বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে ভবিষ্যতের কোনো আশা না দেখে দালালচক্রের প্রলোভনে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। এতে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ, আর দিশেহারা হয়ে পড়ছেন তাদের পরিবার। বাংলাদেশে কাজ, শিক্ষা—কোনটিতেই প্রবেশাধিকার না থাকায় হাজারো রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবন বাজি রেখে এ পথে পা বাড়িয়ে পাচারের শিকার হচ্ছেন। মানবপাচারকারীদের প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন।
৫৮ বছর বয়সী মাজুমা বেগম। তাঁর ছেলে আবু মুসা রাত ৩টা পর্যন্ত বাজার থেকে ফেরেনি। পরদিন ফোনে জানায়—সে টেকনাফ উপকূলে, মালয়েশিয়াগামী নৌকায় যাত্রার অপেক্ষায়। মাকে কিছুই জানায়নি, কারণ মা তাকে আটকানোর চেষ্টা করবেন। নভেম্বরের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার কাছে একটি নৌকা ডুবে বহু রোহিঙ্গার মৃত্যু হলে মুসার মা আরো ভয়ে দিন কাটান। অবশেষে ছেলে গন্তব্যে পৌঁছানোর খবর পেয়ে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।
১৬ বছরের মুসা তাদের মধ্যে একজন, যারা সাম্প্রতিক দুই মাসে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার থেকে নৌকায় করে পালানোর ঝুঁকি নিয়েছে। রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে কাজ করা আরাকান প্রজেক্টের তথ্যমতে, হতাশা, খাদ্য রেশন কমে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা সংকট এবং মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা—সব মিলিয়ে রোহিঙ্গারা জীবন বাজি রেখে দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করে, যাদের তিন-চতুর্থাংশ ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘গণহত্যা’ থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে। শিবিরগুলোতে কাজ বা চলাচলে কড়া নিষেধাজ্ঞা, শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং ভিড় ঠাসা জীবন—সব মিলিয়ে হতাশা চরমে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘর্ষে নতুন করে আরও দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ২০২৪ সালে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে জোরপূর্বক রোহিঙ্গা নিয়োগ ও বেসামরিক হত্যা-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
আরাকান প্রজেক্ট জানায়, সেপ্টেম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পথে কমপক্ষে ২২টি নৌকা যাত্রা করেছে, মোট প্রায় ৪,০০০ মানুষকে বহন করে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) বলছে, এ বছরই ৬০০ রোহিঙ্গা সমুদ্রে নিখোঁজ বা মৃত।
মুসার মতো অনেক তরুণ কাজ বা পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় ভবিষ্যৎহীন জীবন ভেবে পালানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দালালচক্র তাদের মালয়েশিয়ায় ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখালেও অনেককে মাঝপথে অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করা হয়। আরাকান প্রজেক্টের সমন্বয়কারী ক্রিস লেওয়া জানান, রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের গোপন গুদামঘর, জঙ্গল বা উপকূলে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। “দেরি হলে তাদের মারধর করা হয়—কখনও ক্যামেরার সামনে, যাতে পরিবার দেখে ভয় পায়,” বলেন তিনি।
১৩ বছর বয়সী ফুরকাহান অক্টোবরের শেষে নিখোঁজ হলে তার পরিবার দুই দিন ধরে খুঁজেও পায়নি। এরপর দালাল ফোন করে জানায়, তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হচ্ছে—এর জন্য ৩৫০,০০০ টাকা দাবি করা হয়। ২৯ অক্টোবর যাত্রা করা নৌকার পর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। তারা আশঙ্কা করছেন—৯ নভেম্বর মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্তে যেই নৌকা ডুবেছিল, ফুরকাহান সেই নৌকাতেই ছিল।
এ ঘটনায় ৩৬টি লাশ উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ; ২৬ জনকে জীবিত পাওয়া গেছে, আরও ৮ জন নিখোঁজ। মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কমিশন সমুদ্র দুর্যোগ থেকে বেঁচে যাওয়া ১১ জনকে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে অভিযুক্ত করাকে “অমানবিক” বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে।
২৪ বছর বয়সী রবিনা বিবি ও তার পাঁচ বছরের ছেলেও ওই নৌকাডুবিতে মারা যান। তার স্বামী আগেই মালয়েশিয়া পৌঁছেছিলেন এবং তাকে জোর করে আসতে রাজি করান। পরিবারের সঙ্গে শেষ কথা বলেছিলেন ২৬ অক্টোবর। পরে দালালরা নানা আশ্বাস দিলেও শেষে জানায়—তিনি নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। এরপর তাদের ফোনও রিসিভ করা বন্ধ করে দেয়।
রবিনার বাবা আবুল বাসার বলেন, “আমার মেয়ে মারা গেছে মানে আমার পৃথিবীটাই শেষ হয়ে গেছে। সে পানিকে খুব ভয় পেত, তার যেতে হতো না—কিন্তু জোর করে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ না থাকায় তারা সমুদ্রে মরতে বাধ্য হচ্ছে। “বিশ্ব যদি এখনই কিছু না করে, পুরো রোহিঙ্গা প্রজন্ম সমুদ্র আর জঙ্গলে হারিয়ে যাবে,”—তার করুণ মন্তব্য।
এসআর

