দীর্ঘ দিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট ভেঙে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেদের একটি উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে বিএনপি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের ১৬ মাস পর এমন অবস্থান নিতে চাইছে বিএনপি।
হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারপন্থী দল দাবি করে আসছে আওয়ামী লীগ। যদিও সমালোচকরা এই দাবির সঙ্গে একমত নন।
আওয়ামী লীগের প্রতি বিরোধের কারণে এক হয়েছিল বিএনপি ও জামায়াত। কিন্তু তাদের আদর্শিক পার্থক্য কখনোই গোপন ছিল না—বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী, অন্যদিকে জামায়াত একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
এই পার্থক্যগুলো এখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটি পূর্ণ বিভক্তি সৃষ্টি করেছে, যারা ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে জোট হিসেবে সরকার গঠন করেছিল।
চলতি সপ্তাহে দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘তখন কী ঘটেছে, তা মানুষ দেখেছে।’ তিনি জামায়াতের নাম উল্লেখ না করলেও ইঙ্গিতটা জামায়াতের প্রতি ছিল, তা পুরোপুরি স্পষ্ট।
একই সঙ্গে জামায়াতের বিরুদ্ধে ভোট চাওয়ার সময় ধর্মের অপব্যবহারের অভিযোগ আনেন বিএনপির এই নেতা।
গত মাসে একই রকমের মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ‘ধর্মের নামে দেশকে বিভক্ত করার’ বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন এবং জোর দিয়ে বলেছিলেন, বিএনপির রাজনীতি জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক নীতি এবং ১৯৭১ সালের মূল চেতনার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
তাহলে এই পরিবর্তনের নেপথ্যে কী—এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ আত্মস্থ করতে চায়, যা আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করে আসছে।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়টাও তারই ছিল। তিনি ১৯৭৫ সালে একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার জন্য অন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকাকালে হাসিনা সেই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, যাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও ছিলেন। ‘সংকটাপন্ন অবস্থায়’ খালেদা জিয়া বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি।
রাজনৈতিক বিরোধী দল এবং অন্য সমালোচকদের ওপর হাসিনা সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পায়।
আওয়ামী লীগের তৈরি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী শূন্যস্থান দখল করতে বিএনপিকে একটি ইসলামপন্থি দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
নিশ্চিতভাবেই বিএনপি ও জামায়াত রাতারাতি বিভক্ত হয়নি। কয়েক মাস ধরে উভয় দলই মূল প্রশ্নগুলো নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে—নির্বাচনের আগে বৃহত্তর সংস্কার করা উচিত কি না, সংবিধান কীভাবে পুনর্গঠন করা উচিত এবং হাসিনা-পরবর্তী যুগকে কোন রাজনৈতিক মডেল সংজ্ঞায়িত করা উচিত।
জামায়াত নির্বাচনের আগে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য জোর দিয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি আগাম নির্বাচন এবং ন্যূনতম সাংবিধানিক সংশোধনের ওপর জোর দিয়েছিল। তাদের মতবিরোধ ধীরে ধীরে ফাটলে রূপ নেয়।
কিন্তু এই বিভক্তি কেবল কৌশলগত মতবিরোধের বিষয়ে নয়। এটি নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চালিত একটি আদর্শিক পুনর্বিন্যাসকে প্রতিফলিত করে।
আওয়ামী লীগ এক সময় যে মধ্য-বাম, উদার-ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার দাবি করেছিল, তা এখন শূন্য। ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি এটি দখল করার সুযোগ দেখছে।
বিএনপির হিসাব-নিকাশ ভোটারদের পরিবর্তনশীল মেজাজের ওপর নির্ভরশীল। ২০২৪ সালের তরুণদের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ, একদলীয় কর্তৃত্ববাদের পতন এবং শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের নাগরিক জাগরণ—এসবের কারণে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সংযম বজায় রাখার নয়া দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
বিএনপির বিশ্বাস, জামায়াতের ধর্মকেন্দ্রিক ঝোঁক সেই অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। বিএনপি নিজেদের পুনর্গঠন করেছে এবং দলটির বিশ্বাস, এটি আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদ এবং জামায়াতের ধর্মীয় রক্ষণশীলতা—উভয়ের প্রতিই হতাশ ভোটারদের নাড়িয়ে দিতে পারে।
বিএনপির পুনর্গঠনের লক্ষ্য ১৯৭১ সালের নৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধার করা। যুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষে জামায়াতের অবস্থানকে গত কয়েক দশক ধরে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে আওয়ামী লীগ। জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ায় বিএনপিকেও এই অস্ত্র দিইয়ে ঘায়েল করে এসেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি এখন সেই বয়ান পাল্টে দিচ্ছে।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকার নিন্দা করে বিএনপি আওয়ামী লীগের অর্ধশতাব্দীর একচেটিয়া আদর্শিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করছে। মূলত যেসব তরুণ একাত্তরকে কোনো নির্দিষ্ট দলের আনুগত্যের পরিবর্তে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করাই বিএনপির লক্ষ্য।
তবে এই পরিবর্তনের চেষ্টা মোটেও ঝুঁকিমুক্ত নয়। এই পুনর্গঠনটি প্রকৃত নাকি সুবিধাবাদী, তা নিয়ে বিএনপিকে সংশয় কাটিয়ে উঠতে হবে। বিএনপির ভেতর থেকে এই পরিবর্তনকে প্রতিহত করা হতে পারে।
এছাড়া হাসিনা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ বেশ জনাকীর্ণ। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং সুশীল সমাজের নেটওয়ার্কের মতো তরুণদের দলগুলোর উদারপন্থাকেন্দ্রিক ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকায় একতাবদ্ধ হতে না পারলে বিএনপি খুব বেশি লাভবান হবে না।
তবুও বিএনপির পুনর্গঠনের পেছনে কৌশলগত যুক্তি আপাতত আকর্ষণীয় বলেই মনে হচ্ছে।
দলটি আর নিজেকে মধ্য-ডানপন্থী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে না; এটি নিজেকে একটি বিস্তৃত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরের চেষ্টা করছে; যা আওয়ামী লীগের ভোটার, নগর উদারপন্থী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিকভাবে জাগ্রত তরুণদের একত্রিত করে, যারা সবাই একটি নতুন রাজনৈতিক আবাসস্থল খুঁজছে।
এই পরিবর্তন সফল হবে কি না, তা নির্ভর করবে বিএনপি কতটা ধারাবাহিকভাবে এই নতুন আদর্শিক অবস্থান বজায় রাখে।
তবে এরই মধ্যে যা স্পষ্ট, তা হলো ২০২৫ সালের বিএনপি গত দশকের বিএনপি নয়। এর নেতারা একটি নতুন ভাষায় কথা বলছেন—যার মূলে রয়েছে অন্তর্ভুক্তি, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার। দলটি এসব বিষয়ে জোরেশোরেই কথা বলছে।
জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আওয়ামী লীগের মালিকানাধীন আদর্শিক ভিত্তিতে পা রেখে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পুনর্গঠন করছে। যদি এই রূপান্তর অব্যাহত থাকে, তাহলে এটি ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিন্যাস হতে পারে।
আলজাজিরায় প্রকাশিত ফয়সাল মাহমুদের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন শেখ আব্দুল্লাহ আল নোমান


রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
বিএনপি-জামায়াতের ভোটের ব্যবধান ৪%
বিএনপির কোন্দলে বাড়ছে জামায়াতের সম্ভাবনা