন ড. ইউনূস তাদের নিজের গাড়িতে তুলে বিমানবন্দর ত্যাগ করলেন না, সফরসঙ্গীর বহর কেন এত বড়, আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল প্রতিরোধে ড. ইউনূস ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কেন রাস্তায় এবং অলিগলিতে সশরীরে পাহারায় দিন-রাত কাটান না—এ ধরনের ইস্যুগুলো এখন দৃশ্যত সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে!
লুটের ৫৮ হাজার কোটি টাকা যে জব্দ করা সম্ভব হয়েছে, ২৮ লাখ কোটি টাকা লুট-পাচারের তথ্য যে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে উদঘাটন করা গেছে, রিজার্ভের চুরি করা অর্থ যে জব্দ করে ফেরত আনার ব্যবস্থা হচ্ছে, ভয়াবহ ডাকাতির কবলে পড়া ব্যাংক খাত যে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে, রিজার্ভ যে নাজুক ১৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, বাজারের উল্লম্ফন যে থেমেছে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির ত্রৈমাসিক মূল্যবৃদ্ধি না করেও যে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে, বিচারব্যবস্থার ধস যে ঠেকানো গেছে, কথায় কথায় গুলি-গুম-খুন না করেও যে ১৩ মাসে ১ হাজার ৭০০ আন্দোলন মোকাবিলা করা গেল, দলবাজ, ভঙ্গুর জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন দিয়ে এখনো যে দেশটা চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে—এসবে কোনো সাফল্য নেই। শুধুই ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা! ফলে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ভয়াবহ দুঃশাসন, নিপীড়ন, গুম, খুন, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার হরণকে একধরনের বৈধতা ও নরমালাইজ করার কাজটি হচ্ছে অতি চাতুর্যের সঙ্গে।
গণহত্যার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার পাশাপাশি ওই বিচার ও রায়ের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে সরানোর আওয়ামী কৌশল ও ফাঁদে বুঝে না বুঝে পা দিচ্ছি অনেকেই। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পর্যন্ত বুঝতে পারছি না যে, ড. ইউনূসের শাসনের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সাড়ে ৪ মাস পর ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও করা যাবে। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা ও প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী শক্তির এক নম্বর শত্রু ড. ইউনূস ও তার সরকার। কারণ তিনি ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন। তিনি দুর্বল হলে, জনগণের আস্থা হারালে শক্তি সঞ্চয় করবে পতিত শক্তি। দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ পাবে।
স্বরূপে ফেরার পাটাতন তৈরি হবে। আসন্ন নির্বাচনটিও হুমকির মুখে পড়বে। এটাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছি, প্রচণ্ড জনরোষ থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া খুনি-লুটেরা চক্রকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই শুধু হবে না, সেই বিচারের পক্ষে জনসমর্থনকে সক্রিয় ও দৃশ্যমান রাখাটাও জরুরি। ফ্যাসিস্টদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পাবলিক পারসেপশন অনুকূলে থাকতে হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে সরকার ও তার কালচারাল উইংগুলো কী করেছিল, তা একবার স্মরণ করতে পারেন।
যেকোনো বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তির প্রচলিত আইনি সুরক্ষা এবং সুবিধা পাওয়ার নজির নেই। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পালাবদলে তা পেতে পারে। কারণ, বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ক্ষেত্রেও আইন ও মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না ফ্যাসিস্টরা। জুলাই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে বিপ্লবীদের কী পরিণাম হতো, সময় সময়ে শেখ হাসিনার হুংকার তা জানান দিচ্ছে। যেসব খুনি, লুটেরা ও দাগি অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরা হয়েছে, তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরির চেষ্টা করছে ফ্যাসিস্ট শক্তির সুবিধাভোগী ল্যাসপেন্সাররা। তাদের মানবাধিকার, আইনি অধিকারের নামে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বুঝে, না বুঝে গণঅভ্যুত্থানপন্থি অনেককে তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যাচ্ছে। সেই সুযোগ নিচ্ছে নতুন করে গজিয়ে ওঠা কিছু মানবাধিকার সংগঠন। এসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব গত ১৫ বছরে দেখা যায়নি।
শুক্রবার আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্রে সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের সরাসরি আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন ভারতে পালিয়ে থাকা পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে হাসিনা এ নির্দেশনা দেন। দলের নেতাকর্মীদের হাসিনা বলেন, ‘কোনোভাবেই কেউ যাতে অক্ষত ফিরতে না পারে, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
শেখ হাসিনার হুকুমে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্তা করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা মো. আখতার হোসেনের পিঠে ডিম ভেঙেছে। ডিম নিক্ষেপকারীকে গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্ত হলে শেখ হাসিনা ভিডিও কলে তাকে অভিনন্দিত করে বীরোচিত প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লবপন্থিদের অনেককে ভার্চুয়াল জগতে ও টকশোতে দেখা গেছে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গীদের সংখ্যা নিয়ে মাতামাতি করতে।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের সময় জাতিসংঘ ভবনের বাইরে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ হয়েছে। মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের আওয়ামী লীগ সভাপতি কিল-ঘুসি খেয়ে হাউমাউ করে কান্নাকাটির ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিএনপি-জমায়াতকর্মীদের দুষছিলেন। আরো একাধিক আওয়ামী লীগ কর্মী কমবেশি মার খেয়েছেন। এয়ারপোর্টের নোংরামি ‘পাটকেল’ হয়ে আঘাত হেনেছে জাতিসংঘ ভবনের সামনে। কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত নয়। দেশের মর্যাদাহানিকর। নিউ ইয়র্ক পুলিশকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে দুপক্ষকে সামলাতে। শুধু আমেরিকার নয়, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের সমাবেশ ঘটানো হয় নিউ ইয়র্কে। ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের ‘ক্ষত’ করতে গিয়ে তারা অনেকে ‘অক্ষত’ যেতে পারেননি। অথচ হুকুমদাতারা ঠিকঠাক আছেন বিলাসী জীবনে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ সফরসঙ্গী হিসেবে ১০৪ জনের তথ্য দিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলা হয়েছে। বিলম্বে হলেও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রেসসচিব। তিনি বলেছেন, সংখ্যাটি ভিত্তিহীন। বাস্তবতা পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি আমি নিজেও। ভিভিআইপি সফরে দুটি তালিকা থাকে। একটি প্রকৃত সফরসঙ্গীর তালিকা। যারা বাংলাদেশ থেকে একই ফ্লাইটে সঙ্গী হন। সফর-সংক্রান্ত একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। তাতে যাদের নাম থাকে, তারাই সরকারি সফরে প্রকৃত সফরসঙ্গী। এবার প্রধান উপদেষ্টার এমন সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৬২। গত বছর ছিল এ সংখ্যা ৫৭। বেড়েছে পাঁচজন। এই সফরসঙ্গীদের মধ্যে উপদেষ্টাদের পাশাপাশি রয়েছেন তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নেতা।
সফরসঙ্গীর তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পরিবারের সদস্য হিসেবে তার দুই মেয়ে এবং উপদেষ্টা ও সমমর্যাদার ছয়জন রয়েছেন। মুখ্যসচিব, সামরিক সচিব, পিজিআর কমান্ডার, চিকিৎসকসহ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ৯ জন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা এবং বিডারপ্রধান রয়েছেন। মিডিয়া টিমে গিয়েছেন প্রেস উইংয়ের পাঁচ সদস্য। রীতি অনুযায়ী বিটিভি, বাসস ও ইউএনবি থেকে একজন প্রতিবেদক ও বিটিভির ক্যামেরাপারসন গিয়েছেন। অর্থাৎ প্রেস টিমসহ প্রকৃত সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৪০। এর সঙ্গে ব্যতিক্রম হিসেবে রাজনীতিক ছয়জন যোগ হয়ে ৪৬ জন। এর মধ্যে এক রাজনীতিক নিউ ইয়র্ক থেকে যুক্ত হয়েছেন। মানে মূল সফরসঙ্গী ৪৫ জন তার সঙ্গে বিমানে ঢাকা থেকে গিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে—তাহলে ১০৪ সদস্যের বাকিরা কারা? তালিকা অনুযায়ী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্য থেকে দুটি ক্যাটাগরিতে ১৯ জন অগ্রবর্তী নিরাপত্তা সদস্য এবং সহযোগী নিরাপত্তা সদস্য হিসেবে গিয়েছেন। আইন ও বিধি অনুযায়ী নিরাপত্তা দলের সদস্য নির্ধারণ করা হয় স্বাধীনভাবে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ঝুঁকি বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার নেই বললেই চলে। এবার আওয়ামী লীগের হুমকির কারণে সম্ভবত নিরাপত্তা টিমের সদস্য বাড়ানো হয়েছে।
১০৪ জানের তালিকার বাকি সবাই সেই অর্থে সফরসঙ্গী নন। তারা মূলত জাতিসংঘ মিশন ও নিউ ইয়র্ক কনস্যুলেটের সদস্য। প্রোটোকলে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাদের কেউ কেউ অন্যান্য দেশের মিশন থেকেও সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। নিরাপত্তা পাসের জন্য তাদের নাম তালিকায় রাখা হয়। বহরটি হয়তো আরো একটু ছোট করা যেত। রাষ্ট্রীয় অর্থের সাশ্রয় হতো। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৫ বছর ধরে ২০০ থেকে ২৫০ সদস্যের লটবহরের তুলনায় এটি অবশ্যই অনেক ছোট ও সাশ্রয়ী। ২০১৯ সালে ২৯২ জন নিয়ে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন টিআইবি কোনো বিবৃতি দিয়েছিল কি না, গুগলের সহযোগিতা চেয়ে খুঁজে পেলাম না। একটি টিভি টকশোতে দেখলাম ড. ইউনূসের সঙ্গে দুই মেয়ের সঙ্গী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করে বলা হয়েছে, দুই মেয়ের কী কাজ? একজন বয়স্ক মানুষ। স্ত্রী অসুস্থ ও শয্যাসায়ী থাকায় সঙ্গী হতে পারেননি। বার্ধক্যে ব্যক্তিগত কত সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সেসব কে দেখবেন? বিগত সময়ে ছেলে, মেয়ে, নাতি-পুতি, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই ও তাদের গোষ্ঠী-জ্ঞাতিকে সফরসঙ্গী করার সময় এমন প্রশ্ন টকশোতে তোলার মুরোদ কোনো টেলিভিশনের হয়নি। এটাই নতুন বাংলাদেশ। সরকারপ্রধানের উদ্দেশে কারণে-অকারণে আঙুল তোলা যায়।
সফরের অর্জন নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অবশ্যই তুলতে পারেন। মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দেওয়ার সফরটি বার্ষিক রুটিন সফর। তবু সরকারপ্রধান হিসেবে সাইডলাইনে সম্ভবত ড. ইউনূসই সর্বাধিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছেন। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা জানান দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। বস্ত্র খাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন। আরো শুল্কসুবিধা চেয়েছেন। কয়েকটি দেশের কাছ থেকে জনশক্তি রপ্তানির আশ্বাস আদায় করেছেন। বিস্তারিত হয়তো তার ফেরার পর জানা যাবে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে বড় কোনো ইস্যু চাপা দিতে পরিকল্পিতভাবে নানা ঘটনা ঘটাতেন। স্যাবোটাজ করতেন। মানুষের দৃষ্টি-বিভ্রাটে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এবারও নিউ ইয়র্কে ড. ইউনূসের সফরকে ম্লান করতে বড় বাজেটে নেতাকর্মীদের সমবেত করে নোংরামি, ফাতরামির বড় পরিকল্পনা করেছিলেন। কিছুটা সফলও হয়েছেন। তবে ড. ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীরা এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত ‘অক্ষত’ই আছেন। আশা করি, দেশে ‘অক্ষত’ই ফিরবেন। তবে সফরের উজ্জ্বল দিকগুলো মলিন করতে শেখ হাসিনার দূরভিসন্ধির ফাঁদে অনেক বিপ্লবপন্থির পা দেওয়া হতাশাজনক। আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দেখাই হয়নি বলে প্রচার করে বিকৃত আনন্দ করছিলেন। শেষে দেখা গেল নৈশভোজে সাক্ষাৎই শুধু হয়নি, হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশনও হয়েছে। বিরাট ‘লট বহর’র প্রচারও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি।
গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত অনেকে নন-ইস্যুকে ইস্যু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। কিছু ডলার কামাইকে প্রাধান্য দিয়ে তিলকে তাল করছেন। ফল হচ্ছে—পতিতরা মুচকি হাসছে। বগল বাজাচ্ছে। গর্ত থেকে মাথা তুলছে। উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আশাবাদী হয়ে উঠছে। তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। এভাবে শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দিতে থাকলে বিপ্লবপন্থিরাও একদিন সত্যি সত্যি ‘অক্ষত’ থাকতে পারবেন না। আবার নিরাপদ আয়েশি জীবনে থাকা নেত্রীর হুকুম পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরাও যে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা তো নগদেই প্রমাণিত হলো।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতিবিশ্লেষক
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১৩ ঘণ্টা আগেযখন অনুন্নত দেশের যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিরা উন্নত দেশে স্থানান্তরিত হন, তখন এ ঘটনাকে ‘মেধা পাচার’ বা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বলা হয়। নানা কারণে দেশ ত্যাগ করার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ক্ষেত্রে। অথচ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ‘বিশ্ব জনসংখ্যার অবস্থা প্রতিবেদন-২০২৫’-এ বাংলাদেশকে বর্তমান
১৩ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের অনেক গুণ থাকলেও, যে গুণটির বড্ড অভাব, তা হলো আত্মপর্যালোচনার অভ্যাস। কিন্তু এর জন্য পুরোপুরি তাদের দায়ী করা চলে না। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের যারা দর্শক-শ্রোতা তথা (সু)ফলভোগী, অর্থাৎ আমাদের মতো আমজনতা, আমরা তাদের কাজকে সেটা ভুল হোক, ভালো হোক হাততালি দিয়ে আর প্রশংসায় ভ
১৩ ঘণ্টা আগেভারতও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই আমি আবার সেই প্রশ্নে ফিরে যাই : আমরা কি মুসলিম, নাকি মুজরিম (অপরাধী)? কেন আমাদের প্রতিদিন আসামির মতো বাঁচতে হবে, যখন খুনিরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়? কেন আমাদের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়া থেকে গায়েব করে ফেলা হয়, অথচ রাষ্ট্র স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদযাপন করে?
১৩ ঘণ্টা আগে