আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বিশ্ব শরণার্থী দিবস

আশ্রয়দানে ইসলামের অনন্য নির্দেশনা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আশ্রয়দানে ইসলামের অনন্য নির্দেশনা

প্রতি বছর ২০ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এই দিনটি এমন সব মানুষের প্রতি সম্মান জানানোর একটি বিশেষ উপলক্ষ, যারা যুদ্ধ, নিপীড়ন, ধর্মীয় বিভেদ বা অন্যান্য সংকটের কারণে নিজ দেশ থেকে উৎখাত হয়ে আশ্রয়ের জন্য অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। শরণার্থীরা নিঃস্ব, নিরাশ্রয় এবং প্রায়ই মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের শিকার। এই প্রেক্ষাপটে ইসলাম শরণার্থী বা মজলুমদের জন্য যে মানবিক, করুণাময় ও ন্যায়ভিত্তিক নির্দেশনা দিয়েছে, তা সমকালীন বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

শরণার্থীর সংজ্ঞা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থার (UNHCR) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা, যাদের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, মিয়ানমার, ইউক্রেনসহ অনেক দেশের নাগরিক।

শরণার্থীদের জীবন মানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তা ও আত্মমর্যাদার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম। এই সংকটে আন্তর্জাতিক সমাজ অনেক সময় দায়িত্ব এড়িয়ে চলে। তখনই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে ধর্মীয় নীতিমালা, বিশেষত ইসলাম ধর্মের মহত্ত্বপূর্ণ নির্দেশনা।

ইসলামের শরণার্থী-বিষয়ক নীতিমালা

১. আশ্রয়দানের নির্দেশনা

ইসলামে শরণার্থীদের আশ্রয়দানকে শুধু মানবিকতা নয়, বরং ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে দেখা হয়। আল-কোরআনে বলা হয়েছেÑ‘যদি কোনো মুশরিক তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তুমি তাকে আশ্রয় দাও যতক্ষণ না সে আল্লাহর বাণী শুনে নেয়, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।’ (সুরা আত-তাওবা : ৬)।

এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে—এমনকি একজন শত্রু বা অমুসলিম হলেও সে যদি নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের কাছে আসে, তবে তাকে আশ্রয় দেওয়া ইসলামের বিধান।

২. মুহাজিরদের সম্মান ও সহযোগিতা

ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম শরণার্থী সংকট দেখা দিয়েছিল মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে। মহানবী (সা.) ও সাহাবারা যখন মক্কার অত্যাচারে মদিনায় হিজরত করেন, তখন মদিনার মানুষ—আনসারিরা তাদের যে ভালোবাসা ও আশ্রয় দিয়েছিলেন, সেটিই শরণার্থী সহযোগিতার প্রথম ইসলামি দৃষ্টান্ত। আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘এবং তারা (আনসাররা) মুহাজিরদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা নিজেরাও অভাবগ্রস্ত।’ (সুরা হাশর : ৯)।

৩. মানবিকতা ও করুণার শিক্ষা

ইসলাম সব মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে দেখে। হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘তুমি পৃথিবীর মানুষদের প্রতি দয়া করো, আকাশের অধিপতি (আল্লাহ) তোমার প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি: ১৯২৪)। এই হাদিস শরণার্থীসহ সব দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি করুণা প্রদর্শনের মৌলিক শিক্ষা দেয়।

আধুনিক বিশ্বে ইসলামের আদর্শ কতটুকু প্রয়োগ হয়?

বর্তমানে অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রই দুর্যোগ বা যুদ্ধপীড়িত শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে গড়িমসি করে। অথচ ইসলাম বলে, যার যার সামর্থ্য অনুপাতে এসব মানুষকে সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে। এমনকি অমুসলিম শরণার্থীর প্রতিও সমান সদ্ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। বিপরীতে, ইউরোপের কিছু দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে এবং সমুদ্রপথে আসা শরণার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। ইসলাম এ ধরনের অমানবিক আচরণকে ঘৃণা করে এবং প্রতিটি প্রাণের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে বলে।

শরণার্থীদের জন্য ইসলামি সমাজের করণীয়

১. আশ্রয় ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : শরণার্থীদের নিরাপদ বাসস্থান ও খাদ্য নিশ্চিত করা উচিত।

২. চিকিৎসা ও শিক্ষা সহায়তা : শরণার্থীদের জন্য মৌলিক চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা।

৩. আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে তোলা : কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন করা।

৪. সামাজিক সম্প্রীতির শিক্ষা : শরণার্থী ও আশ্রয়দানকারী জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সম্প্রীতির চর্চা।

বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদের প্রতিটি মানবিক হৃদয় যেন কাঁদে নিঃস্ব ও ঘরছাড়া মানুষগুলোর জন্য। ইসলাম শুধু উপদেশের ধর্ম নয়, বরং বাস্তব মানবিক দায়িত্ব পালনের ধর্ম। আজকের বিশ্ব যদি ইসলামের এই শিক্ষা বাস্তবায়ন করত—যেখানে প্রতিটি মানুষ নিরাপত্তা ও সম্মান পেত, তাহলে পৃথিবীতে শরণার্থী বলতে কিছুই থাকত না।

আসুন, বিশ্ব শরণার্থী দিবসে ইসলামি মূল্যবোধকে সামনে রেখে আমরা সবাই মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিই শরণার্থীদের প্রতি—ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন