বিতর্কের অন্য নাম এশিয়া কাপ

স্পোর্টস রিপোর্টার
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩: ৫৩

হারিস রউফের অফ স্টাম্পের বলটা মিড অন দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠালেন রিঙ্কু সিং। আতশবাজির রোশনাই ছড়িয়ে পড়ল দুবাই স্টেডিয়ামের চারদিকে। একটু পরপরই ঝলকে উঠছে চোখধাঁধানো রঙিন আলো। যে আলোয় ভেসে যাচ্ছে এশিয়ার ক্রিকেটে নতুন রাজা ভারত। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ প্রস্তুত, ভারতীয় ক্রিকেটাররা দাঁড়ালেন একপাশে। কিন্তু হায়! পাকিস্তানের সারথিরা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর মিলল প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর। যে উত্তরের সঙ্গে আবছা আলোর মতো ভেসে এলো মহাদ্বৈরথের সুর। ক্রমশই সেটা রূপ নিল বিতর্ক আর নাটকীয়তায়। বিতর্ক দিয়ে শুরু হওয়া দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ের শেষটা বিতর্কহীন হবে, এ যেন অকল্পনীয়! টস কাণ্ড, নো হ্যান্ডশেক বিতর্ক, ম্যাচ বয়কট নাটক, অদ্ভুত উদযাপন আর বাকযুদ্ধের পর শেষের জন্য জিইয়ে থাকল ট্রফি কাণ্ড।

বিজ্ঞাপন


ফেরা যাক দৃশ্যপটে। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা উপস্থিত হওয়ার পর লম্বা অপেক্ষায় শুরু হওয়া পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে একে একে ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণ করেন তিলক ভার্মা, কুলদিপ যাদব ও অভিষেক শর্মা। রানার্সআপ হওয়া পাকিস্তান ক্রিকেট দলকেও দেওয়া হয় তাদের মেডেল ও ৭৫ হাজার ডলারের ডামি চেক। মঞ্চে উপস্থিত এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) সভাপতি মহসিন নাকভি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলসহ এশিয়ান ক্রিকেটের কর্তারা। তাদের সামনেই সঞ্চালক সাইমন ডুলের চমক জাগানো এক লাইনের বাক্য, ‘পুরস্কার নেবে না ভারতীয় দল’। তারা কারণ হিসেবে দেখিয়েছে এসিসি ও পিসিবি প্রধানের বাইরেও নাকভির আরেক পরিচয়, তিনি পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এমন ঘোষণার পর মঞ্চ ছেড়ে চলে যান নাকভি ও অন্য অতিথিরা। নাকভির সঙ্গে চলে যায় ট্রফিও! ট্রফি না পেয়ে অদৃশ্য ট্রফি নিয়ে নিজেদের মতো করে উদযাপন করেন ভারতের ক্রিকেটাররা।
ভারত অবশ্য ট্রফি চেয়েছে। বিসিসিআই দেবজিত সাইকিয়া বলেন, ‘ট্রফি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভদ্রলোক সেই ট্রফি আর মেডেলগুলো, যেগুলো আমাদের দেশকে দেওয়ার কথা, নিজের হোটেল রুমে নিয়ে চলে যাবেন। এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। আমরা আশা করি তার সুস্থ বুদ্ধি জাগ্রত হবে।’ সংবাদ সম্মেলনে সূর্যকুমারও জানালেন তিনি ট্রফিটা অন্যভাবে পেতে চেয়েছেন, ‘আমি ক্রিকেট খেলা বা ক্রিকেট দেখার শুরুর পর থেকে এবারই প্রথম দেখলাম যে, একটা চ্যাম্পিয়ন দলকে কোনো ট্রফি দেওয়া হলো না। সেটিও এমন এক চ্যাম্পিয়নশিপ, যা খুব কষ্ট করে জিতেছি। এমন না যে সহজে জিতে গেছি।’


ফাইনালে রানার্সআপের চেক পেয়ে হাতে নিয়ে মঞ্চের পাশেই ছুড়ে ফেলে দেন সালমান। এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও সালমান জানালেন কেন করেছেন এই কাজ। তিনি পুরো আসরে ভারতের ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ লঙ্ঘনের দিকটি টেনে হতাশা প্রকাশ করলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে ভারত যা করেছে, তা খুবই হতাশাজনক। তারা আমাদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে আমাদের অসম্মান করছে না, তারা ক্রিকেটকেই অসম্মান করছে। তারা খুবই অসম্মানজনক আচরণ করেছে।’


এদিকে ফাইনালের লড়াই ছড়িয়ে গেছে দুই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও। জয় উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক টুইটের জবাবে রিটুইটে মহসিন নাকভি লিখেছেন, ‘যদি যুদ্ধই তোমার গর্বের মাপকাঠি হয়, তবে ইতিহাস এরই মধ্যে পাকিস্তানের হাতে তোমার লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা লিখে রেখেছে। কোনো ক্রিকেট ম্যাচ সেই সত্যকে বদলাতে পারবে না। খেলায় যুদ্ধ টেনে আনা শুধু হতাশাকে প্রকাশ করে আর খেলার মূল চেতনাকেই কলঙ্কিত করে।’


ক্রিকেটের মূল চেতনাকে কলঙ্কিত করার কাজ অবশ্য আসরের শুরুতেই হয়েছিল। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে টসের পর ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব হাত মেলাননি পাকিস্তানের অধিনায়ক সালমান আলী আগার সঙ্গে। ম্যাচের শুরুর সেই বিতর্ক ম্যাচের শেষেও টেনে আনে ভারত। ম্যাচ শেষে সালমান আগাদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে শিবম দুবেকে নিয়ে সোজা ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটা দেন সূর্যকুমার। তখনো পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা মাঠে অপেক্ষা করছিল। প্রথম ম্যাচের এই বিতর্ক সুপার ফোরের ম্যাচে আরো উসকে দেন সাহিবজাদা ফারহান ও হারিস রউফ। ফারহান ফিফটি করে ব্যাটকে ‘একে-৪৭’ রাইফেলের মতো উঁচিয়ে উদযাপন করেন। এরপর ভারতীয় ইনিংসের সময় দর্শকদের দুয়োর জবাবে রউফ বিমান ভূপাতিত করার ইঙ্গিত করে বারুদ আরো উসকে দেন। বারুদের আঁচ স্পর্শ করে ফাইনালকেও।


দুবাইয়ে ভারত-পাকিস্তানের এই দ্বৈরথের রেশ যতই উজ্জ্বল হচ্ছিল, সময়ের সঙ্গে আলোর রোশনাই ততই ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। আলোর ধারা ছুটিয়ে প্রতিটি আসরের পর্দা ওঠে, একই ধারায় পর্দা নামে, মাঝে থেকে যায় শুধু কাশ্মীর সীমান্তের এপার-ওপারের তীব্র লড়াইয়ের ঝাঁজ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই লড়াই শেষে জিইয়ে থাকে চিরচেনা সেই বাক্য, ‘ক্রিকেট, মোর দ্যান অ্যা গেম…’।


তবে ক্রিকেট মাঠে ভারত-পাকিস্তান দু’দল এবার একে অন্যের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রথম লড়াই থেকে যে আচরণ করলো তাতে একটা বিষয় পরিস্কার- ‘দিস ইজ নট ক্রিকেট!’
- তাহলে কি?
ইটস ফুল অব পলিটিক্স!

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত