মারাত্মক দূষণের শিকার ইরাকের বিখ্যাত টাইগ্রিস (দজলা) নদী। বর্তমানে এর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদী। নদীটি বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নদীটি। এর সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়বে নদীতীরে বসবাসকারী প্রাচীন সম্প্রদায়ের জনজীবন।
টাইগ্রিস বিখ্যাত দুই নদীর একটি, যেগুলো মেসোপটেমীয় সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই সেচ ও কৃষির জন্য এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীটি ইরাকের বৃহত্তম শহর মসুল ও বাগদাদের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে পারস্য উপসাগর শাত আল আরবে গিয়ে পতিত হয়েছে। এটি দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের টরাস পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
মূলত বিশ্বের ইতিহাসের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে এই দুই নদীর তীরেই। এখানেই প্রথমবার বৃহৎ পরিসরে কৃষিকাজ বিকশিত হয়। প্রথম লেখার উদ্ভব এবং চাকার আবিষ্কারও হয়েছিল এখানে। বর্তমানে টাইগ্রিসের পানি তার অববাহিকায় বসবাসকারী প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের সেচকাজ, পরিবহন, শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পানীয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি, নদীর তীরবর্তী জনগোষ্ঠীদের কাছে এর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বও বহুগুণ।
দক্ষিণ ইরাকের আমারাহ শহরের বাসিন্দা মান্ডেয়ান (ব্যাপ্টিস্ট) ধর্মীয় নেতা শেখ নিধাম তার এক মাস বয়স থেকে টাইগ্রিস নদীতে নিয়মিত গোসল করে আসছেন। কারণ, এর সঙ্গে তার ধর্মীয় অনুশাসন জড়িত। তিনি বলেন, ‘পানি নেই; জীবনও নেই’।
নদী রক্ষা সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা হুমাত দিজলাহর প্রতিষ্ঠাতা সালমান খাইরাল্লা বলেন, ‘এটি পান করা, সেচ দেওয়া, ব্যবহার করার জন্য বা ধোয়ার পানির চেয়েও বেশি কিছু। এটি এমনকি আধ্যাত্মিকতার চেয়েও বেশি কিছু।’
কিন্তু কয়েক দশক ধরে নদীটির অবস্থার ব্যাপক অবনতি হচ্ছে। আমেরিকা ১৯৯১ সালে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে ইরাককে লক্ষ্যবস্তু করার আগ পর্যন্ত এখানে অত্যাধুনিক অবকাঠামো ছিল। কিন্তু শোধনাগার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর পয়োনিষ্কাশন টাইগ্রিসে গিয়ে পতিত হয়। বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞা ও সংঘাতের ফলে অবকাঠামোটি কখনোই পুরোপুরি মেরামত করা হয়। বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য ইরাক জুড়ে মাত্র ৩০ শতাংশ শহুরে পরিবার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। গ্রামীণ এলাকায় এই পরিসংখ্যান মাত্র এক দশমিক সাত শতাংশ। এতে টাইগ্রিসের পানি ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে।
এছাড়া পৌরসভার বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকসহ শিল্প ও চিকিৎসা বর্জ্য নদীটিতে প্রবেশ করে। ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাগদাদের অসংখ্য স্থানে পানির গুণমান ‘খারাপ’ বা ‘খুব খারাপ’। এর আগে, ২০১৮ সালে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বসরার অন্তত এক লাখ ১৮ হাজার মানুষ দূষিত পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
এদিকে নদীটির সীমানাও নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গত তিন দশকে তুরস্ক টাইগ্রিস নদীর ওপর বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করায় বাগদাদে পানির পরিমাণ ৩৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এদিকে, ইরানও বাঁধ নির্মাণ করে নদীটির পানির গতিপ্রবাহ পরিবর্তন করেছে। এছাড়া ইরাকের অভ্যন্তরে প্রায়শই অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে, কৃষি খাতে ভূপৃষ্ঠের অন্তত ৮৫ শতাংশ পানি এখান থেকে ব্যবহার করা হয়।
ইরাকে জলবায়ু সংকটও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই গ্রীষ্মে টাইগ্রিসের প্রবাহ এত কম ছিল যে নদীর ওপর দিয়ে মানুষ সহজেই হেঁটে যেতে পারত। দেশটিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমেছে এবং ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরার আশঙ্কা রয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা সরবরাহের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সালমান খাইরাল্লা মনে করেন, উজানের বাঁধ এবং অব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ, নদীর আয়তন হ্রাস পাওয়ায় দূষণের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, পানির গুণমান এর পরিমাণের ওপর নির্ভর করে।
ইরাক সরকারকে বারবার তার উত্তরের প্রতিবেশীকে বাঁধ থেকে আরো বেশি পানি ছাড়ার জন্য চাপ দিতে হয়েছে। এই আলোচনায় তুরস্কের কর্মকর্তারা যে উদ্বেগ উত্থাপন করেন-তার মধ্যে ইরাকের পানি অপচয় অন্যতম।
বাগদাদ ও আঙ্কারা গত নভেম্বরে টাইগ্রিসের দূষণ বন্ধ, আধুনিক সেচ প্রযুক্তি প্রবর্তন, কৃষিজমি পুনরুদ্ধার ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় একটি ব্যবস্থাপনায় স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, অবকাঠামো প্রকল্পগুলো তুরস্কের কোম্পানিগুলো পরিচালনা করবে এবং তেলের তহবিল দিয়ে প্রকল্পের অর্থায়ন করবে। এজন্য এটিকে ‘তেলের বিনিময়ে পানি’ চুক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

