আবু বকর (রা.) শাসনামল ছিল খিলাফত রাষ্ট্রের উদয়কাল। এই সময়ে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের রূপরেখা গড়ে উঠছিল। যোগ্য ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিরা শাসনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল। আইন-আদালত, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী সুসংহত হচ্ছিল। প্রশাসনিক দায়িত্বে জনবল নিযুক্ত হচ্ছিল, পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত হচ্ছিল, শাসনাঞ্চল বৃদ্ধি পাচ্ছিল, প্রাদেশিক শাসন বিন্যস্ত হচ্ছিল, সামরিক শক্তি ও সামর্থ্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল; সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠছিল অর্থনৈতিক কাঠামো।
আবু বকর (রা.)-এর শাসনকাল দুই বছরের কিছু বেশি সময় হলেও খিলাফত রাষ্ট্রের কাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হয়। নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে জনপরিসরে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার ভীতি জন্ম নেয়। তিনি দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করে সব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম নতুন উদ্যমে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগী হন। প্রথম খলিফার শাসনামলে রাষ্ট্রের যেসব সেক্টরে সাফল্য ও নতুনত্ব আসে, তার অন্যতম হলো অর্থনীতি।
আবু বকর (রা.)-এর যুগে অর্থনৈতিক কাঠামো রাসুল (সা.)-এর যুগের অর্থনীতির খুবই কাছাকাছি ছিল। সে সময় বিজয়াভিযান ব্যাপকতা লাভ করে, খিলাফত রাষ্ট্রের সীমানা প্রসারিত হতে থাকে এবং বাইতুল মালের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তখন খিলাফত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার, পরিবর্তন ও বিকাশ সাধিত হয়। বাইতুল মালের আয়ের উৎসগুলো থেকে সম্পদ জমা করা এবং তা ন্যায়সংগতভাবে বণ্টন করা ছিল খলিফা আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব।
বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠা
বাইতুল মাল হলো খিলাফত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কোষাগার, যেখানে রাষ্ট্রের অর্জিত সম্পদ জমা ও সংরক্ষণ করা হয় এবং বিধিবদ্ধ খাতে ব্যয় করা হয়। আবু বকর (রা.) হলেন বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠাকারী প্রথম খলিফা। (তারিখুল খুলাফা, জালালুদ্দিন সুয়ুতি: ৬০)। প্রাথমিকভাবে তিনি মদিনার উপকণ্ঠে হারিস ইবনে খাজরাজ গোত্রের বাসভূমিতে সেটা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের বাসগৃহে বাইতুল মাল স্থানান্তর করেন।
আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে বাইতুল মালের জন্য নির্ধারিত কোনো স্বতন্ত্র প্রহরী ও দায়িত্বশীল ছিল না। তখন এর খুব বেশি প্রয়োজনও ছিল না। কেননা, তাঁর যুগে বাইতুল মালের আয়ের পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। আর বিভিন্ন উৎস থেকে যা আয় হতো তা সবই জনতার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। ফলে বাইতুল মালে অতিরিক্ত সম্পদ জমা থাকত না। তবে সামগ্রিকভাবে খিলাফত রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাবনিকাশসহ যাবতীয় আর্থিক দায়িত্ব পালন করতেন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)। বাইতুল মাল ব্যবস্থা পূর্ণতা পেয়েছিল দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর শাসনামলে।
আবু বকর (রা.) শাসনামলের মুদ্রা
রাসুল (সা.)-এর যুগে এবং খলিফা আবু বকর (রা.)-এর যুগে খিলাফত রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো মুদ্রা ছিল না। আরবরা এ সময় পারস্য সাম্রাজ্যের রৌপ্যমুদ্রা (দিরহাম) ও রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) এর মাধ্যমে লেনদেন করত।
বাইতুল মালের আয়ের উৎস
আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাই প্রতিটি সাম্রাজ্যের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। খলিফা আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে খিলাফত রাষ্ট্রে এই নীতি অনুসরণ করা হয়, গড়ে তোলা হয় বাইতুল মাল। কোরআন-সুন্নাহর বিধানমতে বিভিন্ন আয়ের উৎস থেকে তখন বাইতুল মালে অর্থ জমা হতো। নিচে আবু বকর (রা.)-এর যুগের বাইতুল মালের গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎসগুলো তুলে ধরা হল—
এক. রাসুল (সা.)-এর হিসসা
গনিমত ও ফাইয়ের (যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি) বিশেষ অংশ আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীজি (সা.)-এর জন্য নির্ধারিত ছিল। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি সেটা গ্রহণ করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর আবু বকর (রা.)-এর যুগে নবীজির প্রাপ্য অংশ বাইতুল মালে প্রদান করা হয়।
দুই. খিরাজ
মুসলিম রাষ্ট্র কর্তৃক বিজিত ভূমির ওপর অধিকার বজায় রেখে সেখানকার অধিবাসীদের চাষাবাদের বিনিময়ে যে নির্ধারিত ভূমি-কর আরোপ করা হয়, তাকেই খিরাজ বলা হয়। আবু বকর (রা.) অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজিত জমি মুসলিম বিজেতাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। আর উমর (রা.) এসব জমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দিতেন। সেখান থেকে বাইতুল মালে খিরাজ আসত। এছাড়া নির্ধারিত পরিমাণ ফসল বা অর্থ প্রদানের শর্তে সন্ধির মাধ্যমে অর্জিত ভূমি থেকেও বাইতুল মালে খিরাজ আসত। খিরাজ উত্তোলনের জন্য বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো। খিরাজ উত্তোলনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ধর্মীয় জ্ঞান রাখা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী হওয়া, সচ্চরিত্রবান হওয়া, সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা, খিরাজ উত্তোলনে জুলুম না করা ছাড়াও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক ছিল। (তারিখুল ইসলাম, ড. হাসান ইবরাহিম হাসান: ৩৭৮)
তিন. উশর
ভূমিজ উৎপাদন—ফসল ও ফল-ফলাদির ওপর শরিয়ত নির্ধারিত এক-দশমাংশ হারে যে কর আদায় করা হয়, তাকে উশর বলা হয়। জাকাতের মতোই উশর উত্তোলন করে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। যেসব ভূমির অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিম সমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; যে ভূমি অমুসলিমদের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে বিজিত হয়ে মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে এবং যে ভূমি একইভাবে বিজিত হয়ে গনিমত হিসেবে বিজয়ী যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে—এসব ভূমিই উশরি ভূমি হিসেবে বিবেচিত হতো। এর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদিত হলে উশর বা এক-দশমাংশ এবং সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলে নিসফে উশর বা এক-পঞ্চমাংশ বাইতুল মালে প্রদান করা হতো। আর এমন জমি কখনো খিরাজি জমি ধরা যেত না। (মাওয়ারদি, আল আহকামুস সুলতানিয়া: ১৩১)
চার. জাকাত
আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে বাইতুল মালের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল জাকাত। ধনী মুসলিমদের থেকে জাকাত উত্তোলন করে খাত অনুযায়ী তা বিতরণ করা হতো। কোরআনে ‘সাদাকা’ শব্দের মাধ্যমেও জাকাতের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী নগদ অর্থ (স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা), সোনা, রূপা, বাণিজ্যিক পণ্য, চতুষ্পদ প্রাণী, ফসলাদিসহ বিভিন্ন প্রকারের সম্পদ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ জাকাত উত্তোলন করা হতো।
আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলের অন্যতম বিশেষত্ব হলো ধর্মত্যাগী ও জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান। জাকাতের উট বাঁধার সামান্য রশি প্রদানে যারা আপত্তি জানিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আবু বকর (রা.) জাকাত প্রদানে সামান্য অবহেলার ক্ষেত্রেও কোনো রকমের নম্রতা দেখাননি। কারণ একবার সুযোগ পেয়ে গেলে উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণির লোকেরা বারবার ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন অমান্য করতে শুরু করবে। এজন্য তিনি জাকাত অস্বীকারকারী মুরতাদদের বিরুদ্ধে খুব কঠোর ছিলেন। (ফি তারিখিল ইসলামি, ড. শাওকি আবু খলিল: ২১১)
পাঁচ. জিজিয়া
খিলাফত রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম ও আহলে কিতাবদের ওপর আরোপিত করই হলো জিজিয়া। আবু বকর (রা.)-এর যুগে এটি বাইতুল মালের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। খিলাফত রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও যুদ্ধের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের বিনিময়ে এ কর গ্রহণ করা হতো। এছাড়া মুসলিমদের ওপর জাকাত আরোপিত হওয়া ও অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া আরোপিত হওয়ার মাধ্যমে উভয় শ্রেণির মধ্যে সমতার নীতি কার্যকর করা হয়। পুরুষ হওয়া, স্বাধীন হওয়া, বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া ও প্রদানে সক্ষম হওয়া প্রভৃতি শর্ত বিদ্যমান থাকলে জিজিয়া আরোপিত হতো। রোগী, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর জিজিয়ার বিধান ছিল না। সাধারণত ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিবদের আর্থিক অবস্থাভেদে জিজিয়া আরোপিত হতো। অমুসলিমদের ইসলামে প্রবেশের মাধ্যমে জিজিয়ার পরিমাণ ক্রমেই কমতে থাকে। (তারিখুল ইসলাম, ড. হাসান ইবরাহিম হাসান: ৩৭৭)
ছয়. গনিমত
সেসব সম্পদ মুসলিমরা যুদ্ধের মাধ্যমে অমুসলিমদের থেকে অর্জন করে তাই গনিমত। গনিমতের সম্পদ থেকে এক-পঞ্চমাংশ বাইতুল মালে প্রদান করা হতো। যুদ্ধের গনিমত সাধারণত চার প্রকারের হতো—আসির (পুরুষ বন্দি), সাবি (নারী ও শিশু বন্দি), ভূমি ও অস্থাবর সম্পদ। আসির ও সাবিদের সাধারণত মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দেওয়া হতো বা গনিমতের মালের সঙ্গে যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হতো। আবু বকর (রা.)-এর যুগে বিজিত ভূমি মুসলিমদের মাঝে বণ্টনের মতো যুদ্ধলব্ধ অস্থাবর সম্পদও যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হতো। (আল আহকামুস সুলতানিয়া, মাওয়ারদি: ১২৫–১২৭; তারিখুল ইসলাম, ড. হাসান ইবরাহিম হাসান: ১/৩৮৬) মুসলিম সেনাবাহিনীর বিজয়াভিযানের ফলে বাইতুল মালে বিপুল পরিমাণে গনিমত আসতে থাকে। আবু বকর (রা.)-এর যুগে মুরতাদদের বিরুদ্ধে অভিযান থেকেও বিপুল পরিমাণে গনিমত অর্জিত হয়েছিল।
সাত. ফাই
ফাই বলতে বোঝায় সেসব সম্পদ যা অমুসলিমদের থেকে মুসলিমরা যুদ্ধ বা যেকোনো বাহ্যিক চাপ ছাড়া পেয়ে থাকে। ফাইয়ের সম্পূর্ণ সম্পদ বাইতুল মালে জমা করা হতো। (তারিখুল ইসলাম, ড. হাসান ইবরাহিম হাসান: ৩৮৪)
আট. খনিজ সম্পদ (মাদিন ও রিকাজ)
মাদিন ও রিকাজ হলো জমির নিচ থেকে উত্তোলিত খনিজ সম্পদ। যেসব সম্পদ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি সেগুলো হলো ‘মাদিন’। আর যেসব সম্পদ ও ধনভান্ডার মানুষ মাটির নিচে পুঁতে রেখে গেছে সেগুলো হলো ‘কানজ’। সাধারণত খনিজ সম্পদের সম্পূর্ণটাই বাইতুল মালে জমা হতো। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, যুদ্ধের ভূমিতে রিকাজ পাওয়া গেলে সেখান থেকে এক-পঞ্চমাংশ (খুমুস) বাইতুল মালে দেওয়া হবে। আর (যুদ্ধবিহীন) শান্তিপূর্ণ ভূমিতে রিকাজ পাওয়া গেলে তাতে জাকাত আসে এবং চার-দশমাংশ (রুবউল উশর) বাইতুল মালে প্রদান করা হতো। (তারিখুল ইসলাম: ৩৮৩)
নয়. অনুদান
আবু বকর (রা.)-এর যুগে বিভিন্ন অভিযানের জন্য বাহিনী প্রস্তুত করতে মুসলিমদের থেকে স্বেচ্ছাদান গ্রহণ করা হতো। এছাড়া সাহাবিরা খিলাফত রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেদের সম্পদ বাইতুল মালে দান করতেন। বিভিন্ন প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুদানের আহ্বান জানানো হলে মদিনা ও মদিনার আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমরা বাইতুল মালে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী দান করতেন।
দশ. মালিকানাহীন সম্পদ
যে মালের কোনো মালিক পাওয়া যেত না তা বাইতুল মালে জমা দেওয়া হতো। কেউ কোনো প্রকার ওয়ারিশ না রেখে মৃত্যুবরণ করলে তার রেখে যাওয়া সম্পদও বাইতুল মালে জমা হতো।
লেখক : মাস্টার্স, ইসলামের ইতিহাস, উচ্চতর গবেষণা অনুষদ, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর
abdurrahman0177436@gmail.com
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

