ভারতের ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা
আমার দেশ অনলাইন
বিহারের পূর্ণিয়ায় ‘ডাইনি’ অভিযোগে একই পরিবারের পাঁচজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। নিহতদের মধ্যে তিনজন নারী এবং দু’জন পুরুষ।
ঘটনাটি ঘটেছে রোববার, পূর্ণিয়ার রাজ রানিগঞ্জ পঞ্চায়েতের টেটগামা গ্রামে। বিবিসির টিম মঙ্গলবার যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তখন জনশূন্য ছিল গ্রামটি।
টেটগামায় ঢুকতেই পাকা-কাঁচা রাস্তার ডান পাশে একটা ফাঁকা জায়গাকে নিজেদের ক্যামেরায় বন্দি করছিলেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং ইউটিউবাররা।
সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল একটা লাল শাড়ির পোড়া অংশ এবং মানুষের চুল- যা ছয়ই জুলাই তথা রোববার রাতে ঘটে যাওয়া অমানবিক কাজের সাক্ষ্য দেয়।
প্রায় ৬০টি ঘরযুক্ত এই এলাকায় এই মুহূর্তে রয়ে গিয়েছেন একমাত্র নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা। বাকি বাসিন্দাদের সকলেই এখন পলাতক।
এর কারণ ওই এলাকার সমস্ত বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে পাঁচজনকে মারধর করার পর পুড়িয়ে মারার অভিযোগে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
তবে এই ঘটনার তিন দিন পরেও গ্রেপ্তারের সংখ্যা তিনজন। যদিও নাম জানা গিয়েছে এমন ২৩ জন এবং ১৫০-২০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এই ঘটনার পর একদিকে যেমন কুসংস্কার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তেমনই প্রশ্ন উঠেছে পূর্ণিয়া জেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক জনপদে কীভাবে রাতভর পাঁচজনকে মারধর এবং পুড়িয়ে মারার ঘটনা চলল, অথচ পুলিশ কোনো খবর পেল না।
এই প্রসঙ্গে পূর্ণিয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অংশুল কুমার এবং পুলিশ সুপার সুইটি সেহরাওয়াতের মধ্যে কেউই বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
কী ঘটেছিল?
‘ডাইনিবিদ্যা’ চর্চার অভিযোগ তুলে পূর্ণিয়ার ওই গ্রামের বাবুলাল ওঁরাও (৬৫), সীতা দেবী (৬০), মনজিৎ ওঁরাও (২৫), কাতো দেবী (৭৫) এবং রেখা দেবীকে (২২) জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
নিহতদের মধ্যে বাবুলাল ওঁরাও এবং সীতা দেবী স্বামী-স্ত্রী ছিলেন এবং কাতো দেবী বাবুলাল ওঁরাওর মা। মনজিৎ ছিলেন বাবুলাল ওঁরাওর ছেলে এবং রেখা দেবী তার (মনজিৎ) স্ত্রী। এরা একই বাড়িতে একসঙ্গে থাকতেন।
কাতো দেবীর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বহু বছর আগে। তার পাঁচ ছেলে - জগদীশ, বাবুলাল, খুবলাল, অর্জুন এবং জিতেন্দ্র। বাবুলাল ওঁরাও'র বাকি ভাই এবং তাদের পরিবার ওই পাড়ায় আলাদা বাড়িতে থাকেন।
বাবুলাল-সীতা দেবীর চার ছেলে। মনজিৎ, তার স্ত্রী ও এবং এক নাবালক পুত্রকে নিয়ে থাকতেন তারা। বাবুলাল ওঁরাও'র বাকি দুই ছেলে পেশায় শ্রমিক। ওই দম্পতির সাথে থাকা ছোট ছেলে শুধুমাত্র জীবিত আছে। ঘটনার সূত্রপাত, ওই এলাকার এক শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বলে জানা গিয়েছে।
দিন কয়েক আগে, ওই পাড়ার রামদেও নামে এক ব্যক্তির সন্তানের মৃত্যু হয়। ওই শিশুর মৃত্যুর পর রামদেওর ভাগ্নেরও স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য বাবুলাল ওঁরাওর পরিবারের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল।
বাবুলাল ওঁরাওর পরিবার, বিশেষত তার মা কাতো ও স্ত্রী সীতা দেবী 'জাদু টোনা' করতেন বলে সন্দেহ করত ওই পাড়ার বাসিন্দারা।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনার আগে, রোববার সন্ধ্যায় বাবুলাল ওঁরাও'র বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাঁশ গাছের ঝাড়ের কাছে ওই পাড়া এবং সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ওঁরাও জনজাতির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটা সভা বসে।
ঠিক তারপরই কয়েকশো মানুষ তার (বাবুলাল ওঁরাওর) বাড়িতে লাঠি-সোটা এবং অস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়।
বাবুলাল ওঁরাও'র ভাই অর্জুন ওঁরাও বিবিসিকে বলেন, ‘রোববার কাজ শেষ করে পূর্ণিয়া থেকে সাইকেলে করে ফেরার পথে দেখি শত শত নারী-পুরুষ বাবুলালের বাড়ির কাছে জড়ো হয়েছে। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ও লাঠি ছিল। ওরা সবাই বারবার ডাইনি ডাইনি বলছিল আর মারছিল।’
‘আমরা বাধা দিলে ওরা আমাদের সরে যেতে বলে। হুমকি দেয় না হলে আমাদেরও মেরে ফেলবে। তারা আমাকে আর আমার আরেক ভাইয়ের পরিবারকে অস্ত্র দেখিয়ে বন্দি করে।’
‘ওরা আমার মা ও ভাইকে মারধর করে। তারপরে তাদের বাড়ি থেকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গিয়ে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিবারের বাকিদের সঙ্গেও একই আচরণ করে তারা।’
পুলিশে খবর দেয় এক নাবালক
এই ঘটনার পর নিহতের পরিবারের মধ্যে এতটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যে, কেউই পুলিশকে খবর দেননি।
এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে কাতো দেবীর ছেলে খুবলাল ওঁরাও বলেন, ‘আমরা আমাদেরই চোখের সামনে মা ও ভাইয়ের পরিবারকে মারধর করতে দেখেছি। ওরা আমাদের পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছিল আর হুমকি দিয়েছিল যে পুলিশ ডাকতে গেলে আমাদেরও মেরে ফেলবে। কীই-বা করতে পারতাম আমরা?’
পুলিশ এই ঘটনার বিষয়ে জানতে পারে যখন নিহতদের পরিবারেরই এক নাবালক কিশোর থানায় খবর দেয়। বছর ১৭-র ওই কিশোর, বাবুলাল ওঁরাও'র ছোট ছেলে। হামলার সময় কোনো মতে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিল সে।
কাতোর পুত্রবধূ রিঙ্কি দেবী বিবিসিকে বলছেন, ‘যখন সবাই ওকে (বাবুলাল ওঁরাও'র নাবালক ছেলেকে) মারধর শুরু করে, তখন কিছু লোক এসে বলেছিল ও বাচ্চা, ওকে ছেড়ে দাও। ও দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে আসার পর ওকে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম আমরা।’
‘পরে দিদার বাড়িতে চলে যায় ও। সেখান থেকে থানায় গিয়ে ঘটনার কথা জানায়। ওর কথা শুনেই পুলিশ এসেছিল।’
ওই কিশোর তার বাবা-মাসহ পরিবারের বাকি সদস্যদের খোঁজ না পাওয়ার বিষয়ে পুলিশকে জানালে ওই এলাকায় ডগ স্কোয়াড আনা হয়। এরপর স্থানীয় এক জলাশয় থেকে পাঁচজনের দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং পুলিশের বিশাল বাহিনী দেখে নিহতের পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কিত হয়ে অন্যত্র পালিয়ে যান। বাবুলালের ভাই অর্জুন ওঁরাও বলেন, ‘এখানে আমাদের গবাদি পশু রয়েছে, তাই আমরা মঙ্গলবার তাদের দেখাশোনার জন্য এসেছি। কিন্তু সোমবার পুলিশ আসার পর আমরাও ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। স্ত্রী-সন্তানদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এই মুহূর্তে এখানে থাকতে ভয় লাগছে।
‘অসুস্থ হলে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়’
ওঁরাওদের প্রায় ৬০টি পরিবার এই গ্রামে বাস করে। এদের অধিকাংশই নিরক্ষর। মূলত শ্রমিক হিসাবে এবং কৃষিকাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এই পাড়ায় মাত্র কয়েকটা পাকা বাড়ি রয়েছে।
পূর্ণিয়া শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জনপদে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে এখনও প্রথমে ওঝার দ্বারস্থ হয় সেখানকার বাসিন্দারা। এই জনপদ থেকে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার দূরে রানী পাত্র নামক জায়গায় একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে পূর্ণিয়া শহরে।
অসুস্থ হলে কী করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে রিঙ্কি দেবী বলেন, ‘প্রথমে তাদের (অসুস্থ ব্যক্তিকে) ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর পরিস্থিতি খারাপ হলে হাসপাতালে যায় লোকে।’
এই ঘটনায় ধৃত অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত নকুল ওঁরাও টেটগামারই বাসিন্দা। তিনি মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করেন। ঘটনার পর থেকে তার বাড়িতে তালা দেওয়া রয়েছে।
আর্থিকভাবে সচ্ছল নকুল ওঝার কাজও করেন। সমাজকর্মী বিজয় ওঁরাও তাকে চেনেন। ওই সমাজকর্মী বলেন, ‘নকুল ওঝার কাজ করত। কিছুদিন আগে স্থানীয় ব্যক্তি রামদেওর সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’
‘ওই পরিবারের আরেকটা বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়লে সে বাবুলালের পরিবারকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে দেয়। এমন নয় যে সে টাকার জন্য এটা করেছে, বরং নিজের প্রভাব তৈরি করতে এমনটা করেছে।’
ঘটনার পর পূর্ণিয়া পুলিশের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ঘটনার দিন ভুক্তভুগীদের মারধর করার পর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তাদের দেহ বস্তায় ঢুকিয়ে ট্র্যাক্টরে বোঝাই করে গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরের এক জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়।’
‘এই ঘটনায় দু'টো মোবাইল ফোন, একটা ট্র্যাক্টর, ও পাঁচটা বস্তা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। নকুল ওঁরাও, ছোটু ওঁরাও এবং ট্র্যাক্টরের মালিক সানাউলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে।’
পাড়ার সবাই পলাতক
ঘটনার পর সোমবার পুলিশ আসার পর থেকেই গোটা গ্রাম ফাঁকা।
কোনো কোনো বাড়ির দরজা বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ বাড়ির দরজা খোলা রেখেই বাসিন্দারা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছেন। পাড়ার কেউ কেউ তাদের গবাদি পশুদের সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।
বর্তমানে পাড়ায় নিহতদের পরিবারের গবাদি পশুদের চোখে পড়বে। এই মুহূর্তে নিহতের পরিবারের সদস্যরা ছাড়া গ্রামে মাত্র দু’জন বৃদ্ধা নারী রয়েছেন। তারা কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। তাদের একা রেখেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা চলে গিয়েছেন।
তাদেরই একজন রীনা দেবী। তাকে ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমরা এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমরা বুড়ো মানুষ। আমরা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
বাড়ির সবাই কোথায় চলে গিয়েছেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পুত্রবধূও চলে গিয়েছে। আমি আর কিছু জানি না।’
ঘটনার পর থেকে নিহতের পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে রয়েছেন। তবে নিরাপত্তার নামে ওই এলাকায় দেখা গিয়েছে শুধু পুলিশের একটা গাড়ি এবং দু’জন পুলিশকর্মীকে।
বাবুলাল ওঁরাওর ভাই খুবলাল বলেন, ‘দুপুর পর্যন্ত গণমাধ্যমের লোকজন এখানে যাওয়া আসা করেন কিন্তু রাত নামলেই আতঙ্ক কাজ করতে থাকে। পুরো গ্রামের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা হয়ে গিয়েছে। ওরা বলছে, সাক্ষ্য দিলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে।’
এই পাড়া থেকে বের হলেই স্থানীয়দের কেউই এই বিষয়ে কথা বলতে চান না। রানিগঞ্জ পঞ্চায়েতের সরু রাস্তায় শুধু বৃদ্ধ ও শিশুদের দেখা যায় কিন্তু ক্যামেরা দেখলেই তারা পালানোর চেষ্টা করেন।
ঘটনার পর বাবুলাল ওঁরাও'র পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য তথা ওই নাবালকের নিরাপত্তার বিষয়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পূর্ণিয়ার জেলাশাসক অংশুল কুমার বলেন, "ঘটনার খবর পাওয়ার পর সোমবার আমরা মৃতদেহ উদ্ধার করি এবং ভিডিওগ্রাফির পরে মেডিকেল বোর্ডের সামনে ময়নাতদন্ত করা হয়।"
"পরিবারের সামনেই তাকে দাহ করা হয়েছে। তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বাকিদের খোঁজে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ঘটনায় একই জনজাতির মানুষ জড়িত, যাদের সবাই পলাতক। নিহতদের পরিবারের ওই নাবালক কিশোরকে আপাতত প্রশাসনিক নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে।"
কেন 'ডাইনি' আখ্যা দিয়ে মারা হলো?
এই পরিবারকে এর আগে 'ডাইনি' অভিযোগে হেনস্থা করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে কোনো পোক্ত প্রমাণ মেলেনি।
তবে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাতো দেবীর ছেলে অর্জুন ওঁরাও এবং পুত্রবধূ রিঙ্কি দেবী বলছেন, ‘প্রায় দশ বছর আগে এমনটা হয়েছিল। আমরা তখন বলেছিলাম এরকম কিছু থাকলে ওঝাকে দিয়ে যাচাই করে নাও। ওঝা ডেকে যাচাই করা হলেও কিছুই বেরোয়নি।’
‘এখন ১০ বছর পর আবার লোকজন ডাইনি অপবাদ দিতে শুরু করে। কিন্তু আমরা আর কিছুই জানি না।’
এখানে একটা প্রশ্ন উঠছে যে, এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত নারীদেরই ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে লক্ষ্যবস্তু করা হয় এবং তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকেই মেরে ফেলা হয়েছে।
বাবুলাল ওঁরাওর ভাই অর্জুন বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। তাই এই পরিকল্পনা কেন করল তা আমরা জানি না।’
কুসংস্কার এবং ‘ডাইনি’র মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে কাজ করেন সমাজকর্মী সন্তোষ শর্মা। তার কথায়, ‘আমরা যারা মাঠে কাজ করছি তাদের কাছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে কেন পুরো পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছিল। ডাইনি অপবাদের ক্ষেত্রে অনেক আর্থ-সামাজিক বা সম্পত্তিগত কারণ থাকলেও এ ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ যেমন প্রকাশ করা হয়নি, তেমনই পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারার কারণটাও কিন্তু বোধগম্য নয়।’
পিঙ্কি রানি হাঁসদা পূর্ণিয়ার একটি কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার অভাবে এখানকার স্থানীয়রা অসুস্থ হলে ওঝার কাছে যায়। একমাত্র শিক্ষাই পারে তাদের সঠিক পথে নিয়ে যেতে।’
কেন বারবার একই ধরনের ঘটনা
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নারীদের 'ডাইনি' আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের বহু ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, মল খেতে বাধ্য করা, চুল কাটা ও নগ্ন করে এলাকায় ঘোরানোর মতো বিভিন্ন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে।
ঝাড়খণ্ড, আসাম, রাজস্থান, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, বিহার-সহ একাধিক রাজ্যে এমন বহু ঘটনা দেখা গিয়েছে। বিহার ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে ১৯৯৯ সালে এর বিরুদ্ধে আইন করা হয়।
২০২৩ সালে নিরন্তর নামের একটা সংস্থা বিহারের ১০ জেলার ১১৮টি গ্রামের ১৪৫ জন ভুক্তভোগী নারীর উপর একটি জরিপ চালায়। এদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই পিছিয়ে পড়া, অতি অনগ্রসর ও দলিত সম্প্রদায়ের নারী।
বিহারের নারীদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে 'বিহার মহিলা সমাজ' নামে একটি সংগঠন। পূর্ণিয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর সেখানে তদন্তকারী দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই সংগঠন। পাশাপাশি সমগ্র রাজ্যে এই ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার কথাও জানিয়েছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ডাইনি আখ্যা দিয়ে সারা ভারতে ৮৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডে কাজ করে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান অ্যাওয়ারনেস’। এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় কুমার জয়সওয়াল বলেন, ‘বিগত ২৬ বছরে ঝাড়খণ্ডে ১৮০০ নারীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই জহজাতি বা উপজাতির। এইসব ঘটনায় এক বা দু'জন লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কিন্তু অভিযুক্তদের একটা বড় অংশ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এসব ক্ষেত্রে আইনের প্রভাব তখনই দেখা যাবে যখন দোষীদের সকলে শাস্তি পাবে।’
বিহারের পূর্ণিয়ায় ‘ডাইনি’ অভিযোগে একই পরিবারের পাঁচজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। নিহতদের মধ্যে তিনজন নারী এবং দু’জন পুরুষ।
ঘটনাটি ঘটেছে রোববার, পূর্ণিয়ার রাজ রানিগঞ্জ পঞ্চায়েতের টেটগামা গ্রামে। বিবিসির টিম মঙ্গলবার যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তখন জনশূন্য ছিল গ্রামটি।
টেটগামায় ঢুকতেই পাকা-কাঁচা রাস্তার ডান পাশে একটা ফাঁকা জায়গাকে নিজেদের ক্যামেরায় বন্দি করছিলেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং ইউটিউবাররা।
সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল একটা লাল শাড়ির পোড়া অংশ এবং মানুষের চুল- যা ছয়ই জুলাই তথা রোববার রাতে ঘটে যাওয়া অমানবিক কাজের সাক্ষ্য দেয়।
প্রায় ৬০টি ঘরযুক্ত এই এলাকায় এই মুহূর্তে রয়ে গিয়েছেন একমাত্র নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা। বাকি বাসিন্দাদের সকলেই এখন পলাতক।
এর কারণ ওই এলাকার সমস্ত বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে পাঁচজনকে মারধর করার পর পুড়িয়ে মারার অভিযোগে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
তবে এই ঘটনার তিন দিন পরেও গ্রেপ্তারের সংখ্যা তিনজন। যদিও নাম জানা গিয়েছে এমন ২৩ জন এবং ১৫০-২০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এই ঘটনার পর একদিকে যেমন কুসংস্কার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তেমনই প্রশ্ন উঠেছে পূর্ণিয়া জেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক জনপদে কীভাবে রাতভর পাঁচজনকে মারধর এবং পুড়িয়ে মারার ঘটনা চলল, অথচ পুলিশ কোনো খবর পেল না।
এই প্রসঙ্গে পূর্ণিয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অংশুল কুমার এবং পুলিশ সুপার সুইটি সেহরাওয়াতের মধ্যে কেউই বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
কী ঘটেছিল?
‘ডাইনিবিদ্যা’ চর্চার অভিযোগ তুলে পূর্ণিয়ার ওই গ্রামের বাবুলাল ওঁরাও (৬৫), সীতা দেবী (৬০), মনজিৎ ওঁরাও (২৫), কাতো দেবী (৭৫) এবং রেখা দেবীকে (২২) জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
নিহতদের মধ্যে বাবুলাল ওঁরাও এবং সীতা দেবী স্বামী-স্ত্রী ছিলেন এবং কাতো দেবী বাবুলাল ওঁরাওর মা। মনজিৎ ছিলেন বাবুলাল ওঁরাওর ছেলে এবং রেখা দেবী তার (মনজিৎ) স্ত্রী। এরা একই বাড়িতে একসঙ্গে থাকতেন।
কাতো দেবীর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বহু বছর আগে। তার পাঁচ ছেলে - জগদীশ, বাবুলাল, খুবলাল, অর্জুন এবং জিতেন্দ্র। বাবুলাল ওঁরাও'র বাকি ভাই এবং তাদের পরিবার ওই পাড়ায় আলাদা বাড়িতে থাকেন।
বাবুলাল-সীতা দেবীর চার ছেলে। মনজিৎ, তার স্ত্রী ও এবং এক নাবালক পুত্রকে নিয়ে থাকতেন তারা। বাবুলাল ওঁরাও'র বাকি দুই ছেলে পেশায় শ্রমিক। ওই দম্পতির সাথে থাকা ছোট ছেলে শুধুমাত্র জীবিত আছে। ঘটনার সূত্রপাত, ওই এলাকার এক শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বলে জানা গিয়েছে।
দিন কয়েক আগে, ওই পাড়ার রামদেও নামে এক ব্যক্তির সন্তানের মৃত্যু হয়। ওই শিশুর মৃত্যুর পর রামদেওর ভাগ্নেরও স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য বাবুলাল ওঁরাওর পরিবারের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল।
বাবুলাল ওঁরাওর পরিবার, বিশেষত তার মা কাতো ও স্ত্রী সীতা দেবী 'জাদু টোনা' করতেন বলে সন্দেহ করত ওই পাড়ার বাসিন্দারা।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনার আগে, রোববার সন্ধ্যায় বাবুলাল ওঁরাও'র বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাঁশ গাছের ঝাড়ের কাছে ওই পাড়া এবং সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ওঁরাও জনজাতির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একটা সভা বসে।
ঠিক তারপরই কয়েকশো মানুষ তার (বাবুলাল ওঁরাওর) বাড়িতে লাঠি-সোটা এবং অস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়।
বাবুলাল ওঁরাও'র ভাই অর্জুন ওঁরাও বিবিসিকে বলেন, ‘রোববার কাজ শেষ করে পূর্ণিয়া থেকে সাইকেলে করে ফেরার পথে দেখি শত শত নারী-পুরুষ বাবুলালের বাড়ির কাছে জড়ো হয়েছে। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ও লাঠি ছিল। ওরা সবাই বারবার ডাইনি ডাইনি বলছিল আর মারছিল।’
‘আমরা বাধা দিলে ওরা আমাদের সরে যেতে বলে। হুমকি দেয় না হলে আমাদেরও মেরে ফেলবে। তারা আমাকে আর আমার আরেক ভাইয়ের পরিবারকে অস্ত্র দেখিয়ে বন্দি করে।’
‘ওরা আমার মা ও ভাইকে মারধর করে। তারপরে তাদের বাড়ি থেকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গিয়ে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিবারের বাকিদের সঙ্গেও একই আচরণ করে তারা।’
পুলিশে খবর দেয় এক নাবালক
এই ঘটনার পর নিহতের পরিবারের মধ্যে এতটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যে, কেউই পুলিশকে খবর দেননি।
এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে কাতো দেবীর ছেলে খুবলাল ওঁরাও বলেন, ‘আমরা আমাদেরই চোখের সামনে মা ও ভাইয়ের পরিবারকে মারধর করতে দেখেছি। ওরা আমাদের পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছিল আর হুমকি দিয়েছিল যে পুলিশ ডাকতে গেলে আমাদেরও মেরে ফেলবে। কীই-বা করতে পারতাম আমরা?’
পুলিশ এই ঘটনার বিষয়ে জানতে পারে যখন নিহতদের পরিবারেরই এক নাবালক কিশোর থানায় খবর দেয়। বছর ১৭-র ওই কিশোর, বাবুলাল ওঁরাও'র ছোট ছেলে। হামলার সময় কোনো মতে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিল সে।
কাতোর পুত্রবধূ রিঙ্কি দেবী বিবিসিকে বলছেন, ‘যখন সবাই ওকে (বাবুলাল ওঁরাও'র নাবালক ছেলেকে) মারধর শুরু করে, তখন কিছু লোক এসে বলেছিল ও বাচ্চা, ওকে ছেড়ে দাও। ও দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে আসার পর ওকে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম আমরা।’
‘পরে দিদার বাড়িতে চলে যায় ও। সেখান থেকে থানায় গিয়ে ঘটনার কথা জানায়। ওর কথা শুনেই পুলিশ এসেছিল।’
ওই কিশোর তার বাবা-মাসহ পরিবারের বাকি সদস্যদের খোঁজ না পাওয়ার বিষয়ে পুলিশকে জানালে ওই এলাকায় ডগ স্কোয়াড আনা হয়। এরপর স্থানীয় এক জলাশয় থেকে পাঁচজনের দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং পুলিশের বিশাল বাহিনী দেখে নিহতের পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কিত হয়ে অন্যত্র পালিয়ে যান। বাবুলালের ভাই অর্জুন ওঁরাও বলেন, ‘এখানে আমাদের গবাদি পশু রয়েছে, তাই আমরা মঙ্গলবার তাদের দেখাশোনার জন্য এসেছি। কিন্তু সোমবার পুলিশ আসার পর আমরাও ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। স্ত্রী-সন্তানদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এই মুহূর্তে এখানে থাকতে ভয় লাগছে।
‘অসুস্থ হলে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়’
ওঁরাওদের প্রায় ৬০টি পরিবার এই গ্রামে বাস করে। এদের অধিকাংশই নিরক্ষর। মূলত শ্রমিক হিসাবে এবং কৃষিকাজ করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এই পাড়ায় মাত্র কয়েকটা পাকা বাড়ি রয়েছে।
পূর্ণিয়া শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জনপদে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে এখনও প্রথমে ওঝার দ্বারস্থ হয় সেখানকার বাসিন্দারা। এই জনপদ থেকে প্রায় ২.৫ কিলোমিটার দূরে রানী পাত্র নামক জায়গায় একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে পূর্ণিয়া শহরে।
অসুস্থ হলে কী করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে রিঙ্কি দেবী বলেন, ‘প্রথমে তাদের (অসুস্থ ব্যক্তিকে) ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর পরিস্থিতি খারাপ হলে হাসপাতালে যায় লোকে।’
এই ঘটনায় ধৃত অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত নকুল ওঁরাও টেটগামারই বাসিন্দা। তিনি মাটি কেটে ইটভাটায় সরবরাহ করেন। ঘটনার পর থেকে তার বাড়িতে তালা দেওয়া রয়েছে।
আর্থিকভাবে সচ্ছল নকুল ওঝার কাজও করেন। সমাজকর্মী বিজয় ওঁরাও তাকে চেনেন। ওই সমাজকর্মী বলেন, ‘নকুল ওঝার কাজ করত। কিছুদিন আগে স্থানীয় ব্যক্তি রামদেওর সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’
‘ওই পরিবারের আরেকটা বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়লে সে বাবুলালের পরিবারকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে দেয়। এমন নয় যে সে টাকার জন্য এটা করেছে, বরং নিজের প্রভাব তৈরি করতে এমনটা করেছে।’
ঘটনার পর পূর্ণিয়া পুলিশের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ঘটনার দিন ভুক্তভুগীদের মারধর করার পর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তাদের দেহ বস্তায় ঢুকিয়ে ট্র্যাক্টরে বোঝাই করে গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরের এক জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়।’
‘এই ঘটনায় দু'টো মোবাইল ফোন, একটা ট্র্যাক্টর, ও পাঁচটা বস্তা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। নকুল ওঁরাও, ছোটু ওঁরাও এবং ট্র্যাক্টরের মালিক সানাউলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে।’
পাড়ার সবাই পলাতক
ঘটনার পর সোমবার পুলিশ আসার পর থেকেই গোটা গ্রাম ফাঁকা।
কোনো কোনো বাড়ির দরজা বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ বাড়ির দরজা খোলা রেখেই বাসিন্দারা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছেন। পাড়ার কেউ কেউ তাদের গবাদি পশুদের সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।
বর্তমানে পাড়ায় নিহতদের পরিবারের গবাদি পশুদের চোখে পড়বে। এই মুহূর্তে নিহতের পরিবারের সদস্যরা ছাড়া গ্রামে মাত্র দু’জন বৃদ্ধা নারী রয়েছেন। তারা কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। তাদের একা রেখেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা চলে গিয়েছেন।
তাদেরই একজন রীনা দেবী। তাকে ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমরা এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমরা বুড়ো মানুষ। আমরা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
বাড়ির সবাই কোথায় চলে গিয়েছেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পুত্রবধূও চলে গিয়েছে। আমি আর কিছু জানি না।’
ঘটনার পর থেকে নিহতের পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে রয়েছেন। তবে নিরাপত্তার নামে ওই এলাকায় দেখা গিয়েছে শুধু পুলিশের একটা গাড়ি এবং দু’জন পুলিশকর্মীকে।
বাবুলাল ওঁরাওর ভাই খুবলাল বলেন, ‘দুপুর পর্যন্ত গণমাধ্যমের লোকজন এখানে যাওয়া আসা করেন কিন্তু রাত নামলেই আতঙ্ক কাজ করতে থাকে। পুরো গ্রামের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা হয়ে গিয়েছে। ওরা বলছে, সাক্ষ্য দিলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে।’
এই পাড়া থেকে বের হলেই স্থানীয়দের কেউই এই বিষয়ে কথা বলতে চান না। রানিগঞ্জ পঞ্চায়েতের সরু রাস্তায় শুধু বৃদ্ধ ও শিশুদের দেখা যায় কিন্তু ক্যামেরা দেখলেই তারা পালানোর চেষ্টা করেন।
ঘটনার পর বাবুলাল ওঁরাও'র পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য তথা ওই নাবালকের নিরাপত্তার বিষয়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পূর্ণিয়ার জেলাশাসক অংশুল কুমার বলেন, "ঘটনার খবর পাওয়ার পর সোমবার আমরা মৃতদেহ উদ্ধার করি এবং ভিডিওগ্রাফির পরে মেডিকেল বোর্ডের সামনে ময়নাতদন্ত করা হয়।"
"পরিবারের সামনেই তাকে দাহ করা হয়েছে। তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বাকিদের খোঁজে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ঘটনায় একই জনজাতির মানুষ জড়িত, যাদের সবাই পলাতক। নিহতদের পরিবারের ওই নাবালক কিশোরকে আপাতত প্রশাসনিক নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে।"
কেন 'ডাইনি' আখ্যা দিয়ে মারা হলো?
এই পরিবারকে এর আগে 'ডাইনি' অভিযোগে হেনস্থা করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে কোনো পোক্ত প্রমাণ মেলেনি।
তবে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাতো দেবীর ছেলে অর্জুন ওঁরাও এবং পুত্রবধূ রিঙ্কি দেবী বলছেন, ‘প্রায় দশ বছর আগে এমনটা হয়েছিল। আমরা তখন বলেছিলাম এরকম কিছু থাকলে ওঝাকে দিয়ে যাচাই করে নাও। ওঝা ডেকে যাচাই করা হলেও কিছুই বেরোয়নি।’
‘এখন ১০ বছর পর আবার লোকজন ডাইনি অপবাদ দিতে শুরু করে। কিন্তু আমরা আর কিছুই জানি না।’
এখানে একটা প্রশ্ন উঠছে যে, এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত নারীদেরই ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে লক্ষ্যবস্তু করা হয় এবং তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকেই মেরে ফেলা হয়েছে।
বাবুলাল ওঁরাওর ভাই অর্জুন বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। তাই এই পরিকল্পনা কেন করল তা আমরা জানি না।’
কুসংস্কার এবং ‘ডাইনি’র মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে কাজ করেন সমাজকর্মী সন্তোষ শর্মা। তার কথায়, ‘আমরা যারা মাঠে কাজ করছি তাদের কাছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে কেন পুরো পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছিল। ডাইনি অপবাদের ক্ষেত্রে অনেক আর্থ-সামাজিক বা সম্পত্তিগত কারণ থাকলেও এ ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ যেমন প্রকাশ করা হয়নি, তেমনই পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারার কারণটাও কিন্তু বোধগম্য নয়।’
পিঙ্কি রানি হাঁসদা পূর্ণিয়ার একটি কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার অভাবে এখানকার স্থানীয়রা অসুস্থ হলে ওঝার কাছে যায়। একমাত্র শিক্ষাই পারে তাদের সঠিক পথে নিয়ে যেতে।’
কেন বারবার একই ধরনের ঘটনা
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নারীদের 'ডাইনি' আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের বহু ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, মল খেতে বাধ্য করা, চুল কাটা ও নগ্ন করে এলাকায় ঘোরানোর মতো বিভিন্ন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে।
ঝাড়খণ্ড, আসাম, রাজস্থান, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, বিহার-সহ একাধিক রাজ্যে এমন বহু ঘটনা দেখা গিয়েছে। বিহার ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে ১৯৯৯ সালে এর বিরুদ্ধে আইন করা হয়।
২০২৩ সালে নিরন্তর নামের একটা সংস্থা বিহারের ১০ জেলার ১১৮টি গ্রামের ১৪৫ জন ভুক্তভোগী নারীর উপর একটি জরিপ চালায়। এদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই পিছিয়ে পড়া, অতি অনগ্রসর ও দলিত সম্প্রদায়ের নারী।
বিহারের নারীদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে 'বিহার মহিলা সমাজ' নামে একটি সংগঠন। পূর্ণিয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর সেখানে তদন্তকারী দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই সংগঠন। পাশাপাশি সমগ্র রাজ্যে এই ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার কথাও জানিয়েছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ডাইনি আখ্যা দিয়ে সারা ভারতে ৮৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডে কাজ করে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান অ্যাওয়ারনেস’। এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় কুমার জয়সওয়াল বলেন, ‘বিগত ২৬ বছরে ঝাড়খণ্ডে ১৮০০ নারীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই জহজাতি বা উপজাতির। এইসব ঘটনায় এক বা দু'জন লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কিন্তু অভিযুক্তদের একটা বড় অংশ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এসব ক্ষেত্রে আইনের প্রভাব তখনই দেখা যাবে যখন দোষীদের সকলে শাস্তি পাবে।’
উগান্ডা পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার স্থানীয় সময় রাত সোয়া ১২টার দিকে কাম্পালা-গুলু হাইওয়েতে বিপরীত দিকে আসা দুটি বাস মুখোমুখি হয়ে যায়। দুর্ঘটনা এড়াতে গেলে একটি বাস উল্টে যায়। আর এ সময় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে অন্যান্য যানবাহনগুলোও উল্টে গেলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
৩৪ মিনিট আগেআফগানিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে ২০২১ সালে। দুই দশক ধরে চলা, এই যুদ্ধের কারণে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে দেশ দুটির মধ্যে, তবে এমন সম্পর্ক থেকে উত্তরণ চায় ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নই এখন তাদের লক্ষ্য।
২ ঘণ্টা আগেভারতের উত্তর প্রদেশের একটি শিল্পনগরী এলাকা কানপুর। গত ৪ সেপ্টেম্বর কানপুরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সৈয়দ নগরে ঈদে মিলাদুন্নবি উদ্যাপন উপলক্ষে সন্ধ্যায় একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়।
৩ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি বায়ু দূষণ কমানোর জন্য রাজধানীতে পেট্রোলচালিত মোটরবাইকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভিয়েতনাম প্রশাসন। যা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। তবে, পরিকল্পিত এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের বাজার হারাবে বলে আশঙ্কা করছে জাপান সরকার এবং দেশের কিছু শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা।
৩ ঘণ্টা আগে