বছর ঘুরে মুসলিমদের দ্বারে হাজির হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের দশ তারিখ ‘ইয়াওমুল আশুরাহ’ তথা ‘আশুরার দিবস’। এ দিবসটি মুমিনদের জীবনে এমন এক ফজিলতপূর্ণ ও শিক্ষাপ্রদ ঐতিহাসিক দিবস, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিনের সঙ্গে যার তুলনা প্রায় অসম্ভব। সহিহ হাদিসেও দিবসটির বর্ণনা এসেছে।
সহিহ হাদিসের বর্ণনায় আশুরার ইতিহাস
সহিহ হাদিসে আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে মাত্র একটি বর্ণনাই পাওয়া যায়, যা মূলত আশুরার দিনের আমল সম্পর্কিত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া অন্য যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়, হাদিসের ইমামদের মতে সেগুলো অত্যন্ত দুর্বল ও জাল। এসবের কিছুই নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণিত হয়নি, বরং অত্যন্ত দুর্বল সূত্রে কিছু সাহাবি ও তাবেয়ি থেকে বর্ণিত হয়েছে।
মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তি
সহিহ হাদিসে বর্ণিত আশুরার দিনের একমাত্র ঘটনাটি হচ্ছে মিসরের অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের হাত থেকে মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তিলাভ। সহিহ হাদিসে এ ঘটনা সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) হিজরত করে মদিনায় এলেন এবং তিনি মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিন সিয়াম পালন করতে দেখলেন। তাদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এটা সেদিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছেন। তার সম্মানার্থে আমরা রোজা রাখি। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা তোমাদের চেয়েও মুসা (আ.)-এর বেশি নিকটবর্তী।’ এরপর তিনি এদিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (মুসলিম : ২৫৪৮)
আশুরা দিবসের আমল ও ফজিলত
সহিহ হাদিসের আলোকে আশুরার দিনের একমাত্র বিশেষ আমল হচ্ছে সিয়াম পালন। তবে এ সিয়াম দুদিন পালন করতে হবে। ইহুদিদের মতো এক দিন সিয়াম পালন করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার উম্মতকে এদিন এবং ৯ বা ১১ তারিখ সিয়াম পালনের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। (ইবনু রজব, লাতাইফ : ১/৬৮-৭৬; আব্দুল হাই লাখনবি, আল আসারুল মারফুআ, পৃষ্ঠা : ৯১-৯৪)
রুবাইয়ি বিনতে মুআউয়িজ ইবনে আফরা (রা.) বলেন, আশুরার সকালে রাসুল (সা.) আনসারদের সব পল্লিতে এ নির্দেশ দিলেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেনি, সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে, আর যে ব্যক্তি সিয়াম পালনকারী অবস্থায় সকাল করেছে, সে যেন সাওম পূর্ণ করে।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘পরে আমরা ওইদিন সিয়াম পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের সিয়াম পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম । তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত।’ (বোখারি : ১৯৬০)
আশুরার সিয়ামের ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এ দিনের সিয়াম গত এক বছরের গুনাহ মাফ করে।’ (মুসলিম : ২/৮১৯)
দুর্বল হাদিসের বর্ণনায় আশুরার ইতিহাস
সহিহ বোখারি ও মুসলিমের বর্ণনা ছাড়া আশুরার ইতিহাস বর্ণনায় অনেক দুর্বল ও জাল হাদিস বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কিত কিছু বর্ণনা নিম্নরূপ—
১. আদম (আ.)-এর সৃষ্টি।
২. পুরো সৃষ্টিজগতের সৃষ্টি।
৩. ইসা (আ.)-এর জন্ম।
৪. ইউসুফ (আ.)-এর কারামুক্তি।
৫. ইয়াকুব (আ.)-এর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া।
৬. ইদরিস (আ.)-কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া।
৭. ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্তিলাভ।
৭. কিয়ামত সংঘটিত হওয়া।
এসবের প্রতিটি বর্ণনাই দুর্বল, বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বর্ণনা। (আল-আসারুল মারফুআ, আবদুল হাই লাখনবি : ৬৪-১০০; মা সাবাহা বিসসুন্নাহ ফি আইয়্যামিস সানাহ : ২৫৩-২৫৭)
আশুরা দিবসের শিক্ষা
১. নবী-রাসুলদের ঘটনাবলিকে গুরুত্ব দেওয়া।
২. আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়।
৩. শিরকের ভয়াবহ পরিণাম, কেননা আল্লাহ শিরকের গুনাহ মাফ করেন না। (সুরা নিসা : ৪৮, ১১৬)
৪. অত্যাচারীর পতন। (সুরা ইউনুস : ৯০-৯২)।
৫. ছোটদের সিয়াম পালন ও ত্যাগের শিক্ষা দেওয়া।
৬. বিধর্মীদের বিপরীত করা।
আশুরাকেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার
শাহাদাতে হুসাইন (রা.)-কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায়, তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। এ জন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদি থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য, এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার। হাদিসে এসব কাজকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো হলো—তওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াাজ থেকে বেঁচে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।

