আধুনিক সমাজে হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং, দুর্নীতি, সুদ-ঘুসসহ নানা অপরাধ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরগুলোয় কিশোরগ্যাং কালচার অভিভাবকদের আতঙ্কিত করে তুলছে। ছেলেমেয়েরা বা মা, শিক্ষক ও গুরুজনদের প্রতি ভক্তি এবং শ্রদ্ধার আবহমানকালের সুন্দর ও কাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে। এসবের মূল কারণ হলো নৈতিক অবক্ষয়। নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারালে সমাজে শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, দেখা দেয় সামাজিক বিপর্যয়। তাই সামাজিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে হলে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকল্প নেই। কারণ ধর্মের প্রকৃত অনুশীলনই শুধু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পারে।
শিশুদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা
নৈতিক সমাজ গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুদের সঠিকভাবে লালনপালন। বাবা-মা ও অভিভাবকদের প্রধান দায়িত্ব সন্তানদের নৈতিক এবং মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা; যেন তারা দুনিয়ায় সফল হয় এবং পরকালে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারে। এ জন্য শৈশব থেকেই তাদের মনমানসিকতার প্রতি যত্নবান হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন তাদের মন পাপে আসক্ত হয়ে না পড়ে। এর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষা ও ধর্মের অনুশীলন অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিশুদের প্রতি এমন যত্নশীল হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা তাহরিম : ৬)
ইসলাম শিক্ষা ও নৈতিকতা
ইসলাম শিক্ষা মানুষকে সঠিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধে পরিচালিত করে। ইসলামি মূল্যবোধের মূল ভিত্তি হলো ঈমান। ঈমান মানুষকে সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারি ও সংযমের জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। পরকালে হিসাবনিকাশ ও প্রতিদানের বিশ্বাস মানুষকে গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। ফলে সমাজে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। আসলে পরকালের বিশ্বাস মানব জীবনের গতিই পাল্টে দেয়। যেকোনো গর্হিত আচরণ থেকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে বিরত রাখে। এ বিশ্বাসের মাধ্যমেই মূলত মুসলমানরা অন্য জাতির মোকাবিলায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আসনে উত্তীর্ণ হয়। পরকালের চিন্তার প্রতি উৎসাহিত করে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।’ (সুরা হাশর : ১৮)
প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা
শিশুর চরিত্র গঠনের জন্য শৈশবকালীন শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শৈশব ও কৈশোরের শিক্ষা মানুষের মনস্তত্ত্ব ও চিন্তা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শৈশবে সুশিক্ষা না পেলে পরবর্তী জীবনে শিশুর আদর্শ জীবন গঠন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পারিবারিক শিক্ষাও অনেকে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ হওয়ার ফলে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। আবার সব অভিভাবকের পক্ষে শিশুর জন্য পৃথক ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব ও আয়োজন করাও সম্ভব হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা সিলেবাসভুক্ত থাকলেও যোগ্য শিক্ষকের অভাবে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না। ফলে শিশুরা বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত, ইবাদত-বন্দেগি এবং প্রকৃত নৈতিকতার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, নৈতিক অবক্ষয় সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে শিশুদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা অপরিহার্য। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং অভিভাবকের যত্নশীল ভূমিকা সমাজকে একটি নৈতিকতাভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজে রূপান্তরিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ইসলামি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগদানের ব্যবস্থা করা একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

