পুরো বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র জুলাই বিপ্লবী শহীদ শরীফ ওসমান হাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ-সংলগ্ন বাংলাদেশের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে গতকাল শনিবার বিকালে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে দুপুর আড়াইটায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ওই এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। সারা দেশের লাখ লাখ জনতা জানাজায় অংশ নেন। ঐতিহাসিক এ জানাজায় তারা হাদির আজাদির লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
জানাজার নামাজের আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবেগঘন সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘প্রিয় হাদি, তুমি হারিয়ে যাবে না। তুমি সকল বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে।’ এ সময় মরহুমের বড় ভাই ড. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমাদের দাবি—হাদির হত্যাকারী ও তাদের সহযোগীদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এ দাবি কোনোদিন ছাড়ব না। তিনি আরো বলেন, ‘সরকার বা অন্য কারো কাছে আমাদের পরিবারের চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমরা কিছু চাই না। আমরা আপনাদের কাছে আমার ভাইয়ের জন্য ও তার আট মাসের সন্তানের জন্য দোয়া চাই।’
এদিকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, রংপুর, বগুড়া, কক্সবাজার, ঝালকাঠী, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ওসমান হাদির গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেসব স্থানেও জানাজায় মানুষের ঢল নামে।
গতকাল সংসদ ভবনের বেষ্টনীর ভেতরে সবুজ মাঠে জানাজা হলেও জনতার উপস্থিতি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আসাদগেট, মনিপুরীপাড়াসহ আশপাশের এলাকা ছাপিয়ে যায়। জুলাইযোদ্ধা ওসমান হাদিকে শেষ বিদায় জানাতে উপস্থিত হন দলমত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজের বিশিষ্টজন এই জানাজায় অংশ নেন।
শহীদ ওসমান হাদির জানাজার নামাজ কেবল একজন মানুষের বিদায় ছিল না—ছিল একটি সময়, একটি আদর্শ এবং একটি প্রজন্মের অগ্নিপরীক্ষার মহাকাব্যিক মুহূর্ত। রাজধানীর বুকজুড়ে এদিন নেমে আসে শোক, গর্ব আর শপথের অদ্ভুত সম্মিলন। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় জানাজার কথা থাকলেও গতকাল সকাল থেকেই মানুষ জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায় আসতে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বেলা ১২টা নাগাদ মানুষের ঢল নামে। যেন বাঁধভাঙা স্রোতের ঢেউয়ে মানুষ চতুর্দিক থেকে এসে মিলিত হয় জানাজাস্থলে। জনসমুদ্রে পরিণত হয় জাতীয় সংসদ ভবনসহ আশপাশের গোটা এলাকা।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দুপাশের রাস্তা থেকে ধানমন্ডি সাতাশ মোড়, আসাদ গেট হয়ে পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, বিজয় সরণি এবং আশপাশের প্রধান সড়ক ও অলিগলি, দক্ষিণ প্লাজার প্রতিটি কোণে ছিল মানুষের ভিড়। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই দেখেও মানুষের স্রোত চলমান ছিল জানাজা শেষ হওয়ার পরও। বৃদ্ধ থেকে শিশু, তরুণ থেকে প্রবীণ—জানাজাস্থলে নারীর উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। সবার চোখে যেন এক গভীর শোক, মুখে এক অনড় দৃঢ়তা। জনসমুদ্রে বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। তাদের অনেকে কালো ব্যাচ ধারণ করে হাদির মৃত্যুতে শোক জানান, অনেকে কালো পাঞ্জাবি পরে আসেন। অনেকে জাতীয় পতাকা হাতে কিংবা মাথায় বেঁধে হাদির দেশপ্রেমের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
‘তুমি কে, আমি কেÑহাদি হাদি’, ‘আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে শহীদ হব’, ‘হাদির রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’, ‘হাদি এখন কবরে, খুনি কেন ভারতে’, ‘দিল্লি না ঢাকাÑঢাকা ঢাকা’, ‘আজাদি না গোলামিÑআজাদি আজাদি’, ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘হাদির খুনিদের ঠাঁই, এই বাংলায় হবে না’, ‘একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জেলে ভর’, ‘নারায়ে তাকবিরÑআল্লাহু আকবার’—এমন নানা স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল চারদিক। এসব ধ্বনি যেন জানাচ্ছিল—হাদি আর কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি সংগ্রামের নাম।
জানাজাকে কেন্দ্র করে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আশপাশের সব প্রবেশপথে নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি র্যাব ও আনসার মোতায়েন করা হয়, বিশেষ টহলে ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করে এক হাজার বডি-ওর্ন ক্যামেরাসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।
বেলা সাড়ে ১২টার পর শহীদ ওসমান হাদির লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ থেকে কড়া পাহারায় আসাদগেটসংলগ্ন গেট দিয়ে সংসদ ভবন এলাকায় নিয়ে রাখা হয়। তারও আগে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ওই সময় হাসপাতাল এলাকা ছিল সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা। সেখানেও স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে ওঠে চারপাশ। পরে হাদির লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসাদ গেট প্রাঙ্গণ থেকে সংসদ ভবন এলাকায় জানাজাস্থলে এলে মানুষের মিছিল যেন আপনাআপনি তার সঙ্গে মিশে যায়। মূলত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘর থেকে সহযোদ্ধা ও সমর্থকদের অংশগ্রহণে বিশাল শোক মিছিলের মাধ্যমে হাদির লাশ জানাজার মাঠে আনা হয়। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল শোক, প্রতিটি চোখে ছিল অশ্রু।
সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বেলা দুটার কিছুক্ষণ আগে লাশ নেওয়া হয় জানাজাস্থলে। এরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানাজাস্থলে প্রবেশ করেন। শুরু হয় জানাজার আনুষ্ঠানিকতা। জানাজার আগে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং হাদির জীবনী পাঠ করে শোনান। এরপর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বক্তব্য দেন। এরপর বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শেষে বক্তব্য দেন ওসমান হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। তার আবেগঘন বক্তৃতার সময় জানাজার জন্য উপস্থিত অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনিই হাদির জানাজার নামাজে ইমামতি করেন। তবে জানাজার আগে-পরে শ্রদ্ধা নিবেদনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।
জানা গেছে, পরিবারের ইচ্ছায় ইসলামি বিধান অনুসরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের কোনো পর্ব রাখা হয়নি। তবে তার লাশ জাতীয় পতাকা দিয়ে মোড়ানো ছিল। সিঙ্গাপুর থেকে আনার সময় তার কফিনও ছিল লাল-সবুজ কাপড়ে মোড়ানো।
জানাজার সময় প্রধান উপদেষ্টার দুই পাশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের দেখা গেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনÑজামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রমুখ।
জানাজার পরপরই প্রধান উপদেষ্টা সংসদ ভবন এলাকা ত্যাগ করেন। এরপর বিকাল পৌনে তিনটার দিকে হাদির লাশ বহনকারী গাড়ি কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হয়। আসাদগেট, ধানমন্ডি, কলাবাগান, সায়েন্সল্যাব হয়ে বেলা ৩টার দিকে লাশ পৌঁছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি চত্বরে।
এদিকে জানাজায় অংশ নেওয়া মানুষের বড় একটি অংশ প্রতীকী কফিন নিয়ে মিছিল সহকারে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও শাহবাগ হয়ে দাফনের স্থলে প্রবেশ করেন। শহীদ হাদির লাশ কবি নজরুল ইসলামের সমাধিতে পৌঁছানোর পর দাফন কার্যক্রম শুরু হয়। বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে তার দাফন সম্পন্ন হয়। দাফনের আগে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেখানে উপস্থিত সবাই। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
দাফনকালে ওসমান হাদির লাশ কবরে নামান আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, হাদির ভাই ওমর হাদি, এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের। এ সময়ে অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এস এম ফরহাদসহ অনেক সহযোদ্ধা তথা জুলাইয়ের প্রথম সারির বিপ্লবীরা উপস্থিত ছিলেন। দাফনের পরে ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন শহীদের বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক।
জানাজার আগে শপথ
গতকাল জানাজার আগে শহীদ ওসমান হাদির কফিন সামনে রেখে আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াইয়ের শপথ নিয়েছেন তার সমর্থকরা। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শপথ নেওয়ার সময় বলা হয়Ñশহীদের কফিন সামনে আমাদের শপথ, আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়ে যাব। হে আমাদের মালিক, আমাদের শহীদ হাদির মতো কবুল করুন বিপ্লবের পথে, শাহাদাতের পথে। এ সময় তারা শহীদ ওসমান হাদি যে সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করেছিলেন, সে লড়াই পরিপূর্ণ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
এ সময় সমর্থকরা বলেন, আল্লাহ ওসমান হাদি ভাইকে কবুল করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে এই বাংলাদেশকে যেন আমরা নিজেদের মতো করে পরিচালনা করতে পারি। আমাদের দেশকে যেন আমরা বিদেশি নানা ধরনের আগ্রাসন, বিশেষ করে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে পারি এবং এই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা যেন বিরাজমান থাকে।
জানাজার আগে আবেগঘন পরিবেশ
জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, লাখ লাখ লোক এখানে হাজির হয়েছে। পথে পথে ঢেউয়ের মতো লোক আসছে।
ওসমান হাদিকে স্মরণ করে তিনি বলেন, প্রিয় ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসিনি এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছ। বাংলাদেশ যতদিন আছে, তুমি সব বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে। এটা কেউ সরাতে পারবে না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিদায় দিতে নয়, আমরা তোমার কাছে ওয়াদা করতে এসেছি। উন্নত মম শিরের যে মন্ত্র তুমি দিয়ে গেছ, সেটা বাংলাদেশি সন্তানের জন্মলগ্ন থেকে যতদিন সে বেঁচে থাকবে, নিজের কাছে বলবে। আমাদের শির কখনো নত হবে না। আমরা দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে চলব। সেই মন্ত্র তুমি আমাদের দিয়ে গেছ। আমরা সেটা পূরণ করে যাব।
ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ওসমান হাদিকে ১৬৮ ঘণ্টা আগে গুলি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কি আশ্বস্ত করা হয়েছে? আমরা মনে করছি, খুনি একজন নয়, পুরো একটা খুনিচক্র কাজ করেছে। খুনি, খুনের পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী, পুরো খুনিচক্রকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এ সময় তিনি বলেন, আমরা ওসমান হাদির রক্তকে বৃথা যেতে দেব না। তার রক্তের মাধ্যমে এ দেশে ইনসাফ কায়েম করা হবে।
ওসমান হাদিকে স্মরণ করে ধর্ম উপদেষ্টা খালিদ হোসেন বলেন, সারা দেশ আজ কাঁদছে। দুষ্টচক্র ওসমান হাদিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল; আর তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীক। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন এবং তার জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি মার্জনা করেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের টুকরো বানিয়ে দেন। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেনÑআধিপত্যবিরোধী একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে তৌফিক দান করুন।
জানাজার আগে আবেগঘন বক্তব্য দেন হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। ওসমান হাদির রেখে যাওয়া আট মাসের শিশুসন্তানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আট মাসের একটি সন্তানকে তিনি রেখে গেছেন। সন্তানের নামকরণের আগে ওসমান হাদি আমাকে যা বলেছিল, সেই স্মৃতি আজ বারবার মনে পড়ছে।
আবু বকর বলেন, একটাই দাবি। সাত থেকে আট দিন হয়ে গেল, খুনি যদি পার পেয়ে যায়Ñএর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই। তারা কেমন করে পালিয়ে গেল, এ প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম।
আরো যারা অংশ নেন জানাজায়
ওসমান হাদির জানাজায় রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের উপদেষ্টা ছাড়াও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিসহ সমাজের বিশিষ্টজনরা অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সদ্য পদত্যাগী দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও মাহফুজ আলম, বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, জামায়াতে ইসলামীর মোবারক হোসাইন, নূরুল ইসলাম বুলবুল, মাসুদ সাঈদী, এনসিপির আখতার হোসেন, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, ইসলামী আন্দোলনের অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মামুনুল হক ও জালালুদ্দীন আহমদ, খেলাফত আন্দোলনের মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, খেলাফত মজলিসের মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, অধ্যাপক আবদুল জলিল, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান ফুয়াদ, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর ও রাশেদ খান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামিক বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ, আপ বাংলাদেশের আলী আহসান জুনায়েদ, ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম, সেক্রেটারি নাছির উদ্দিন, ছাত্রশিবির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস ফরহাদ হোসেন, মোসাদ্দেক আলি, এবি জোবায়ের প্রমুখ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
হাদির জানাজা শেষে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে আসে ছাত্র-জনতা। দাফন শেষ করেও বড় একটি অংশ শাহবাগে জমায়েত হন তারা। জানাজা ও দাফন শেষে শাহবাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জনস্রোতে রূপ নেয়। সেখানে অবস্থান নিয়ে হাদির মৃত্যুতে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। সেখানে হাদির স্মরণে শোক প্রকাশের পাশাপাশি তার হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। স্লোগান, ব্যানার ও ফেস্টুনে উঠে আসে হাদির সংগ্রামী জীবনের নানা বার্তা।
ওসমান হাদির জানাজা শেষে অসংখ্য মানুষকে হেঁটে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফিরতে দেখা গেছে। মানুষের চাপে গণপরিবহন চলাচল পুরোটাই বন্ধ হয়ে যায়।
সমাবেশে বক্তারা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে পদত্যাগের আলটিমেটাম দিয়েছেন। তিনি পদত্যাগ না করলে শিক্ষার্থী-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আরো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা।
৩২ বছর বয়সি ওসমান হাদি গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরে বক্স কালভার্ট রোডে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয় রিকশায় থাকা হাদিকে। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদিকে গুরুতর অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক একটি অস্ত্রোপচারের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাদির ঘাতক সাবেক ছাত্রলীগে নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ।
পরে গত সোমবার দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সে সময় হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল। বৃহস্পতিবার পরিবারের সম্মতিতে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তার মস্তিষ্ক থেকে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শহীদ হন ওসমান হাদি। তিনি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছিলেন এই যুবক।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

