• facebook
  • fb_group
  • twitter
  • tiktok
  • whatsapp
  • pinterest
  • youtube
  • linkedin
  • instagram
  • google
শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ
জাতীয়
রাজনীতি
বাণিজ্য
সারা দেশ
বিশ্ব
খেলা
আইন-আদালত
ধর্ম ও ইসলাম
বিনোদন
ফিচার
আমার দেশ পরিবার
ইপেপার
আমার দেশযোগাযোগশর্তাবলি ও নীতিমালাগোপনীয়তা নীতিডিএমসিএ
facebookfb_grouptwittertiktokwhatsapppinterestyoutubelinkedininstagramgoogle
স্বত্ব: ©️ আমার দেশ | সম্পাদক ও প্রকাশক, মাহমুদুর রহমান 
মাহমুদুর রহমান কর্তৃক ঢাকা ট্রেড সেন্টার (৮ম ফ্লোর), ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫ থেকে প্রকাশিত এবং আমার দেশ পাবলিকেশন লিমিটেড প্রেস, ৪৪৬/সি ও ৪৪৬/ডি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্য বিভাগ: ঢাকা ট্রেড সেন্টার, ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।ফোন: ০২-৫৫০১২২৫০। ই-মেইল: info@dailyamardesh.comবার্তা: ফোন: ০৯৬৬৬-৭৪৭৪০০। ই-মেইল: news@dailyamardesh.comবিজ্ঞাপন: ফোন: +৮৮০-১৭১৫-০২৫৪৩৪ । ই-মেইল: ad@dailyamardesh.comসার্কুলেশন: ফোন: +৮৮০-০১৮১৯-৮৭৮৬৮৭ । ই-মেইল: circulation@dailyamardesh.com
ওয়েব মেইল
কনভার্টারআর্কাইভবিজ্ঞাপনসাইটম্যাপ
> মতামত

ডায়াবেটিস : শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক দায়ের রোগ

ড. মো. খাদিমুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২১
logo
ডায়াবেটিস : শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক দায়ের রোগ

ড. মো. খাদিমুল ইসলাম

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২১

আজকের দিনে ডায়াবেটিস নিয়ে কথা বললে আমরা প্রায়ই শুনি—‘অতিরিক্ত খাওয়া’, ‘কম ব্যায়াম’, ‘অতিরিক্ত ওজন’ বা ‘জীবনযাত্রার অনিয়ম’। গণমাধ্যমে নিয়মিত এভাবেই ব্যক্তিগত অভ্যাসকেই বেশি দায়ী করা হয়। কিন্তু ডায়াবেটিসের সমস্যার এক বড় অংশ থাকে অদৃশ্য, যা লুকিয়ে আছে সমাজের কাঠামো, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও পরিবেশের গভীরে। ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক কারণগুলোই আজ ডায়াবেটিসকে দেশের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত করেছে।

আমরা প্রায়ই বলি—ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও ওষুধ গ্রহণ জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ কি এসব করার বাস্তব সুযোগ পাচ্ছে? একজন মানুষ যদি প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চান, তাহলে কি তিনি তা সহজে ও সাশ্রয়ী দামে পেতে পারেন? আমাদের শহরগুলোয় কি হাঁটার মতো নিরাপদ ফুটপাত বা পার্ক আছে? যেখানে তাকাই, দেখি দূষণ, যানজট আর ব্যস্ত নগরজীবন। এমন পরিবেশে ‘স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন’ শুধু পরামর্শ হিসেবেই থেকে যায়, বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব।

ডায়াবেটিস নিয়ে আলোচনায় ব্যক্তিগত দোষারোপ এখন এক সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক সময় মানুষ যতই চেষ্টা করুক, সামাজিক কাঠামো ও পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভালো খাবার দামি, খোলা জায়গা অপ্রতুল আর বায়ুদূষণ সর্বত্র। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভেজালমুক্ত খাবারের দুষ্প্রাপ্য—বাজারে ভেজাল ও ক্ষতিকর উপাদানে ভরা খাবার এখন সর্বত্র। এমন এক বাস্তবতায় মানুষ চাইলেও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে পারে না। এ অবস্থায় শুধু ব্যক্তিগত নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ তার শরীরের প্রতি দায়বদ্ধ—এই শরীর আমাদের ওপর আল্লাহর এক আমানত। কিন্তু সমাজও সেই দায়ের অংশীদার। সমাজের দায় হলো এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে মানুষ সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে। একজন ব্যক্তির যতই ইচ্ছা থাকুক, যদি সমাজ ও রাষ্ট্র তার পাশে না দাঁড়ায়, তবে স্বাস্থ্য রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস নিয়ে আলোচনায় ‘স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক’ বা সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অব হেলথ (Social Determinant of Health) প্রায় অনুপস্থিত। এটি এমন এক ধারণা, যা বলে—মানুষ যে পরিবেশে জন্মায়, বড় হয়, কাজ করে ও জীবন কাটায়, সেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তার স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি গঠন করে। এর মধ্যে রয়েছে আয়, শিক্ষা, বাসস্থানের নিরাপত্তা, খাদ্যের প্রাপ্য, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্য ও পরিবেশের গুণগত মান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের স্বাস্থ্যের মাত্র ২৫ শতাংশ নির্ভর করে ব্যক্তিগত অভ্যাস ও জিনের ওপর, বাকি ৭৫ শতাংশ নির্ভর করে সামাজিক এবং পরিবেশগত বাস্তবতার ওপর। অর্থাৎ, সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতি, শিক্ষার মান, আবাসন, পরিষ্কার বাতাস ও চিকিৎসাসেবার প্রাপ্য—এসবই নির্ধারণ করে আমরা কতটা সুস্থ থাকব। তাই সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অব হেলথ (Social Determinant of Health) উপেক্ষা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে না, যতই ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাসের পরামর্শ দেওয়া হোক না কেন।

বাংলাদেশে এই সামাজিক নির্ধারকগুলো প্রায় উপেক্ষিত থেকে গেছে। ফলে আমরা বারবার জীবনযাত্রা পরিবর্তনের কথা শুনি, কিন্তু জীবনযাত্রা পাল্টাতে যে সামাজিক কাঠামো প্রয়োজন, তা গড়ে উঠছে না। আজ যদি কেউ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চায়, তাকে বেশি দাম দিতে হয়। যদি কেউ হাঁটতে চায়, তার জন্য নিরাপদ ফুটপাত নেই। পরিবেশদূষণ এতই মারাত্মক যে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাড়ে ৫ বছর কমে গেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর একটি।

এই বাস্তবতা দেখায়, ডায়াবেটিস শুধু হাসপাতালের রোগ নয়; এটি শহরের পরিকল্পনার, খাদ্যনীতির আর পরিবেশ ব্যবস্থাপনারও সমস্যা। যখন চারপাশের বাতাস দূষিত, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, বাসস্থানে ঘিঞ্জি অবস্থা—তখন শরীর সুস্থ থাকা কঠিন। ডায়াবেটিস তখন শুধু ব্যক্তির নয়, সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ জানে না যে তারা এই রোগে ভুগছে। অর্থাৎ লাখো মানুষ দিন কাটাচ্ছে এমন একটি অসুখ নিয়ে, যা নীরবে তাদের দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী কখনোই স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আসেনি। এটি আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বলতার এক স্পষ্ট চিত্র।

ডায়াবেটিসের প্রভাব শুধু রক্তে শর্করার মাত্রায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি দীর্ঘ মেয়াদে হৃদরোগ, কিডনি বিকল, চোখের দৃষ্টি নষ্ট হওয়া এবং স্নায়ুর ক্ষতির মতো জটিলতা তৈরি করে। এই রোগ ব্যক্তির কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, পরিবারে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ায় এবং জাতীয় উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, ডায়াবেটিস শুধু চিকিৎসার খরচ নয়—এটি অর্থনীতি ও সমাজের ওপরও এক গভীর আঘাত।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য কারণ হলো মানসিক চাপ। নিম্ন আয়ের মানুষ যারা দিনমজুর, কারখানার শ্রমিক বা অল্প বেতনের চাকরিজীবী—তাদের জীবনে অতিরিক্ত পরিশ্রম, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও আর্থিক অনিশ্চয়তা ক্রমাগত মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ রক্তে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ডায়াবেটিস শুধু শরীরের রোগ নয়, এটি এক সামাজিক ও মানসিক সংকটও বটে।

এ অবস্থায় আমাদের ভাবতে হবে—স্বাস্থ্য শুধু হাসপাতালের সেবা নয়; এটি এক সামাজিক চুক্তি। একজন নাগরিকের সুস্থতা নির্ভর করে সমাজ কতটা ন্যায়ভিত্তিক, পরিবেশ কতটা পরিষ্কার এবং রাষ্ট্র কতটা দায়িত্বশীল। তাই সরকারের নীতিতে ‘স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক’কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে—ডায়াবেটিস কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ।

এই প্রচেষ্টায় সমাজ ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা অপরিহার্য। বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারেÑযেমন স্কুলে শিশুদের পুষ্টি শিক্ষা, কমিউনিটি সেন্টারে স্বাস্থ্যসচেতনতা কার্যক্রম আর মসজিদে ইমামদের মাধ্যমে খুতবায় শরীর ও স্বাস্থ্যের যত্নকে ইবাদতের অংশ হিসেবে স্মরণ করানো। সরকারি নীতিনির্ধারকরা যেন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বাইরে গিয়ে বাজার, কারখানা ও গ্রামের মানুষদের জন্য জনসচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করেন। এসব উদ্যোগ শুধু স্বপ্ন নয়—যদি আমরা নীতি, শিক্ষা ও সমাজকে এক সুরে এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে তা বাস্তবে রূপ নেওয়া সম্ভব।

স্বাস্থ্যকে একটি সামাজিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার—সবাই মিলে কাজ না করলে ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ কখনোই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আমাদের ধর্মও বলে, ‘তোমার শরীরের ওপর তোমার হক আছে’—অর্থাৎ শরীরের যত্ন নেওয়া ইবাদতেরই অংশ। কিন্তু সেই যত্ন তখনই পূর্ণ হয়, যখন সমাজ ও রাষ্ট্র এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষ সহজে সুস্থভাবে বাঁচতে পারে।

এই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস দিবসে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে—স্বাস্থ্য কি শুধু ব্যক্তিগত দায়, না এটি এক জাতীয় দায়বদ্ধতা? প্রতিটি মানুষ তার দায় পালন করবে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজকে নেতৃত্ব দিতে হবে। কারণ একজন সুস্থ নাগরিকই একটি শক্তিশালী জাতির ভিত্তি। ডায়াবেটিস মোকাবিলায় সমাজ ও রাষ্ট্র যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে একটি সুস্থ এবং আলোকিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

লেখক : স্বাস্থ্য যোগাযোগবিষয়ক গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশনস বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর

সম্পাদক ও প্রকাশক : মাহমুদুর রহমান কর্তৃক প্রকাশিত এবং আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস, ৪২৩, এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭ থেকে এবং অস্থায়ীভাবে মিডিয়া প্রিন্টার্স লি. ৪৪৬/এইচ, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্য বিভাগ : ঢাকা ট্রেড সেন্টার, ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম এভিণিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫। পিএবিএক্স : ০২-৫৫০১২২৫০। ই-মেইল : info@dailyamardesh.com

আজকের দিনে ডায়াবেটিস নিয়ে কথা বললে আমরা প্রায়ই শুনি—‘অতিরিক্ত খাওয়া’, ‘কম ব্যায়াম’, ‘অতিরিক্ত ওজন’ বা ‘জীবনযাত্রার অনিয়ম’। গণমাধ্যমে নিয়মিত এভাবেই ব্যক্তিগত অভ্যাসকেই বেশি দায়ী করা হয়। কিন্তু ডায়াবেটিসের সমস্যার এক বড় অংশ থাকে অদৃশ্য, যা লুকিয়ে আছে সমাজের কাঠামো, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও পরিবেশের গভীরে। ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক কারণগুলোই আজ ডায়াবেটিসকে দেশের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত করেছে।

আমরা প্রায়ই বলি—ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও ওষুধ গ্রহণ জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ কি এসব করার বাস্তব সুযোগ পাচ্ছে? একজন মানুষ যদি প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চান, তাহলে কি তিনি তা সহজে ও সাশ্রয়ী দামে পেতে পারেন? আমাদের শহরগুলোয় কি হাঁটার মতো নিরাপদ ফুটপাত বা পার্ক আছে? যেখানে তাকাই, দেখি দূষণ, যানজট আর ব্যস্ত নগরজীবন। এমন পরিবেশে ‘স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন’ শুধু পরামর্শ হিসেবেই থেকে যায়, বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব।

বিজ্ঞাপন

ডায়াবেটিস নিয়ে আলোচনায় ব্যক্তিগত দোষারোপ এখন এক সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক সময় মানুষ যতই চেষ্টা করুক, সামাজিক কাঠামো ও পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভালো খাবার দামি, খোলা জায়গা অপ্রতুল আর বায়ুদূষণ সর্বত্র। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভেজালমুক্ত খাবারের দুষ্প্রাপ্য—বাজারে ভেজাল ও ক্ষতিকর উপাদানে ভরা খাবার এখন সর্বত্র। এমন এক বাস্তবতায় মানুষ চাইলেও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে পারে না। এ অবস্থায় শুধু ব্যক্তিগত নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ তার শরীরের প্রতি দায়বদ্ধ—এই শরীর আমাদের ওপর আল্লাহর এক আমানত। কিন্তু সমাজও সেই দায়ের অংশীদার। সমাজের দায় হলো এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে মানুষ সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে। একজন ব্যক্তির যতই ইচ্ছা থাকুক, যদি সমাজ ও রাষ্ট্র তার পাশে না দাঁড়ায়, তবে স্বাস্থ্য রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস নিয়ে আলোচনায় ‘স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক’ বা সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অব হেলথ (Social Determinant of Health) প্রায় অনুপস্থিত। এটি এমন এক ধারণা, যা বলে—মানুষ যে পরিবেশে জন্মায়, বড় হয়, কাজ করে ও জীবন কাটায়, সেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তার স্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি গঠন করে। এর মধ্যে রয়েছে আয়, শিক্ষা, বাসস্থানের নিরাপত্তা, খাদ্যের প্রাপ্য, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্য ও পরিবেশের গুণগত মান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের স্বাস্থ্যের মাত্র ২৫ শতাংশ নির্ভর করে ব্যক্তিগত অভ্যাস ও জিনের ওপর, বাকি ৭৫ শতাংশ নির্ভর করে সামাজিক এবং পরিবেশগত বাস্তবতার ওপর। অর্থাৎ, সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতি, শিক্ষার মান, আবাসন, পরিষ্কার বাতাস ও চিকিৎসাসেবার প্রাপ্য—এসবই নির্ধারণ করে আমরা কতটা সুস্থ থাকব। তাই সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অব হেলথ (Social Determinant of Health) উপেক্ষা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে না, যতই ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাসের পরামর্শ দেওয়া হোক না কেন।

বাংলাদেশে এই সামাজিক নির্ধারকগুলো প্রায় উপেক্ষিত থেকে গেছে। ফলে আমরা বারবার জীবনযাত্রা পরিবর্তনের কথা শুনি, কিন্তু জীবনযাত্রা পাল্টাতে যে সামাজিক কাঠামো প্রয়োজন, তা গড়ে উঠছে না। আজ যদি কেউ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চায়, তাকে বেশি দাম দিতে হয়। যদি কেউ হাঁটতে চায়, তার জন্য নিরাপদ ফুটপাত নেই। পরিবেশদূষণ এতই মারাত্মক যে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাড়ে ৫ বছর কমে গেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর একটি।

এই বাস্তবতা দেখায়, ডায়াবেটিস শুধু হাসপাতালের রোগ নয়; এটি শহরের পরিকল্পনার, খাদ্যনীতির আর পরিবেশ ব্যবস্থাপনারও সমস্যা। যখন চারপাশের বাতাস দূষিত, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, বাসস্থানে ঘিঞ্জি অবস্থা—তখন শরীর সুস্থ থাকা কঠিন। ডায়াবেটিস তখন শুধু ব্যক্তির নয়, সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতা হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ জানে না যে তারা এই রোগে ভুগছে। অর্থাৎ লাখো মানুষ দিন কাটাচ্ছে এমন একটি অসুখ নিয়ে, যা নীরবে তাদের দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী কখনোই স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আসেনি। এটি আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বলতার এক স্পষ্ট চিত্র।

ডায়াবেটিসের প্রভাব শুধু রক্তে শর্করার মাত্রায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি দীর্ঘ মেয়াদে হৃদরোগ, কিডনি বিকল, চোখের দৃষ্টি নষ্ট হওয়া এবং স্নায়ুর ক্ষতির মতো জটিলতা তৈরি করে। এই রোগ ব্যক্তির কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, পরিবারে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ায় এবং জাতীয় উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, ডায়াবেটিস শুধু চিকিৎসার খরচ নয়—এটি অর্থনীতি ও সমাজের ওপরও এক গভীর আঘাত।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অদৃশ্য কারণ হলো মানসিক চাপ। নিম্ন আয়ের মানুষ যারা দিনমজুর, কারখানার শ্রমিক বা অল্প বেতনের চাকরিজীবী—তাদের জীবনে অতিরিক্ত পরিশ্রম, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও আর্থিক অনিশ্চয়তা ক্রমাগত মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ রক্তে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ডায়াবেটিস শুধু শরীরের রোগ নয়, এটি এক সামাজিক ও মানসিক সংকটও বটে।

এ অবস্থায় আমাদের ভাবতে হবে—স্বাস্থ্য শুধু হাসপাতালের সেবা নয়; এটি এক সামাজিক চুক্তি। একজন নাগরিকের সুস্থতা নির্ভর করে সমাজ কতটা ন্যায়ভিত্তিক, পরিবেশ কতটা পরিষ্কার এবং রাষ্ট্র কতটা দায়িত্বশীল। তাই সরকারের নীতিতে ‘স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক’কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে—ডায়াবেটিস কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ।

এই প্রচেষ্টায় সমাজ ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা অপরিহার্য। বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারেÑযেমন স্কুলে শিশুদের পুষ্টি শিক্ষা, কমিউনিটি সেন্টারে স্বাস্থ্যসচেতনতা কার্যক্রম আর মসজিদে ইমামদের মাধ্যমে খুতবায় শরীর ও স্বাস্থ্যের যত্নকে ইবাদতের অংশ হিসেবে স্মরণ করানো। সরকারি নীতিনির্ধারকরা যেন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বাইরে গিয়ে বাজার, কারখানা ও গ্রামের মানুষদের জন্য জনসচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করেন। এসব উদ্যোগ শুধু স্বপ্ন নয়—যদি আমরা নীতি, শিক্ষা ও সমাজকে এক সুরে এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে তা বাস্তবে রূপ নেওয়া সম্ভব।

স্বাস্থ্যকে একটি সামাজিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার—সবাই মিলে কাজ না করলে ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ কখনোই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আমাদের ধর্মও বলে, ‘তোমার শরীরের ওপর তোমার হক আছে’—অর্থাৎ শরীরের যত্ন নেওয়া ইবাদতেরই অংশ। কিন্তু সেই যত্ন তখনই পূর্ণ হয়, যখন সমাজ ও রাষ্ট্র এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষ সহজে সুস্থভাবে বাঁচতে পারে।

এই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস দিবসে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে—স্বাস্থ্য কি শুধু ব্যক্তিগত দায়, না এটি এক জাতীয় দায়বদ্ধতা? প্রতিটি মানুষ তার দায় পালন করবে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজকে নেতৃত্ব দিতে হবে। কারণ একজন সুস্থ নাগরিকই একটি শক্তিশালী জাতির ভিত্তি। ডায়াবেটিস মোকাবিলায় সমাজ ও রাষ্ট্র যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে একটি সুস্থ এবং আলোকিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

লেখক : স্বাস্থ্য যোগাযোগবিষয়ক গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশনস বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

আমার দেশসামাজিকমাধ্যম
সর্বশেষ
১

সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না কোচ কাবরেরা

২

বন্যার ঝুঁকিতে গাজার ৯ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ

৩

এনসিপির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময় বাড়লো

৪

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি, পদ ২৬

৫

চসিকের উদ্যোগে ১৫ ভবন ভাঙার পরিকল্পনা, ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত

হাসিনার রায়, ইউনূসের চমক

বাজিমাত করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গণভোট, জুলাই সনদসহ রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের পর রাজনৈতিক দলগুলো মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামেনি। জাতি যেন এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল। রাজনৈতিক সমঝোতার ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে জাতির সামনে হাজির হয়ে তিনি সত্যিই চমকে দিয়েছেন সবাইকে

২ ঘণ্টা আগে

ভোটের আগে গণভোট নিয়ে বিতর্ক কেন?

বাংলাদেশে নভেম্বর-২০২৫-এ যে অবস্থা চলছে, পরাজিত ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের যে প্রকাশ্য হুমকি, অপতৎপরতা এবং অন্তর্ঘাত চলছে, তাতে করে জনঐক্য ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা সর্বাধিক জরুরি। এই পরিস্থিতিতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনের আগেই গণভোট হবে কি না এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো

২ ঘণ্টা আগে

গাজার যুদ্ধ থেকে টাটা গ্রুপের মুনাফা

ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপ। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বর্তমানে সমরাস্ত্র, রাসায়নিক শক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৩০টিরও বেশি কোম্পানি পরিচালনা করছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে ভারতীয় পুঁজিবাদের বিবেক হিসেবে উদযাপন করা হয়েছে।

১ দিন আগে

ভারতের মদতে হাসিনার অগ্নিসন্ত্রাস

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে পলাতক হাসিনা ও তার সহযোগীরা। এই পরিকল্পনায় দিল্লির যে সক্রিয় সমর্থন আছে, তাও স্পষ্ট। গত বছরের ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন নীরব ছিলেন হাসিনা।

১ দিন আগে
ডায়াবেটিস : শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক দায়ের রোগ

ডায়াবেটিস : শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক দায়ের রোগ

হাসিনার রায়, ইউনূসের চমক

হাসিনার রায়, ইউনূসের চমক

ভোটের আগে গণভোট নিয়ে বিতর্ক কেন?

ভোটের আগে গণভোট নিয়ে বিতর্ক কেন?

গাজার যুদ্ধ থেকে টাটা গ্রুপের মুনাফা

গাজার যুদ্ধ থেকে টাটা গ্রুপের মুনাফা