রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে চলনবিল হত্যার আয়োজন

শরীফুল ইসলাম ইন্না, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ১১

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায় জীববৈচিত্র্যের আধার চলনবিল ধ্বংস করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিল হত্যার আয়োজন করছে। অথচ এই স্থানে ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হলে সিরাজগঞ্জ-পাবনা-নাটোরের ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত চলনবিলের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত এবং গো-খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

জানা যায়, সিরাজগঞ্জে অবস্থিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আইন পাস হয় ২০১৬ সালে। ক্লাস শুরু হয় ২০১৮ সাল। এরপর থেকে শাহজাদপুর পৌর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আটটি ভাড়া ভবনে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করতে শাহজাদপুর শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে বুড়ি পোতাজিয়ার চলনবিলের অংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়। স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে প্রকল্প অনুমোদনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা এর মধ্যে কয়েক দফা সড়ক অবরোধ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

গত ১৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সেই পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রস্তাবিত স্থানটি বছরে চার মাস পানির নিচে ডুবে থাকে। এটি ৯ মিটারের বেশি ভরাট করতে হবে। এজন্য বালু লাগবে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৬৩০ ঘনমিটার। ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করতে হবে একটি সড়ক ও সেতু। পানির ঢেউ প্রতিরোধে দিতে হবে বাঁধ। এসবের জন্য ব্যয় হবে ৪৪৮ কোটি টাকা।

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ১০০ একরের মধ্যে ইতিমধ্যে ৪ একর ভরাট করার কারণে বড়াল নদের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাকি ৯৬ একর ভরাট করা হলে বর্ষাকালে চলনবিল ও বড়াল নদের পানিপ্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, বুড়ি পোতাজিয়া মৌজায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত প্রস্তাবিত স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মিত হলে বড়াল নদীতে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। এ ছাড়াও চলন বিলের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবে এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে প্রতীয়মান হয়। উক্ত স্থানে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রয়োজন হলে ৯৬ একর ভূমি ৯.৫ মিটার উচ্চতায় মাটি ভরাট, চারদিকে ঢেউ প্রতিরোধে ৫ কি.মি. ডুবন্ত বাঁধকে উচ্চতা বাড়িয়ে রাস্তায় উন্নীত এবং একটি ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে, যার আনুমানিক ব্যয় ৪৪৮ কোটি টাকা। যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। সুতরাং বর্ণিত স্থানে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ যুক্তিযুক্ত হবে না বলে প্রতীয়মান হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা একনেকের সভায় ৯ হাজার ২৩৪ কোটি ব্যয়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ দেন। দীর্ঘ আট বছর পর একাধিক সংশোধনের পর গত ৭ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চেয়ারপারসন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন। সভায় প্রকল্পের বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় ৫১৯ কোটি টাকা।

শনিবার চলনবিল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বুড়ি পোতাজিয়ার যে স্থানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য ১০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেখানে ইতোমধ্যে ৪ একর অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করা। এ কারণে বড়াল নদীর পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই বিল অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে জেলেরা মাছ ধরে পরিবার চালায়। শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদ, কলাই ও গো-খাদ্যের জন্য ঘাস রোপণ করা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ গো-চারণ ভূমি এখানে। এর ওপর ভিত্তি করে প্রায় ১৫শ’ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় ৩০ হাজার গো-খামার। এসব খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। কিন্তু যেসব এলাকায় গো-খাদ্যের জন্য ঘাস রোপণ করা হয় সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা হলে গো-খাদ্য উৎপাদন কমে আসবে।

রাউতারা গ্রামের বাচ্চু সরকার বলেন, ক্যাম্পাস নির্মাণের জায়গা দেওয়া হয়েছে পোতাজিয়া ইউনিয়নের বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায়। এই এলাকায় বেশ কয়েকটি নদ-নদী রয়েছে। বড়াল নদী, করতোয়া নদী ও ধলাই নদী রয়েছে। বর্ষ মৌসুমে সমস্ত পানি এসে মিলিত হয় এই এলাকায়। এ সময় জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্ভর করে। শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি গো-খাদ্যের জন্য ঘাস রোপণ করা হয়। ক্যাম্পাস নির্মাণ হলে গো-খামারিরা গো-খাদ্য নিয়ে বিপাকে পড়বেন। তারপরও আমরা এই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চাই।

নৌকার মাঝি আমানুর বলেন, এই জায়গায় মাটি ভরাট করা হয়েছে অনেক আগেই। এখানে গুচ্ছগ্রাম করার কথা ছিল। এখন চারদিকে পানি। মাছ মেরে আমাদের জীবন চলে। বিশ্ববিদ্যালয় হোক তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে খামারিদের বিষয়ে বিবেচনায় রাখতে হবে।

বাঘাবাড়ি মিল্কভিটার পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মনির বলেন, যে জায়গায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হবে, বর্তমানে সে জায়গা মিল্কভিটা থেকে ঘাস চাষের জন্য খামারিদের লিজ দেওয়া হয়েছে। জমি না থাকলে তো গো-খাদ্যের উৎপাদন কমে আসবে। তারপরও বৃহৎ স্বার্থে ক্যাম্পাস নির্মাণ হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক এস এম মিজানুর রহমান জানান, চলনবিল অঞ্চলের ৬টি জেলা, ৪১টি উপজেলা, ১ হাজার বর্গ কিলোমিটারে মধ্যে ৪৭টি নদী ও ১৬৩ বিল, ৩শ’রও বেশি ক্যানেল, ১ লাখ ২০ হাজার পুকুর রয়েছে। এ অঞ্চলে চলনবিলের সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি। এ ছাড়া ১০৫ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭ প্রকারের উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির পাখি, অসংখ্য প্রকারের জলজ উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী চলনবিল অঞ্চলে বসবাস করে। যারা এই অঞ্চলে পানি প্রবাহের উপরে জীবনধারণ ও জীবিকা নির্বাহ করেন। আর বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ হচ্ছে চলনবিল, গোহালা ও বড়াল নদীর পতিত মুখে। ওই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হলে উজান থেকে নেমে আসা ছোট-বড় ৪৮টি নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।

মিজানুর আরো বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং ওই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে চলনবিল অঞ্চলের এক কোটি মানুষ পরিবেশগতভাবে ব্যাপক হুমকির মধ্যে পড়বে। পাশাপাশি নদী পথ পরিবর্তন করতে হবে, চলনবিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে, নদীর ভাঙন বাড়বে, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, জলদ উদ্ভিদ রক্ষা করা অসম্ভব হবে।

এদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের দাবিতে গতকাল গণঅনশন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী একাডেমিক ভবন-৩ এর সামনের গেটে এই কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। এর আগে গত ১৩ আগস্ট সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রেল সড়ক ব্লকেড ও ১৪ আগস্ট যমুনা সেতু পশ্চিম গোলচত্বর এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এস এম হাসান তালুকদার বলেন, একনেকে যে সমস্ত শর্ত দেওয়া হয়েছিল আমরা তা ফুলফিল করে দিয়েছি। জুন মাসের ১৬ তারিখে পরিবেশ উপদেষ্টা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস এলাকা পরিদর্শনে আসেন। তিনি ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে একনেকে সভায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এজেন্ডা হিসেবে আসেনি। আমরা ধরে নিয়েছি পরিবেশ সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা আছে। এনজিও নামধারী কিছু সংগঠন গত ১০ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় হলে চলনবিলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পরবর্তী সময়ে আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে যোগাযোগ করলাম। আমরা বললাম পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে আমাদের।

তিনি আরো বলেন, আমাদের বলা হয়েছে ৩৩ ভাগ জমি বনায়নের জন্য রাখতে হবে। আমরা সেই শর্তও মেনেছি। জলাশয় এবং হাওড় অধিদপ্তর তারাও পরিদর্শন করে ছাড়পত্র দিয়েছে। তারা শর্ত দিয়েছে এখানে দুটি লেক রাখতে হবে। সেটিও মেনে নিয়ে ১৬ একর জায়গা লেকের জন্য এবং সাড়ে ৬ একর জায়গা রেখেছি পুকুরের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চলনবিল হচ্ছে ৬৮ কিলোমিটার দূরে। তার মাঝে অনেক গ্রাম আছে, রাস্তা, স্কুল, কলেজ আছে। সেগুলো থাকার পরও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ-পাবনা-নাটোর জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে চলনবিল গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে তো শাহজাদপুর নেই।

উপাচার্য বলেন, ৮ বার সংশোধন করার পরও ফাইল ঘুরছে। এটি কি কোনো প্রকল্প? একটার পর একটা অভিযোগ আসছে। আপনারা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেন, না হলে বন্ধ করে দেন।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পাবনা প্রতিনিধি]

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত