আসামের বৃদ্ধা ঢাকার বস্তিতে, যেভাবে মিললো পরিচয়

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ২১

গত মে মাসের ২৫ তারিখে আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রাম থেকে পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সাকিনা বেগমকে। তারা বলেছিল যে, থানায় একটা সই করাতে হবে, তারপরে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

ওই একই সময়কালে আসামের কয়েকশো মানুষকে এভাবেই 'সই' করানোর নাম করে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদের অনেককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, কারও ঠাঁই হয়েছে 'বিদেশী'দের আটক-শিবিরগুলোয়।

বিজ্ঞাপন

তবে অনেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে পারলেও ৬৫ বছর বয়সী সাকিনা বেগমের আর কোনও খোঁজ পায় নি তার পরিবার।

যেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল সাকিনা বেগমকে

কয়েকদিন আগে জানা যায় যে মিরপুরের একটি ঘিঞ্জি অঞ্চলে এক বৃদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন, যার বাড়ি ভারতের আসামে।

গুগল ম্যাপে সার্চ করে দেখা গেল যে, ওই বৃদ্ধা যে এলাকার নাম বলছেন, সেই নলবাড়ি আসামের একটি জেলা, সেখানে তার দেওয়া নামের গ্রামও আছে।

তবে ভারতের দিক থেকে তার ঠিকানা আর পরিচয় যাচাই করতে হবে। শুরু হল খোঁজ।

এদিকে আসামের নলবাড়ি জেলায় একটি সূত্রের কাছে জানতে চায় যে, বরকুরা গ্রামে সাকিনা বেগম নামে কোনও নারী নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন কী না।

ঘটনাটি অনেকেরই জানা, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, সাকিনা বেগম নামে একজন বৃদ্ধাকে বরকুরা থেকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল মে মাসে। তার আর খোঁজ পায় নি পরিবার।

এরপরের ধাপে শুরু হল পরিচিতি যাচাই করা।

'এটাই তো আমার মা'

ঢাকার সূত্রের সাকিনা বেগমের পুত্র কন্যাদের নাম আর তারা কী কাজ করেন, সেই তালিকা।

ভারতে সূত্র জোগাড় করলেন এক ছেলে আর এক মেয়ের ফোন নম্বর। তারা আবার অসমীয়া ছাড়া কিছু বলতে পারেন না, কারণ তারা খিলঞ্জিয়া মুসলমান। অর্থাৎ আসামের ভূমিপুত্র এবং ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে যে বাংলাভাষী মুসলমানদের আসামে চাষ-আবাদের কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক জনগোষ্ঠী। এদের পূর্বপুরুষরা ১২শ শতক নাগাদ আসামে আসেন।

তার বড় মেয়ে রাসিয়া বেগম নামের যে নারীর ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছে প্রথমেই আমরা জানতে চাই, "সাকিনা বেগম কে হয় আপনার?"

তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, "উনি তো আমার মা, কী হয়েছে মায়ের?" এরপরে তিনি গ্রামেরই এক হিন্দি জানা নারীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন আমাদের।

তাদের কাছে পুরনো যে ছবি আছে তার মায়ের, সেটা দিতে বলি আমরা। অন্যদিকে ঢাকায় বিবিসি-র সংবাদদাতার হাতে ছিল সাকিনা বেগমের সর্বশেষ ছবি।

দুটি ছবি মিলিয়ে দেখেই আমরা নিশ্চিত হই বরকুরা গ্রাম থেকে মাস চারেক আগে পুলিশ যে সাকিনা বেগমকে নিয়ে গিয়েছিল, তিনিই ঢাকার মিরপুরে অবস্থানরত সাকিনা বেগম।

নিজেরা নিশ্চিত হয়ে তারপরে আসামে সাকিনা বেগমের বড় মেয়ের নম্বরে আমরা ঢাকা থেকে পাওয়া ছবিটা পাঠাই।

মুহূর্তে জবাব আসে – "এটাই তো আমার মা।"

ঠিক হল ঢাকার সংবাদদাতা তফসিরুল ইসলাম আর ভারতের সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী একই সময়ে দুই প্রান্ত থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেবেন সাকিনা বেগমের সঙ্গে তার পুত্র-কন্যাদের।

যদিও তার পরিবারকে জানাই নি যে কবে আমরা কথা বলিয়ে দেব।

দুই দেশের দুই বাড়িতে কান্নার রোল

সাকিনা বেগমের বড় মেয়ে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলেন তার মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম আমরা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার মিরপুরে পৌঁছান তাফসীর বাবু, আর আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রামে পৌঁছান অমিতাভ ভট্টশালী।

নলবাড়িতে তখন হাজির সাকিনা বেগমের তিন মেয়ে ও ছোট ছেলে। বড় ছেলে ব্যাটারি রিকশা চালান, একদিন কাজে না গেলে খাবার জুটবে না, তাই তিনি নিখোঁজ মাকে দেখতেও আসতে পারেন নি।

অধীর আগ্রহে দুই দেশে অপেক্ষা করছিল পুরো পরিবার।

তাফসীর বাবু যখন ভিডিও কলটা করে সাকিনা বেগমকে দেখালেন, "দ্যাখেন তো এরা কি আপনার ছেলে মেয়ে হয়?"

ঢাকার ঘুপচি ঘরে বসে ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই তিনি বলে ওঠেন, "এই তো আমার মেয়ে.."

অন্যদিকে ভারতের আসামে গ্রামের বাড়িতে মাকে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন তার ছেলে মেয়েরা.. "ওহ.. মা গো..."

দুই পাড়েই তাদের আশেপাশে জড়ো হয়েছিলেন কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধু, আর সাকিনা বেগমের পাশে ছিলেন ঢাকায় তার আশ্রয়দাতা পরিবারটি।

সকলের চোখেই তখন জল।

কান্নার রোল, ভারতে ফেরার আকুলতা, ছেলে-মেয়ে আর নাতিদের খোঁজ খবর কোন কিছুই বাদ থাকলো না।

কুড়ি মিনিটেরও বেশি কথা হল দুই পাড়ে – মায়ের সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের। ছেলে মেয়েরা বার বার মাকে আশ্বাস দিতে লাগলেন যে তিনি যেন দুশ্চিন্তা না করেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনবেনই।

ভারতের পরিবারটি কৃতজ্ঞতা জানাল ঢাকার পরিবারকে, তাদের মাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।

মিরপুরের এক পরিবার আশ্রয় দেয়

কয়েক মাস আগে এলাকার এক দোকানের সামনে বসে এক বৃদ্ধাকে কাঁদতে দেখেন বাংলাদেশের মিরপুরের একটি ঘিঞ্জি অঞ্চলের বাসিন্দারা।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে যে কী বলছিলেন, সেটা কিছুই বুঝতে পারেন নি সেখানকার মানুষ, কারণ তার মুখের ভাষা ভিন্ন।

তিনি শুধু বারবার বলছিলেন যে তার বাড়ি নলবাড়িতে।

সেরকম কোনও জায়গা তো বাংলাদেশে নেই.. তাহলে কে এই বৃদ্ধা, কীই বা তার পরিচয়?

বৃদ্ধাকে কান্নাকাটি করতে দেখে তাকে আশ্রয় দেয় এলাকারই এক পরিবার।

ধীরে ধীরে মিরপুরের ওই পরিবারটি বুঝতে পারে যে বৃদ্ধার বাড়ি সম্ভবত ভারতে। তিনি কীভাবে বাংলাদেশে এলেন, তা শুনে ইঙ্গিত পাওয়া গেল যে তাকে সম্ভবত 'পুশ-ইন' করা হয়েছিল।

সাকিনা বেগম বলছিলেন, "থানার পুলিশ আমার গ্রামে গিয়েছিল। বলল আপনার একটা সই নেব, আর আপনাকে নিয়ে আসব। আমার সঙ্গে আমার ছেলেও ছিল। পুলিশ কিন্তু আমাকে থানায় নিয়ে যায়নি।

"ওরা হিন্দিতে কথা বলছিল। চারদিকে তারকাঁটার বেড়া। সেখানে একটা বড় লোহার দরজা ছিল। তাঁদের লোক এসে তালা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল, তোমারা এখান দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাও, হল্লা করো না…, এতটুকুও শব্দ করবেন না," ওই বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলছিলেন সাকিনা বেগম।

তখনও তিনি বুঝতে পারেন নি যে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই রাতেই রাস্তায় বাসের দেখা পেয়ে তিনি তাতে উঠে পড়েন।

গত কয়েকমাসে আশ্রয়দাতা পরিবারটিকে তিনি যা জানিয়েছেন তার মাতৃভাষা অসমীয়াতে, তা থেকে ওই পরিবারটির সদস্যরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছেন যে সীমান্ত থেকে কীভাবে ঢাকায় এসে পৌঁছিয়েছিলেন সাকিনা বেগম।

ওই পরিবারটির সদস্য ক্লান্তি আখতার জানান, "উনি বাসে ওঠার পরে বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে উনাকে। উনি বলেছেন যে আমি নলবাড়ি যাব।"

বাসের লোকেরা তো আর নলবাড়ি চেনেন না, তাই বারে বারে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে তাকে। আবারও আরেকটা বাসে উঠেছেন তিনি।

"এইভাবে নানা বাসে আসতে আসতে একদিন আমাদের ওইদিক দিয়ে ঢুকে ওখানে একটা দোকান আছে, ওখানে বসে কান্না করছেন," বলছিলেন মিজ আখতার।

'মাকে খুঁজতে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই'

একদিকে যেমন সাকিনা বেগম বারবার বলেছেন যে, তার বাড়ি নলবাড়িতে, অন্যদিকে ভারতে তার ছেলে মেয়েরা অনেক খুঁজে বেরিয়েছে তাদের মাকে।

দুই দেশের ভিডিও কলে কথা বলানোর আগে আমরা সাকিনা বেগমের বড় মেয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঠিক কীভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তাদের মা।

রাসিয়া বেগম জানান, " সই করানোর জন্য এসপি অফিসে আমার মাকে নিয়ে যায় ২৫ তারিখ (মে মাসের)। আমার ছোট ভাই আর মেজো বোন এসপি অফিসে গিয়েছিল। এসপি অফিস থেকে বলা হয় যে গোয়ালপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়েছে মাকে। এর তিন-চারদিন পরে আমি গোয়ালপাড়া গিয়েছিলাম। গোয়ালপাড়া ক্যাম্পে আমাদের কিছুই বলল না ওরা, বলল যে কোনও অর্ডার হয় নি, ১৫ দিন পরে এসো।

"দিন ১৫ পরে যখন আমরা যাই, সেখানে আমার মা ছিল না, গোয়ালপাড়ায় নেই। মোট তিনবার গেছি গোয়ালপাড়াতে," বলছিলেন রাসিয়া বেগম।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, "আমার মা আছে নাকি আমার মা মারা গেছে না কী হয়েছে, এটাই তো জানতে পারছি না আমরা। মানুষটার কোনও সন্ধান নেই। মা কোথায় আছে, যে আমি খুঁজতে যাব, সেই ক্ষমতা আমার নেই।"

'পুশ-আউটের' শিকার?

তার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং নথিপত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, সাকিনা বেগমকে আসামের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল আগেই বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে এবং সেই একই রায় বজায় রেখেছে গৌহাটি হাই কোর্টও।

এরপর সাকিনা বেগমকে বিদেশিদের জন্য আটক শিবিরে বন্দী করেও রাখা হয়েছিল। করোনার সময়ে জামিনে মুক্তি পান তিনি। তারপর থেকে নিয়মিত স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে যেতে হত তাকে।

এই তথ্য জানার পরেই সন্দেহ হয় যে তাকে হয়ত আরও অনেকের মতোই বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় আসাম সরকারেরই দেওয়া একটি তথ্যে।

আসামের বোড়োল্যাণ্ড স্বশাসিত এলাকার সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন এবিএমএসইউ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিল গৌহাটি হাইকোর্টে, যেখানে তারা ২১ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেছিল যে তাদের পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর থেকে পরিবার কোনও খোঁজ পায় নি।

ওই মামলা যিনি দায়ের করেছিলেন, এবিএমএসইউ-র প্রেসিডেন্ট টাইসন হুসেইন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "এবিএমএসইউ একটা হেল্পলাইন নম্বর জারি করেছিল যে পুরো আসামে যদি এমন কেউ থাকেন যে আসাম পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে তার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তার পরিবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

"তখনই ২১ জনের তথ্য আমরা পাই, যাদের পুলিশ আটক করে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে তারা নিখোঁজ। ওই তালিকাতেই নলবাড়ি জেলার সাকিনা বেগম নামে এক নারীর নামও ছিল। ওই ২১ জনের তথ্য আমরা গৌহাটি হাইকোর্টে হলফনামা হিসাবে জমা দিয়েছিলাম।"

হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর এর জবাব দেয়।

" যে ২১ জনের নাম আমরা জমা দিয়েছিলাম তার মধ্যে ১৪জন কোকরাঝাড় আটক শিবির ও গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন, বাকি সাতজনকে আসাম সরকার বিএসএফকে হস্তান্তর করে দিয়েছে, এমনটাই বলে আসামের স্বরাষ্ট্র দফতর। তখনই বোঝা যায় যে সাকিনা বেগমকে পুশ-ব্যাক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি যে কোথায় আছেন, এটা আমরা জানতে পারি নি," বলছিলেন মি. হুসেইন।

মে মাস থেকে বিশেষ অভিযান

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে ২২শে এপ্রিলের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ভারতের নানা রাজ্যে শুরু হয়েছিল 'অবৈধ বাংলাদেশি' চিহ্নিতকরণের বিশেষ অভিযান।

প্রথম অভিযানটা হয়েছিল গুজরাতে।

গুজরাত পুলিশের সূত্রগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে যে, ওই বিশেষ অভিযানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক ভারতীয় বাংলাভাষীও।

শেষমেশ অবশ্য মাত্র ৪৫০ জনকে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করতে পেরেছে সেখানকার পুলিশ।

বিভিন্ন রাজ্য থেকে কয়েক হাজার এমন মানুষকেও চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা সত্যিই বাংলাদেশের নাগরিক এবং অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছিলেন। নিয়মিতই তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

আবার আসামে নিয়মিতই 'অবৈধ বাংলাদেশি' ধরার অভিযান চলতে থাকে, তাদের বাংলাদেশে পুশ-ব্যাকও করা হয়।

কিন্তু মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে যে বিশেষ অভিযান শুরু হয়, সেখানে বেছে বেছে সেই সব ব্যক্তিদের আটক করা হয়, যাদের সেরাজ্যের 'বিদেশি ট্রাইব্যুনাল'গুলো 'ঘোষিত বিদেশি নাগরিক' বলে রায় দিয়েছিল।

এদের অনেকে সেই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করলেও তাদের সাকিনা বেগমের মতোই থানায় 'সই' করতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আটক করা হয়।

ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলি অভিযোগ করছে, বহু ভারতীয় নাগরিককে বিদেশি বলে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে নথি পত্রে সামান্য ভুলের জন্য।

ভারতে তারা বিদেশি বলে চিহ্নিত হলেও কোন দেশের নাগরিক সেটা আবার নির্দিষ্ট করা হয়নি। অভিযোগ, তাদের অনেককেই প্রচলিত নিয়ম ভেঙে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে।

আসামের ওই বিশেষ অভিযানে কতজন আটক হয়েছেন, সেই সংখ্যা সরকার বা আসাম পুলিশ জানায়নি, তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে তাদের হিসাব মতো বিশেষ অভিযানের প্রথম দিন দশেকের মধ্যে তিনশোরও বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছিল, যাদের আগে বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলো বিদেশি বলে ঘোষনা করে দিয়েছে।

সত্যিকারের বাংলাদেশি মানুষ, যারা অবৈধভাবে ভারতে থাকছিলেন, তাদের সংখ্যা কিন্তু এই প্রায় তিনশো জনের বাইরে।

মানবাধিকার সংগঠন সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের আসাম রাজ্যের ইনচার্জ পারিজাত নন্দ ঘোষ জুন মাসের গোড়ায় বিবিসিকে বলেছিলেন যে, আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪৫ জন যে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন, সেই অভিযোগ তারা জমা দিয়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে।

আবার পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাসিন্দাকেও বিভিন্ন রাজ্যে 'বাংলাদেশি' সন্দেহে আটক করে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের মুখ্য উপদেষ্টা অর্ণব পাল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তাদের কাছে যে হিসাব রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এমন অন্তত ১৫ জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

বিএসএফের হাতে, তারপর...?

সাকিনা বেগম এবং আরও ছয়জনের ব্যাপারে আসাম সরকার আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে তাদের বিএসএফের যে সেক্টর হেডকোয়ার্টার আছে ধুবরী জেলায়, তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে।

বাকিদের বিভিন্ন আটক-শিবিরে রাখা হয়েছে।

সাকিনা বেগম সহ যাদের বিএসএফের কাছে ২৬শে মে হস্তান্তর করা হল, তারা কোথায় গেলেন?

সাকিনা বেগম একজনের নাম বলতে পেরেছিলেন, যাকে তার সঙ্গেই সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সেই নারীর নাম চন্দ্রা বানু, তার বাড়িও নলবাড়ি জেলাতেই। এই নামটি শুনে আমরা খোঁজ করে জানতে পারি যে এবিএমএসইউ যে ২১ জন নিখোঁজের তালিকা তৈরি করেছিল, তার মধ্যে এই নামটিও আছে। তবে তার স্বামীর যে ফোন নম্বর ছিল, তাতে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারি নি আমরা।

তবে প্রশ্ন উঠছে, বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করার পরে এরা সীমান্ত পার হলেন কী করে? ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে ইমেইল করে আমরা জানতে চেয়েছিলাম বিষয়টা।

তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার কোনও জবাব আসে নি।

এদিকে বাংলাদেশে বিবিসির পক্ষ থেকে সাকিনা বেগমের ঘটনা জানিয়ে স্থানীয় ভাষানটেক থানায় যোগাযোগ করা হয়েছে।

তারা বলেছেন, ঘটনার তদন্ত এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাকিনা বেগম আশায় আছেন এই শেষ বয়সে পরিবারের কাছে ফিরে যাবার।

আর তার ছেলে মেয়েরা বলছিলেন,"আমার মাকে ছাড়িয়ে এনে দিন… আপনাদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি মাকে আমাদের কাছে এনে দিন। মা ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের। দিনরাত মার কথা চিন্তা করে করে আমাদের ভাত-জলও খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।"

সূত্র: বিবিসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত