নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে নানা আলোচনা

রকীবুল হক
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৫: ৩৮
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৪০

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী তিন বছরের (২০২৬-২৮) জন্য নতুন আমির নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে। একই মেয়াদের জন্য নতুন করে গঠন করা হবে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কর্মপরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ। এরই মধ্যে দলের আমির নির্বাচনের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা। আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এসব নির্বাচনি কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।

দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সদস্যদের (রুকন) গোপন ভোটে জামায়াত আমির তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হন। আমির নির্বাচনের জন্য বিদায়ী কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্যরা তিনজনের একটি প্যানেল গঠন করেন। তবে প্যানেলের বাইরে যেকোনো রুকনকে ভোট দেওয়ার অধিকার ভোটারদের থাকে। নির্বাচিত হওয়ার পর আমির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার নির্বাচিত সদস্য, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে শপথ নেন।

বিজ্ঞাপন

নতুন আমির নির্বাচন প্যানেলে এবার কারা আছেন, তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। রুকনদের কাছে ব্যালট পাঠানোর সময় এটি প্রকাশ হবে। তবে ডা. শফিকুর রহমানই আমির থাকছেন বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই প্যানেলে নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবং সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরে নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সদ্য কারামুক্ত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মধ্য থেকে কারো নাম আমির প্যানেলে থাকতে পারে অথবা প্যানেলের বাইরে থেকে তারা ভোট পেতে পারেন। পতিত আওয়ামী সরকারের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও বর্তমান সরকারের সময় বেকসুর খালাস পাওয়া এটিএম আজহার দলের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হিসেবে আছেন। আগামী মেয়াদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেনÑএমন প্রত্যাশা করছেন অনেকে।

কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার এক সদস্য জানান, আমির নির্বাচনের গত প্যানেলে ডা. শফিকুর রহমান, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবং অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নাম ছিল। এবারও তাদের নাম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী জামায়াতের আমিরসহ কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়ে থাকলেও জুলাই বিপ্লবপরবর্তী ভিন্ন পরিস্থিতি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারের এ আয়োজন বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা, আসন সমঝোতা এবং নির্বাচনি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাসহ পরবর্তী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন নতুন নেতারা। নতুন মানবিক একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে দলের সাধারণ নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তাই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাকেই বেছে নেওয়া হতে পারে।

এর আগে ২০২২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো (২০২৩-২৫) আমির নির্বাচিত হন ডা. শফিকুর রহমান। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এক ব্যক্তির একাধিকবার আমির হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে বর্তমান আমিরের তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তাছাড়া এখন পর্যন্ত নতুন মেয়াদে দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা বা অপারগতার কোনো আবেদনও তিনি দলীয় ফোরামে করেননি। যদিও হার্টের অসুস্থতাজনিত কারণে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। বাইপাস সার্জারিকালে দীর্ঘ এক মাস তিনি দলীয় কার্যক্রম থেকে প্রায় বিরত ছিলেন। তবে সুস্থ হওয়ার পর আবারও অনেকটা স্বাভাবিকভাবে দলীয় দায়িত্ব পালন করছেন ৬৬ বছর বয়সি এই নেতা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৫ আসনের প্রার্থী হিসেবেও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

আমির নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের আমার দেশকে বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমিরের মেয়াদ তিন বছর। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন আমির নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে গত মজলিসে শূরার শেষ অধিবেশনে তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচিত করা হয়েছে। এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা পাঁচ সদস্যের কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচিত প্যানেল, চিঠি এবং ব্যালট সারা দেশে দলীয় প্রিসাইডিং অফিসারদের কাছে পাঠানো হবে। তারা দলের জেলা-মহানগরসহ ৭৯ শাখায় নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করে রুকনদের ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। ওই ভোটের ভিত্তিতেই নতুন আমির নির্বাচিত হবেন। বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম।

জামায়াতের এই নেতা আরো বলেন, মজলিসে শূরার সদস্যরা আমির নির্বাচনের তিন সদস্যের প্যানেলের জন্য ভোট দিলেও তারা এর ফলাফল এখনো জানতে পারেননি। এটি এখনো প্রকাশ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠি যাওয়ার পর অর্থাৎ ১৫ অক্টোবরের পরই এসব শূরা সদস্য ও রুকনরা প্যানেল সম্পর্কে জানতে পারবেন।

সূত্রমতে, আমির নির্বাচনের পরপরই তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরাও নির্বাচিত করবেন রুকনরা। এই নির্বাচন হয় চার ধাপে। প্রথম ধাপে রুকনদের সরাসরি ভোটে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ/নির্বাহী পরিষদ থেকে নির্ধারিত আনুপাতিক হারে শূরা সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথম দফায় নির্বাচিতরা আবার রুকনদের মধ্য থেকে ৩০ জনকে শূরা সদস্য নির্বাচিত করেন। তৃতীয় দফায় নতুন আমির শতকরা ১৫ জন শূরা সদস্য নির্বাচিত করেন। সর্বশেষ চতুর্থ ধাপে নতুন নির্বাহী পরিষদ ও কর্মপরিষদে যদি কেউ শূরা সদস্যের বাইরে থাকেন, তাহলে পদাধিকারবলে তিনি সদস্য হবেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় মহিলা মজলিসে শূরা সদস্যরা কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য হবেন। নতুন মজলিসে শূরার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা আমিরের কাছে শপথ নেন। বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য তিন শতাধিক আর রুকন আছেন এক লাখ পাঁচ হাজারের মতো।

দলীয় সূত্র জানায়, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার পর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ নির্বাচন হবে। নতুন মজলিসে শূরার সদস্যরাই এ পরিষদ নির্বাচিত করবেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নায়েবে আমির, একজন সেক্রেটারি জেনারেল, প্রয়োজনীয়সংখ্যক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, বিভাগীয় সেক্রেটারি ও অন্য সদস্যদের সমন্বয়ে এ পরিষদ গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় মহিলা কর্মপরিষদ সদস্যরা এই পরিষদের সদস্য হবেন। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যরা আমিরের কাছে শপথ নেবেন। নতুন আমিরের শপথের পর পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে।

একই ভাবে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিতে অনধিক ২১ সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ গঠিত হবে। মজলিসে শূরার সদস্যরাই এই পরিষদ নির্বাচন করবেন।

এদিকে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মজলিসে শূরার সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, বিভাগীয় সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি নিয়োগ করতে পারবেন। তাদের শপথ পড়াবেন আমির। তবে গঠনতন্ত্রে ‘জাতীয় কাউন্সিল’ নামে একটি ফোরাম থাকলেও তা বিশেষ পরিস্থিতিতে বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে তার বাস্তবায়ন শুরু হয়নি বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

সূত্রমতে, শফিকুর রহমান ছাত্রাবস্থায় ১৯৭৩ সালে জাসদ ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। পরে ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেন। সিলেট মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি প্রথমে ওই প্রতিষ্ঠানের শিবিরের সভাপতি ও পরে সিলেট শাখার সভাপতি হন। ১৯৮৪ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে তিনি সিলেট শহর, জেলা ও মহানগর আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ও ২০১৬ সালে সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পান তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১৫ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে অংশ নেন। আওয়ামী সরকারের চরম জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় তিনি ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর প্রথমবার আমির নির্বাচিত হন। পরে ২০২২ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয়বারের মতো আমির নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। চরম প্রতিকূল পরিবেশে এসব দায়িত্ব পালনের সময় তিনি একাধিকবার কারা নির্যাতনের শিকার হন। পরিবারের সদস্যরাও এই নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি।

জুলাই বিপ্লবে পেছন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন ডা. শফিকুর রহমান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের দিন বিশেষ ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। নতুন সরকার গঠন থেকে শুরু করে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলীয় কার্যক্রমে তার নেতৃত্ব ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। বর্তমানে তিনি মানবিক একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন।

দলের শীর্ষনেতারা জানান, দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত করা হয়। বিগতদিনে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যথাসময়ে নতুন নেতা নির্বাচিত করা হয়। তবে আওয়ামী সরকারের সময়ে অনেক গোপনীয়তা রক্ষা ও কৌশলে ভোটগ্রহণ করা হলেও এবার অনেকটা উৎসবমুখরভাবে অনুষ্ঠিত হবে নতুন আমির ও মজলিসে শূরার নির্বাচন কার্যক্রম। নির্বাচিতদের মেয়াদ ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত