আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বোমা হামলা কমলেও কেন প্রাণ হারাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুরা?

আমার দেশ অনলাইন

বোমা হামলা কমলেও কেন প্রাণ হারাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুরা?
ছবি: সংগৃহীত।

বোমা হামলা হয়তো কমেছে, কিন্তু থামছে না ফিলিস্তিনি শিশুদের মৃত্যু। তবে এবার, ইসরাইলি বিমান হামলায় নয়, বরং ঠান্ডা় আর ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ভেঙে পড়ার কারণে। দুই বছরের গণহত্যার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য বিশেষত শিশুদের জন্য জরুরি পরিষেবার প্রয়োজন।


অথচ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে জরুরি পরিষেবার প্রবেশে বাধা দিয়ে ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেই চলছে। অন্যভাবে বলা যায়, নতুন করে চলছে যুদ্ধাপরাধ, যা এখন আগের দৃশ্যমান না হলেও ধীর গতিতে চলছে অভাব আর বঞ্চনার মধ্যে মৃত্যু হয়ে উঠেছে আরো যন্ত্রণাদায়ক।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে প্রবল বৃষ্টির ফলে গাজার তাঁবু শিবিরগুলি পানিতে ডুবে গেছে, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও প্লাবিত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো ভেতরে থাকা পরিবারগুলোর ওপর ধসে পড়েছে। অন্যদিকে রাফাহ ক্রসিংয়ে ইসরাইল তাদের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়ায় পর্যাপ্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেই। এই ঝড়ের ফলে শিশুসহ কমপক্ষে ১৬ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটিকে প্রতিরোধযোগ্য বিপর্যয় হিসাবে বর্ণনা করেছে। খারাপ আবহাওয়া এই শিশুদের হত্যা করেনি, বরং ইসরাইলের যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের কারণেই এই শিশুদের মৃত্যু হয়েছে।

দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনে ১,৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা অথবা আহত করেছে ইসরাইল। এছাড়াও পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কঠোরভাবে বাধা দিয়ে রেখেছে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের উপদেষ্টারা ইরাইলকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে চলার দাবি জানানো সত্ত্বেও এটি অব্যাহত রয়েছে।

ইউএনআরডব্লিইউএ -এর কাছেই প্রায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষের জন্য আশ্রয় সরবরাহ করার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু সে উপাদানগুলো প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল।

গাজার কমপক্ষে ৯২ শতাংশ স্থাপনা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া প্রায় আরো ৫৮ শতাংশ ভূখণ্ড গাজাবাসীর জন্য নিষিদ্ধ- যেখানে গাজাবাসীরা যেতে পারে না, এর ফলে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি এখন জীর্ণ তাঁবুতে বসবাস করছে অথবা কংক্রিটের স্ল্যাবের নিচে আশ্রয় নিচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলার জন্য ইসরাইল প্রথমে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল আর এখন তারা প্রকৃতিকে যুদ্ধের একটি নতুন অস্ত্রে পরিণত করেছে।

অ্যামনেস্টির তদন্তকারীরা জাবালিয়া, আল-রিমাল, শেখ রাদওয়ান এবং আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে ভবন ধসে পড়ার ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। যার ফলে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। ঝড়ের কবলে পড়ে মোহাম্মদ নাসারের দুই সন্তান লিনা এবং গাজি মারা গেছেন। তারা দুবার ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে পালিয়ে বেঁচে এসেছিলেন। দুই বছর ধরে চলা গণহত্যার পর, তারা তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে আসেন এই বিশ্বাসে যে, বৃষ্টিতে প্লাবিত তাঁবুর চেয়ে ঝুলে পড়া কংক্রিটের ছাদ নিরাপদ হবে।

পরবর্তীতে, এটি ঝড়ে ধসে পড়লে তারা নিচে চাপা পড়ে। তিনি শোক প্রকাশ করে বলেছেন যে, তার সন্তানরা বোমা হামলা থেকে বেঁচে ফিরলেও ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে।

এক মাস আগেও ইউএনআরডব্লিউএ কঠোর শীতের বিষয়ে সতর্কবার্তা জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, ‘গাজার জনগণের জন্য জরুরিভিত্তিতে আরো আশ্রয়ের সরবরাহ প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ইউএনআরডব্লিউএ গাজার বাইরে আশ্রয় সরবরাহ করে রেখেছে তা সেগুলো প্রবেশের জন্য সবুজ সংকেতের অপেক্ষা করছে।

তবে এই সতর্কবাণীগুলো ইসরাইলের বধির কান আর হৃদয়হীন অন্তরকে নাড়া দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

অক্ষুণ্ণ অবরোধ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতিতে এভাবেই চলছে গাজা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপসংহার ছিল দ্ব্যর্থহীন। এজন্য ইসরাইল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এমন জীবনযাত্রার পরিস্থিতি তৈরি করছে যেন গাজায় ফিলিস্তিনিরা নানা বিপর্যয়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়।

ইসরাইল অভিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে বোমা ও ধ্বংসযজ্ঞকে গাজাকে বসবাস অযোগ্য না করলেও যেন প্রাকৃতিকভাবে কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়।

এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে শিশুরা ঠান্ডায় মারা যাচ্ছে আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩ হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার কথা বলছেন।

মুখে অদ্ভুত হলেও, এই বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে। ট্রাম্পের জন্য এবং এমন একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এই ধরনের যুক্তি সত্য- যারা মনে করে শান্তি ততক্ষণ পর্যন্ত বিরাজমান যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো ইসরাইলি ইহুদি এর ভুক্তভোগী না হয়।

গাজায় ঠান্ডায় শিশুরা মরে যাওয়ার পরেও এই মিথ্যা শান্তির আখ্যানকে বিচলিত করে না। এমনকি ইসরাইল নির্দেশে সিরিয়ায় পাঠানো আমেরিকান সৈন্যদের হত্যাও ট্রাম্পের ভ্রান্ত শান্তিকে অস্থিতিশীল করে তোলে না। অস্থিরতার পরিমাপক কেবল ইসরাইলি ইহুদিদের জীবনকেই গণ্য করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত এক পক্ষের মৃত্যুকে অবজ্ঞা করা হবে এবং কেবল অপর পক্ষের 'স্বস্তি'কে শান্তি হিসেবে গণ্য করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত শান্তি আসবে না।

দখলকৃত পশ্চিম তীরেও একই ইহুদিবাদী বর্বরতা কাজ করছে। গাজা ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে, বুলডোজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলিতে ছিঁড়ে ফেলছে, এবং ইহুদি-জনতা পশ্চিম তীর জুড়ে ঘরবাড়ি এবং জলপাই বাগানে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

তুলকারেমের কাছে নূর শামস শিবিরে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী আরো ২৫টি ফিলিস্তিনি বাড়ি ভেঙে ফেলার নতুন নির্দেশ জারি করেছে। ফিলিস্তিনি নেতারা এবং ইউএনআডব্লিইউএ সতর্ক করে জানিয়েছে, প্রথমবারের ঐতিহাসিক বাস্তুচ্যুতির ৭৭ বছর পর আবারো শত শত ফিলিস্তিনিরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি হতে চলছে।

ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ধ্বংসের ঘটনাটি কেবল ইহুদিদের নতুন উপনিবেশ স্থাপনের অনুমোদনের সাথে মিলে যায়। এই শরণার্থীরা যাবে কোথায়? ১৯৪৮ সালে তাদের জমি চুরি হয়ে যায় আর অন্য কোথাও পুনর্বাসনের জন্য তাদের আর্থিক সামর্থ্য বা ক্ষমতাও নেই।

অন্যদিকে, এখন সামান্য যে জমি অবশিষ্ট রয়েছে তা দখল করে নিচ্ছে ইসরাইলের সরকার, একই সাথে অ-ইহুদিদের নির্মাণের অনুমতিও দিচ্ছে না।

গাজায় অবরোধের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুতি অথবা পশ্চিম তীরে চালানো ধ্বংস কিংবা জমি চুরি সবক্ষেত্রেই একই বিদ্বেষ জড়িত। প্রতিটি ক্ষেত্রে, তথাকথিত শান্তির অধীনে মূল্য দিতে হয় কেবল ফিলিস্তিনিদের।

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন স্পষ্ট। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরাইলকে খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা সেবা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। হিমায়িত শিশুদের কবরের ওপর নির্মিত শান্তি আবহাওয়ার নয়, বরং মানবতাবিরোধী অভিযোগ হিসেবে প্রমাণিত। এটি শান্তি নয়, বরং এটি একটি অন্যরকম গণহত্যা।

মিডল ইস্ট মনিটরের নিবন্ধ। অনুবাদ করেছেন মাহফুজুর রহমান।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন