আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস আজ

দেশে সাক্ষরতার প্রকৃত হার নিয়ে প্রশ্ন

রকীবুল হক
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ৪৯

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ২০০৯ সালে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল আনুমানিক ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ। আওয়ামী সরকারের সময় সাক্ষরতার এ হার বাড়াতে বাড়াতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগের বছর দেখানো হয় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। পতনের পরের মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ২০২৪ সালে তা দেখানো হয় ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি বছরও একই হার দেখিয়েছে বর্তমান সরকার।

বিজ্ঞাপন

তবে বাস্তবে সাক্ষরতার এ হার অনেক কম এবং আওয়ামী আমলের তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এ হার ৫০ শতাংশের নিচে বলে দাবি করেছেন খোদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিগত সরকারের সময় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও শিক্ষার মান ও সাক্ষরতার হার তেমন বাড়েনি। এ অবস্থায় সঠিক তথ্যউপাত্ত বের করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।

দেশের সাক্ষরতার হারের এমনই বাস্তবতার মধ্য দিয়ে আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও পালন করা হবে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৫’। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রমোটিং লিটারেসি ইন আ ডিজিটাল ইরা’ যা বাংলায় মূলভাব ‘প্রযুক্তির যুগে সাক্ষরতার প্রসার’। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হবে।

এ উপলক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো মিলনায়তনে আলোচনা সভা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্মাননা প্রদান ও তারুণ্যের উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার প্রধান অতিথি থাকবেন। দিবসটি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন।

এদিকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে গতকাল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাক্ষরতা শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়। মাতৃভাষায় পড়া, লেখা, অনুধাবন, যোগাযোগ এবং গণনাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে জ্ঞান প্রয়োগের সক্ষমতা অর্জনই প্রকৃত সাক্ষরতা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সাক্ষরতার বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি নিরক্ষরতা দূরীকরণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সরকার সাক্ষরতা বিস্তারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।

উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪) অনুযায়ী দেশের সাত বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২২ দশমিক ১ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনো নিরক্ষর। এ জনগোষ্ঠী মূলত বিদ্যালয়বহির্ভূত বা ঝরে পড়া শিশু এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের জন্য তাদের সাক্ষরজ্ঞান ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি দপ্তরের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো এ বিষয়ে কাজ করছে।

তিনি বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১৪ অনুযায়ী ১০-১৪ বছর বয়সি বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুদের উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান এবং ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সি নিরক্ষর নারী-পুরুষকে সাক্ষরতা, জীবিকায়ন দক্ষতা ও জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এ সময় সাক্ষরতার বর্তমান হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রাথমিক উপদেষ্টা বলেন, স্টাডি না করে প্রকৃত সাক্ষরতার হার বলা যাবে না। এ বিষয়ে আমরা অ্যাসেসমেন্ট করছি। দেশের সাক্ষরতার হার নিয়ে প্রশ্ন তুলে উপদেষ্টা বলেন, সম্প্রতি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক।

এর আগে গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, দেশের প্রকৃত সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশের নিচে। তিনি বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, শিক্ষকদের মানোন্নয়ন হয়েছে কিন্তু সাক্ষরতার ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়নি। যেটা মূল লক্ষ্য, সেটা অর্জিত হয়নি। আমাদের এখনো কাগজপত্রে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যেও গলদ রয়ে গেছে। নিরক্ষর জাতি দিয়ে আমরা উন্নতি করতে পারব না।

জানা গেছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম একটি বিষয় হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে বিনামূল্যে, ন্যায়সংগত ও মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য পূরণ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। পতিত আওয়ামী সরকার এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতি বছর সাক্ষরতার হার বাড়ানোর তথ্য প্রকাশ করত।

এ বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, বিগত সরকার বছর বছর সাক্ষরতার হার বাড়িয়ে দেখাত। এ বিষয়ে আমরা তথ্য জানতে চাইলেও তার সদুত্তর পাইনি। এখনো যদি একই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে লাভ কী হলো?

তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগে সরকার যখন সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ দেখিয়েছিল, তখন আমাদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৫২ শতাংশ। সঠিক তথ্যউপাত্ত বের না করতে পারলে সঠিক পরিকল্পনাও গ্রহণ করা যাবে না। বিগত সরকার সমন্বিত কর্মসূচির পরিবর্তে প্রকল্পভিত্তিক পরিকল্পনা নিত বলেও সমালোচনা করেন তিনি।

একই ধরনের মন্তব্য করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমদ বলেন, বিগত সরকারের সময় এক বছরের সংখ্যার সঙ্গে যোগ করে পরের বছরের সাক্ষরতার হার দেখানো হতো। সাক্ষরতার কোনো পরীক্ষা করা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার হারের সঙ্গে মিল রেখে এটা দেখানো হতো। বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। কারণ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেও অনেকে লিখতে ও পড়তে পারে না।

বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ সরকার শিক্ষাকেন্দ্রিক কোনো কমিশন করেনি। রাজনৈতিক সরকারের ধারাই বহাল আছে। আগামীতে রাজনৈতিক সরকার এলেও শিক্ষার উন্নতি আশা করা দুরূহ।

প্রধান উপদেষ্টার বাণী

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৫’ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ৮ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৫’ পালন করা হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত।

তিনি বলেন, সাক্ষরতা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান। প্রযুক্তিনির্ভর এই আধুনিক পৃথিবীতে সাক্ষরতার ধারণা আজ শুধুমাত্র পড়ালেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল জ্ঞান, তথ্য ব্যবহারের দক্ষতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা। এখন তথ্য খুঁজে বের করা, বিশ্লেষণ করা, অনলাইনে শেখা ও দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান খোঁজা—এসবই কার্যকর সাক্ষরতার অংশ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে যারা পিছিয়ে পড়ছে, তারা কেবল শিক্ষাবঞ্চিতই নয়, বরং সমাজ ও অর্থনীতির মূল স্রোত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্রযুক্তির যুগে সাক্ষরতার প্রসার’ সময়োপযোগী ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে বলে আমি মনে করি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আসুন, আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করি, যেখানে প্রযুক্তি ও সাক্ষরতার সম্মিলিত শক্তিতে গড়ে উঠবে একটি জ্ঞানভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক সমাজ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত