জুলাই বিপ্লবের সম্মুখভাগের যোদ্ধা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরীফ ওসমান হাদির লাশ ঢাকায় আনা হয়েছে। তার লাশ বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৫৮৫ ফ্লাইটটি গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। রাতে তার লাশ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের মরচুয়ারিতে (হিমঘরে) রাখা হয়। আজ শনিবার দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
ভারতীয় আধিপাত্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ দেশ। খাঁটি দেশপ্রেমিক এই জুলাইযোদ্ধার জন্য কাঁদছে গোটা বাংলাদেশ। হাজারো মানুষ শহীদ হাদির জন্য চোখের পানি ফেলেছেন। শোকাহত বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে নেমে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন। অনেকে আবার হাদির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রদর্শন করে। কেউ দোয়া-মোনাজাত করে এই শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন, কেউ কেউ নিজে ‘হাদি’ হওয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন।
অন্যদিকে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া অশ্রু ও বিপ্লবী চেতনার বহিঃপ্রকাশ গতকালও অব্যাহত ছিল। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গতকাল বাদ জুমা বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্র-জনতা। জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বিভিন্ন ইসলামি দলসহ ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল করে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশালসহ বড় বড় শহরের অলিগলিতে বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগান অনুষ্ঠিত হয়। মিছিল-স্লোগান হয় দেশের জেলা-উপজেলা শহরগুলোয়ও। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ দেশের কয়েকটি স্থানে সড়ক ব্লকেড করে বিক্ষোভ প্রদর্শনের খবর পাওয়া গেছে।
তরুণ নেতা ওসমান হাদির মৃত্যুতে আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। শোক পালনের অংশ হিসেবে দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এছাড়া গতকাল বাদ জুমা দেশের প্রতিটি মসজিদে শহীদ ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও আয়োজন করা হয় বিশেষ প্রার্থনার।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয় রিকশায় থাকা ওসমান হাদিকে। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদিকে গুরুতর আহতাবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক একটি অস্ত্রোপচারের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে গত সোমবার দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সে সময় হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল। বৃহস্পতিবার পরিবারের সম্মতিতে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তার মস্তিষ্ক থেকে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শহীদ হন ওসমান হাদি। তিনি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী প্রচার চালাচ্ছিলেন এই তরুণ।
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় বিক্ষোভ মিছিল করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ অবরোধ করে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ছাত্র-জনতা।
এদিকে একদল বিক্ষোভকারী ওই রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা চালায়। রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ির অবশিষ্টাংশও ভেঙে ফেলা হয়। এছাড়া ওই রাতেই রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অফিস বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও বান্দরবানে প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশেইসিংয়ের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষোভকারীরা। এছাড়াও তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী স্থাপনা ভাঙচুর করে।
ওসমান হাদি হত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবারের ধারাবাহিকতায় গতকালও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ছাত্র-জনতা। গতকাল বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সকাল থেকে ছাত্র-জনতা শাহবাগ অবরোধ করে। দুপুর হতে না হতে শাহবাগ চত্বর জনসমুদ্রে রূপ নেয়। সেখানেই তারা জুমার নামাজ আদায় করেন। নামাজের পর শাহবাগে জনতার উপস্থিতি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এ সময় আওয়ামী ও ভারতবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা। এর আগে সহিংস পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে তার ফেসবুক পেজে শাহবাগের অবরোধ কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দিলেও ছাত্র-জনতা তা আমলে নেয়নি।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে নাহিদ ইসলাম জুমার নামাজের পর যেকোনো কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গতকালের (বৃহস্পতিবারের) মতো ভাঙচুর ও নাশকতা করার পরিকল্পনা রয়েছে জুলাইবিরোধী শক্তিগুলোর। আমরা যেকোনো ধরনের ভায়োলেন্স ও নাশকতার বিরুদ্ধে। জনগণের ক্ষোভকে ব্যবহার করে কোনো হঠকারী গ্রুপ কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ অথবা কোনো নাশকাতমূলক কার্যক্রম যাতে করতে না পারে, সে ব্যাপারে ভূমিকা পালন করুন।
এদিকে, দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকার বিবৃতিতে বাংলাদেশের সব নাগরিককে কয়েকজন বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ় ও সতর্ক অবস্থান নিতে আহ্বান জানায়। সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, অগ্নিসংযোগ এবং জানমাল ধ্বংসের সব কর্মকাণ্ডের প্রতি নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের ইতিহাসের এ সংকটময় সময়ে বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যারা বিশৃঙ্খলাকে পুঁজি করে এবং শান্তির পথকে উপেক্ষা করে, এমন অল্প কয়েকজনের কারণে এ অগ্রযাত্রা কোনোভাবেই ব্যাহত হতে দেওয়া হবে না।
হাদির লাশ গ্রহণ করেন যারা
শহীদ ওসমান হাদির লাশ বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইট গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বিমানবন্দরে শহীদ হাদির লাশ গ্রহণ করেনÑস্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, তথ্য উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির আহমেদ এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑআমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবের ও নেতা বুরহান উদ্দিন। এ সময় হাদির ভগ্নিপতি আমিরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে হাদির লাশের সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে আসেন তার বড় ভাই আবু বকর।
আজ জানাজা ও দাফন
শহীদ ওসমান হাদির জানাজা আজ শনিবার দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে। এর আগে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জানাজার সিদ্ধান্ত হলেও পরিবর্তিত পরিস্থতিতে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে।
প্রেস উইং থেকে ওসমান হাদির জানাজায় অংশগ্রহণে আগ্রহীদের কোনো ধরনের ব্যাগ বা ভারী বস্তু বহন না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া ওই সময় সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকায় ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জানা গেছে, জানাজার পর হাদির লাশ মিছিলসহকারে নেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে দাফন করা হবে। পরিবারের ইচ্ছায় তাকে কবি কাজী নজরুলের সমাধি এলাকায় দাফনের সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলার সঙ্গে আন্দোলন জারি রাখার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, কোনো গোষ্ঠী যেন অনুপ্রবেশ করে আন্দোলন স্তিমিত করতে না পারে। একই সঙ্গে সহিংসতার সুযোগও যাতে না পায়। লাশ দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

