কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা, আরব শাসকদের বার্তা দিলো ইরান

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ১৬: ২৪
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ১৭: ৪০
ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

আপাত শান্ত কাতারের রাজধানী দোহা; সাধারণত জননিরাপত্তা এবং সাজানো শপিংমলের জন্য সুপরিচিত এই শহর। তাই সোমবার যখন ইরান মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, তখন সেখানকার বাসিন্দারা যে দৃশ্য দেখেছে, তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।

কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো আকাশ। ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে সংঘর্ষে বিস্ফোরিত ইন্টারসেপ্টরগুলো পার্ল আইল্যান্ড থেকেও দেখা যাচ্ছিল। ভিলাজিও মলে থাকা ক্রেতারা বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে চিৎকার করে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটাছৃটি শুরু করে।

বিজ্ঞাপন

হংকং থেকে আসা পর্যটক ২২ বছর বয়সী লিনাস ওয়াইম হামলার সময় শপিংমলে ছিলেন। লিনাস বলেন, তিনি ভেবেছিলেন সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, যতক্ষণ না তিনি বাইরে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

ইরানের পক্ষ থেকে এই হামলার বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিলো এবং কেউ এতে নিহত হয়নি। তারপরও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমা হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তেহরান যে আক্রমণ শুরু করেছিল তা উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য ছিল এক দুঃস্বপ্ন। যার মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত এবং ওমান।

Gulf

ইরানের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুগ্রহ লাভ এবং অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে তার শহরগুলোকে ব্যবসা-বান্ধব স্বর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে বছরের পর বছর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, দেশটি এমন একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে যা তারা এড়াতে চেয়েছিলো।

ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের মধ্যপ্রাচ্য ভূ-অর্থনীতির প্রধান দিনা এসফান্দিয়ারি বলেন, ‘এটি উপসাগরীয় অঞ্চলকে সত্যিই অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছে।’ ‘তাদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কা সত্য হয়ে উঠেছে, তারা (উপসাগরীয় দেশগুলো) ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার মাঝখানে আটকা পড়েছে।’

মঙ্গলবার দোহায় উপসাগরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই হামলার বিষয়ে আলোচনা করতে একটি জরুরি বৈঠকে বসেন। ছয়টি দেশ তাদের নিরাপত্তার নিশ্চত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে এবং সেখানে হাজার হাজার মার্কিন সামরিক কর্মী এবং বেশ কয়েকটি বড় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে।

১৯৯০ সালে ইরাকের সাবেক নেতা সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করার পর থেকে তাদের ভূমিতে কোনও যুদ্ধ হয়নি এবং তাদের দেশ আন্তর্জাতিক পর্যটক এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে উপসাগরীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন থেকেই ইরানকে নিরাপত্তা হুমকি মনে করে। এজন্য প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে।

তেহরানের সঙ্গে কাতার ও ওমানের বিশেষভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। হামলার পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান কাতারের আমিরের সাথে কথা বলেছেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল-থানি একথা জানান।

সৌদি আরব এবং বাহরাইনের ইরানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে এবং ২০১৬ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো অবস্থাও তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিলো। আমিরাত সরকারের অবস্থান বিশেষভাবে জটিল, কারণ তারা ইরানের নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে সতর্ক। তবে তারা অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।

এই বৈরি সম্পর্ক কখনো কখনো সংঘর্ষের দিকে্ও পরিচালিত হয়। যেমন ইয়েমেন, যেখানে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১০-এর দশকে ইরান-সমর্থিত হুথিদের বিরুদ্ধে বোমা হামলা চালিয়েছিল।

উপসাগরীয় দেশগুলো আশঙ্কা করছে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারে। যদিও তারা সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিকভাবে সঙ্কট মোকাবেলার আহ্বান জানিয়েছে। এই বিভাজনের একটি সাম্প্রদায়িক দিকও রয়েছে। সুন্নি মুসলিম উপসাগরীয় রাজপরিবারের মধ্যে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানকে নিয়ে একটা আশঙ্কা কাজ করে। নিজেদের দেশে শিয়া নাগরিকদের কাছে ইরান তার বিপ্লবী আদর্শ প্রচার করার মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে কিনা তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

gulf 6

আমিরাতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্দুল খালেক আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে ইরানের পাশে বাস করছি, আমরা জানি ইরান কতটা কঠিন।’

এসফান্দিয়ারি মনে করেন, তাদের আশঙ্কা উপসাগরীয় দেশগুলো উত্তেজনার ক্ষেত্রে পরিণত হবে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্যে, কাতারে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া বাকি সবগুলোই প্রতিহত করা হয়েছিল। কয়েক ঘন্টা পরে, আমিরাত ঘোষণা করে যে তারা ইরান ও ইসরেইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সাহায্য করেছে।

তবে এই হামলা উপসাগরীয় দেশগুলোর দুর্বলতাকে তুলে ধরে।বাহরাইন জুড়ে সতর্কতামূলক সাইরেন বেজে ওঠে এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমান চলাচল কেন্দ্র দুবাইয়ের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক বদর আল-সাইফ বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে আমরা বলে আসছি যে এটি এমন একটি সম্ভাবনা যা আমরা এড়াতে চেষ্টা করেছি।’

কাতারের আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে হামলার ঘটনা ২০১৯ সালে সৌদি আরবের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে ইরান-সমর্থিত ড্রোন হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই হামলার পর ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ করতে বাধ্য করে হয় উপসাগরীয় দেশগুলো। ২০২৩ সালে দেশগুলো সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে।

আমিরাত এবং বাহরাইনও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে এবং কাতারে হামলার ফলে সেই সম্পর্ক ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা কম।

আমিরাতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্দুল খালেক আবদুল্লাহ বলেন, ‘ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করা নীতি, কৌশল এবং ভবিষ্যতের জন্য জরুরি।’

খালেক আবদুল্লাহ বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগে, সৌদি ও আমিরাতের কর্মকর্তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নির্ভরতা কমানোর কথা বিবেচনা করার সময় একটি বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা এবং আরও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এখন এটা স্পষ্ট যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতটা সম্ভব শক্তিশালী উপায়ে এই অঞ্চলে ফিরে এসেছে।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা একমেরু বিশ্বে আটকে আছি, প্রতিযোগী উদীয়মান শক্তিগুলো থাকলেও মূলত ওয়াশিংটনই এখানে সিদ্ধান্ত নেয়।’

নিউ ইয়র্ক টাইমসে ভিভিয়ান নেরেইম এর বিশেষ প্রতিবেদন

অনুবাদ: রুবিনা আক্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত